সমর পাল।।
পশ্চিম ভারতের পার্সি সম্প্রদায় উপমহাদেশে ক্রিকেট খেলা প্রবর্তন করে। তাদের উদ্যোগে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় Oriental Cricket Club. ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন রাজধানী কলকাতায় ক্রিকেটের মান উন্নয়নে প্রচেষ্টা চালায় ইংরেজরা। তবে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় ক্রিকেট নিয়ে।
১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে বোম্বেতে পার্সি ও ইংরেজদের মধ্যে প্রথম ম্যাচ খেলা হয়েছিল। ক্রিকেটে পার্সিদের মান এত উন্নত ছিল যে তারা পরবর্তী সময়ে ১৮৮৬ ও ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে খেলতে যায়। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু , পার্সি ও ইংরেজদের মধ্যে ত্রিদলীয় বা Triangular ক্রিকেট খেলা শুরু হয়। ১৯১২ থেকে মুসলিম টিম যুক্ত হলে চারদলীয় বা Quadrangular প্রতিযোগিতার সূত্রপাত ঘটে। ব্রিটিশ আমলে ক্রিকেট নিয়ে এ দেশের রাজা-মহারাজাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল বেশ আকর্ষণীয়ভাবেই।
বাঙালিদের মধ্যে ক্রিকেট খেলাকে জনপ্রিয় করে তোলেন কোচবিহারের মহারাজ স্যার নৃপেন্দ্রনারায়ণ ভূপ বাহাদুর (১৮৬৩-১৯১১ খ্রি . ) এবং নাটোরের মহারাজ জগদিন্দ্রনাথ রায় (১৮৬৮-১৯২৬ খ্রি . )।
নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ ছিলেন সুসাহিত্যিক, স্বদেশপ্রেমিক, সমাজসেবক, সঙ্গীতজ্ঞ, বিদ্যোৎসাহী, গুণগ্রাহী, বলিষ্ঠ বক্তা এবং বিশিষ্ট ক্রীড়া-ব্যক্তিত্ব। শরীরচর্চা ও খেলাধুলায় তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ বাড়াতে তাঁর অসামান্য অবদান ছিল। বাংলার ক্রিকেট জগতের পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রে তিনি একজন প্রাণপুরুষ। ক্রিকেট-প্রেমিক জগদিন্দ্রনাথ সম্পর্কে একালে আমরা খুব কমই জানি।
নাটোর শহরের হরিশপুরে ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবর মাসে জন্মগ্রহণ করেন জগদিন্দ্রনাথ। তাঁর আসল নাম ব্রজনাথ। বাবার নাম শ্রীনাথ রায় এবং মায়ের নাম প্রসন্নময়ী দেবী। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে নাটোরের বড়তরফের মহারাজ গোবিন্দনাথের স্ত্রী মহারাণী ব্রজসুন্দরী তাঁকে দত্তক নেন এবং নতুনভাবে জগদিন্দ্রনাথ নাম রাখেন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে সেখান থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অতঃপর কলেজে কয়েক বছর লেখাপড়া করেন। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে জগদিন্দ্রনাথ কলকাতায় বসবাস শুরু করেন।
১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে কলকাতা টাউন ক্লাব ক্রিকেট খেলার জন্য বিখ্যাত ছিল। ঐ সময় সে ক্লাবে খেলতেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর (১৮৬৩-১৯১৫ খ্রি .) ভাই মুক্তিদারঞ্জন ও কুলদারঞ্জন (১৮৭৮-১৯৫০ খ্রি . )। এরা ছাড়াও টাউন ক্লাবের সদস্য ছিলেন তাঁদের বড়ভাই অধ্যাপক সারদারঞ্জন (১৮৫৮ – ১৯২৫ খ্রিঃ)। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলার মসুয়া গ্রামের এই তিন ভাই বাংলার ক্রিকেটকে উজ্জ্বলতর অবস্থানে নিয়ে গেছেন।
