-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
তখনও ঘাসের ডগায় শিশির পড়েনি। সারা দেশের আবহাওয়া ছিল বেশ গরম। আগাম শীতের আমেজও ছিল না। শীতের উপহার মধুবৃক্ষ খেজুর গাছ থেকে রস নামানোর জন্য গ্রামাঞ্চলের পরিচিত গাছিয়ারা কেবল বড় কাস্তে বা হাসুয়াতে শান দেবার কথা ভাবছেন। কেউ কেউ মালিকের খেজুর গাছ লিজ নেবার জন্য দামদর শুরু করেছেন। ঠান্ডা ও কুয়াশা না পড়লে খেজুর গাছে রসের হাঁড়ি লাগানো হবে না। রস নামানো শুরু হয়নি- অথচ বাজারে নতুন খেজুরের গুড় বিক্রির ধুম পড়ে গেছে।
শুধু খেজুর গুড়খ্যাত দেশের বিখ্যাত জেলাগুলোতেই নয়- অনলাইনে নতুন খেজুর গুড় বিক্রির জন্য ছবিসহ বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতা আকর্ষণের চেষ্টা শুরু হয়ে গেছে। সম্প্রতি বাজার থেকে নতুন খেজুর গুড় কিনে এনে বাসায় পায়েস তৈরীও হয়ে গেছে! সেদিন সকালে নাশতার টেবিলে জানানো হলো নতুন খেজুর গুড় দিয়ে তৈরী পায়েস- খেতে কেমন স্বাদ হয়েছে? সময়ের তাড়া থাকায় সামান্য একটু মুখে দিয়ে শুধু হুঁ-হ্যাঁ করে মাথা নেড়ে অফিসে দৌঁড়াতে হলো।
আমাদের একজন কলিগের মৌসুমী ফল ও ভেষজ দ্রব্যাদি সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান আছে। তিনি বিভিন্ন ফলবাগান মালিকদের সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখেন এবং ভেজালমুক্ত পণ্য সরবরাহ করে থাকেন। তাঁকে এবছরের নতুন খেজুর গুড়ের কথা বলতেই কিছুটা রেগে গিয়ে সাবধানবাণী শোনালেন।
তা হলো- তিনি অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেখে নিজেও নতুন খেজুর গুড় কেনার জন্য অর্ডার করতে তার পরিচিত ‘গাছিয়া’ ব্যবসায়ীর সাথে দ’ুদিন পূর্বে যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি তাঁকে নতুন খেজুর গুড় সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছেন তা বড় ভয়ংকর। তাকে জানানো হয়েছে, একজন গুড় ব্যবসায়ী ইতোমধ্যে ২০ মন নতুন খেজুর গুড় বিক্রি করে মুনাফা করেছেন। কিন্তু তিনি নিজে এ কাজে এখনও হাত দিতে পারেননি। কারণ শীত না পড়ায় এবছর আমাদের এলাকায় ডিসেম্বরের আগে এখনও খেজুর গাছে রসের হাঁড়ি লাগানো হয়নি।
কিন্তু ইতোমধ্যে যারা বাজারে নতুন খেজুর গুড় বলে বিক্রি শুরু করেছে সেগুলো নতুন গুড় নয়। প্রতিবছর খেজুর গুড় তৈরীর সময় নালী বা ময়লা-গাদসহ যেসব উচ্ছিষ্ঠ গবাদিপশুর খাবারের জন্য ড্রাম ভরে রেখে দেয়া হয় সেগুলোতেও খেজুর রসের গন্ধ থাকে। সেসব নালীকে পুনরায় চুলায় জ্বাল দিয়ে তার সংগে অতিরিক্ত চিনি, হাইড্রোজ, ফিটকিরি ও নানা ক্ষতিকর কেমিক্যাল মিশিয়ে ‘নতুন খেজুর গুড়’তৈরী করে বাজারে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। তিনি জানালেন, এই অসাধু পন্থায় কেউ ২০ মন বিক্রি করে অবৈধ মুনাফা করলেও তিনি মানুষকে ধোঁকা দেবার জন্য সে অন্যায় কাজ করতে পারেন না।
আরেকটি বিষয় হলো যশোরের- শার্শা, মনিরামপুর, চৌগাছা, রাজশাহীর- বাঘা, বানেশ্বর, নাটোরের বড়াইগ্রাম, লালপুর, বাগাতিপাড়া, চারঘাট, বৃহত্তর কুষ্টিয়া, ফরিদপুরের বিভিন্ন জায়গায় একইভাবে অসাধু পন্থায় সময়ের আগে রসছাড়াই নতুন খেজুর গুড় তৈরী করে বাজারে সয়লাব করে দেয় হচ্ছে। আসল খেজুরের গুড় অনেকটা নরম প্রকৃতির এবং রং বদামী ও কিছুটা কারচে ধরণের হয়ে তাকে। কিন্তু চিনি মেশালে খেজুর গুড় বেশ শক্ত হয়। ভেজাল গুড়কে হাইড্রোজ, ফিটকিরি দিয়ে পরিস্কার করে বিষাক্ত রং মিশিয়ে ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
এছাড়া আমাদের দেশে সব জেলায় গ্রীষ্মকালে তালের রস নামানো হয়। সাধারণত: ভাদ্রমাসে তালের রস পরিমাণে অনেক বেশী হয়। তালের রস সংগ্রহ করে সেগুলোতে খেজুরের নালী-গাদ গন্ধ ব্যবহার করে তালের গুড়কে খেজুরের গুড় বলে চালিয়ে দিচ্ছে ভেজালকারীরা। এসব তালের গুড় খুব শক্ত হয়। চিনি মিশিয়ে তালের গুড়ের মিষ্টি বাড়িয়ে তিতো ভাবকে দূর করা হয়। আমের মৌসুমে একই কায়দায় তারা কেমিক্যাল মিশিয়ে আম পাকায় ও অবৈধ মুনুফা অর্জন করে থাকে।
তিনি আরো জানালেন, আজকাল শীত মৌসুমে আগেকার দিনের মতো পিঠা-পুলি, প্যারা সন্দেশ, ক্ষীর-পায়েস স্বাদ লাগে না কেন? এখন প্রাকৃতিক সুগন্ধি চাল নেই, সেই চালের আটাও নেই। তার সংগে যুক্ত হয়েছে খেজুর গুড় নকল-ভেজাল করে ক্রেতাদের সাথে চরমভাবে প্রতারণা করার প্রতিযোগিতা। তিনি জানালেন, বাজার থেকে মাঘের আগে নতুন খেজুর গুড় না কিনতে। কারণ, মাঘ মাসে বেশী শীতে বেশী মিষ্ট খেজুর রস পাওয়া যায় এবং সেই রসের গুড় বেশ ভাল মানসম্পন্ন হয়ে থাকে।
কিছুটা কৌতুলবশত: জিজ্ঞাসা করলাম ওখানে ভোক্তা অধিকারের বাজার তদারকী টিম যান না? এসব অপরাধীদের জেল-জরিমানা করেন না? বললেন, এসব ভেজাল গুড় তৈরীর সংবাদ পেলে মাঝে মাঝে যান। কিন্তু যেসব এলাকায় অতি গোপনে ভেজাল গুড় তৈরী হয় সেখানে তারা পৌঁছাতে পারে না। জরিমানা করলে ওরা জরিমানা দেয়। কিন্তু তদারকী টিম চলে যাবার পর জরিমানার ঘাটতি পুষিয়ে নিতে পুনরায় বেশী বেশী ভেজাল গুড় তৈরী করতে তৎপর হয়ে পড়ে। কারণ, ওদের মনের মধ্যে প্রতারণার কালিমা ছেয়ে গেছে। বলে না- ‘কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না’- আজকাল সব জায়গায় বিষয়টা এমন হয়ে গেছে। এবার তাঁর কথায় অনেকটা হতাশার ভাব লক্ষ্য করলাম।
আসলে খাদ্য বাজারে ভেজাল পণ্যে সয়লাব। ইরি ধানের চাল কয়েকবার কেটে চিকন করে সুগন্ধি মেখে পোলাও চাল, মাছ ও গরুর মাংসে রং ও ফরমালিন, সরিষার তেলে বিষাক্ত রংয়ের ঝাঁঝ, চাল-ডালে কংকর, গুড়ো মশলার মধ্যে ইট-কাঠের গুড়া, ফলের মধ্যে ফরমালিন-আরো কত কি! আমরা যাব কোথায়? আর খাব কি? অপরাধীদের জেল-জরিমানা করলেও ভেজাল খাদ্যের কারণে রোগ-বালাই থেকে মানুষের রেহাই নেই। দেশের মাথা থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সবকিছুতে ভেজালের ছড়াছড়ি। এসব ভেজাল পণ্য কিনতে হচ্ছে অতি চড়ামূল্যে। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যবাজার দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়ে নিম্নআয়ের ক্রেতাদেরকে অর্থপঙ্গু করেছে। আমাদের সর্বাঙ্গে ব্যাথা ঔষধ দিবেন কোথা? খেজুর গাছের নতুন রস হাঁড়িতে না পড়তেই যদি বাজারে সেই নতুন রসের গুড় বিক্রির ধুম পড়ে যায় তাহলে আমরা কতটা নিচে নেমে গিয়েছি তা ভাবতে পারছেন?
এত মূল্যবান কথা শুনে ভাবলাম সেই গুড়ের দোকানদার অনেকটা পরিচিত। বাসায় যদি সেই কেনা ভেজাল নতুন গুড় আরো অবশিষ্ট থাকে তাহলে সেগুলো তাৎক্ষণিক ফেরত দিয়ে আসতে বলব। আর জিজ্ঞাসা করতে বলব- এবছর তখনও গাছ থেকে নতুন রস-ই নামেনি, অথচ নতুন গুড় পেয়েছিলেন কীভাবে? হয়তো দোকানদারের মুখে আরো অজানা তথ্য পাওয়া যাবে। যেটা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের চেষ্টায় নীতিগত কাজে লাগতে পারে।
কারণ প্রায় সবকিছুতেই চাতুরী করে নৈতিক অবস্থান থেকে সরে এসে প্রতারণা করা এখন আমাদের মজ্জাগত বিষয়ে রূপ নিয়েছে। ভেজাল ও জালিয়াতচক্র এখন জাতির মস্তিষ্কে বিচ্যুত আচরণ করার জন্য প্রেষণা জাগাতে দিনরাত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এভাবে একটি স্বাস্থ্যহীন, মেধাহীন, নৈতিকতাবিহীন জনগোষ্ঠী বেড়ে উঠতে থাকলে সেসব চোর-ডাকাত ও তাদের দোসরদের টার্গেট চরিতার্থ হবে এবং বড় লাভ অর্জিত হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এসব অন্যায়ের দিকে ক্রমাগতভাবে আকৃষ্ট হয়ে দিন দিন দিশাহীন হয়ে পড়ছে। তারা ভাল কিছু অনুসরণ করার উৎস খুঁজে পাচ্ছে না।
সেজন্য তারা হন্যে হয়ে মোবাইল যুগেও ঘরের কোণায় আবদ্ধ হয়ে বন্দি জীবন বেছে নিয়েছে। সেখানেও তারা নিরাপদ নয়। আধুনিক ডিজিটাল যুগের মেকি বুদ্ধির জোয়ারে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে দিনরাত শুধু বাটম টিপে আরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। চারদিকে কৃত্রিম, মেকি, ডামি, নকলের হাতছানি তাদেরকে উন্মাদ করে তুলতে শক্তি যোগাচ্ছে। এভাবে অসংখ্য মেকি, ডামি, কৃত্রিম, মডেলদের ভিড়ে প্রকৃতি প্রদত্ত যাবতীয় নিয়ামত নিশেষ: হতে চলেছে। এমনকি পাখি বা কীট পতঙ্গের ডিম অথবা মানুষ বা জীবের ভ্রুণ কৃত্রিমতায় রূপ নিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে জীবৈচিত্র্য ও মনুষ্যত্ব। বাড়ছে সীমাহীন নিচতা, স্বার্থপরতা ও ভয়ংকর লোভ- লালসা। কোন সাবধানবাণী, দোহাই, ধরপাকড়, জেল-জরিমানাকে এসব জালিয়াতরা ডর করে না। কারণ তাদের উৎসাহদাতারা এসময় সব জায়গায় খুবই শক্তিশালী।
অসময়ে মধুবৃক্ষ খেজুরের রসবিহীন ভেজাল খেজুরগুড় তৈরী করা আর জালিয়াতির মাধ্যমে সামাজিক দুর্নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষতকা অবলম্বন করে একাডেমিক হোক বা নন-একাডেমিক হোক- যে কোন পরীক্ষায় পাশ করার মধ্যে কোন তফাৎ নেই। এমন অবস্থা ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকলে সেটার ইতিবাচক সমাধান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এমনকি অতিচাতুরী ও জালিয়াতময় পরিস্থিতির জ্বালা ও গ্লানির ব্যাপকতায় হতাশ মানুষেরা শুধু একে অপরকে প্রশ্ন করতে থাকবে কিন্তু সঠিক সমাধানকারী খুঁজে পাবে না। এক্ষেত্রে সমাধানকারীরা নিজেদেরকে অসহায় অথবা জন্মান্ধ মনে করে পিছুটান দেবে। আত্মপ্রয়োজনে যে কোন অন্যায়কে ন্যায়জ্ঞানে চালিয়ে দেবার ব্যাপকতায়, দুর্বিপাকে হাবুডুব খেতে থাকা সিংহভাগ মানুষ ভাল-মন্দের পার্থক্য ভুলে গেলে সেখানে ‘আমি ভাল’ ভেবে লুকিয়ে থাকা সবার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠে। সেই সুযোগে ভেজালকারীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠার সুযোগ পেয়ে যায়।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]