কলকাতাবাসী হবার পর মহারাজ জগদিন্দ্রনাথ কলকাতা ক্লাবের সদস্য, প্রেসিডেন্ট এবং পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করেছেন কয়েক বছর। কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজের (মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন ) অধ্যাপক (১৯০৯ থেকে অধ্যক্ষ) সারদারঞ্জন রায়কে বলা হতো বাংলার ক্রিকেটের জনক। টাউন ক্লাব তথা বাংলার ক্রিকেটের উন্নতির জন্য জগদিন্দ্রনাথ ও সারদারঞ্জন একজন অলরাউন্ডার পেশাদার ক্রিকেটারকে কোচ হিসেবে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। এছাড়াও তিনি ক্রিকেটার মেহতাকে পাঠিয়ে দিতেন খেলার মাঠে যাতে তরুণ ক্রিকেটাররা পারদর্শী হয়ে গড়ে উঠতে পারে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কলকাতার ক্রিকেটে পূর্ববাংলার সন্তানদের অবদান ছিল বিস্ময়কর এবং বলিষ্ঠ। ১৯৩৮-৩৯ খ্রিস্টাব্দের রঞ্জি ট্রফি জয়লাভকারী বাংলার ক্রিকেট দলের সদস্য কার্তিক বসু (১৯০৬-১৯৮৪ খ্রি .) কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি গ্রামের বিখ্যাত হেমেন্দ্রমোহন বসুর (১৮৬৬-১৯১৬ খ্রি .) সন্তান। হেমেন্দ্রমোহন বসুও কলকাতার স্পোর্টিং ইউনিয়ন ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি। বাংলার ক্রিকেটের বহু ব্যাটসম্যানের শিক্ষক এই কার্তিক বসু।
কলকাতা টাউন ক্লাবের সাথে দ্বন্দ্বের কারণে জগদিন্দ্রনাথ সেখান থেকে পদত্যাগ করেন সারদারঞ্জন, মুক্তিদারঞ্জন ও কুলদারঞ্জনসহ । ক্লাব ছাড়লেও ক্রিকেটের নেশায় পাগল জগদিন্দ্রনাথ ক্রিকেট ছাড়তে পারলেন না কিছুতেই। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বুন্দেল রোডে জগদিন্দ্রনাথ ৪৫ বিঘা বাগান কিনে সেখানে নাটোর পার্ক তথা ক্রিকেট মাঠ ও বসতবাড়ি নির্মাণ শুরু করেন। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন নাটোর ইলেভেন নামে ক্রিকেট দল। ১৯০১ থেকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নাটোর ইলেভেন দল কলকাতাসহ সমগ্র ভারতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশীয় ক্রিকেট দল হিসেবে গণ্য ছিল। সেসব স্মৃতি এখন আর কেউ মনে রাখেনি।
নাটোর ইলেভেন দলের সদস্য ছিলেন বোম্বের বালু, বান্দা, শিবরাম, পুরুষোত্তম শেষাচারি ইত্যাদি খেলোয়াড়। নাটোর পার্কে খেলেছে পাতিয়ালা, কাশ্মীর, যোধপুর, জামনগর, কুমারটুলি, কলম্বো, রেঙ্গুন ইত্যাদি দেশি-বিদেশি টিম। জগদিন্দ্রনাথ ও তাঁর ছেলে যোগীন্দ্রনাথ (ডাকনাম মনু) ছিলেন পারদর্শী ক্রিকেটার। অনেক খেলায় জগদিন্দ্রনাথ টিম ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পালন করেছেন। পার্সি খেলোয়াড় মেহতা (মেটা) ছিলেন নাটোর দলের প্রাণ। এ দলে খেলেছেন রাজু, হিমু, বাকু, জাইলুনাবাদের মতো বাঘা দেশি ক্রিকেটার। কুলদারঞ্জন বলেছেন, ‘নাটোর টিমের শিক্ষাগুরু ছিলেন জগদিন্দ্রনাথ স্বয়ং। প্রতিদিন তিনি সকলের আগে প্র্যাকটিস করিয়া Practice –net এর পিছনে বসিয়া থাকিতেন। আমরা অন্যেরা যখন প্র্যাকটিস করিতাম, প্রত্যেকের খেলার দোষক্রটি তিনি তৎক্ষণাৎ সংশোধন করিয়া দিতেন।’
মহারাজ জগদিন্দ্রনাথের হাতেই তৈরি হয়েছেন বিখ্যাত ক্রিকেটার মণিদাস ও রঙ্গলাল। ম্যাচ খেলায় কৃতিত্বের পুরস্কার হিসেবে মহারাজ কৃতী খেলোয়াড়দের দামি উপহার দিতেন। কুলদারঞ্জন বলেছেন, ‘নাটোর টিম ক্রিকেট খেলায় ভারতে সর্বশ্রেষ্ঠ দল বলিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। নাটোর টিমের সুখ্যাতি বঙ্গের শাসনকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল।’
একবার যোধপুর-জামনগর টিম কলকাতা এসেছিল। এই টিমে বিলাতের ছয়জন বিখ্যাত খেলোয়াড় ছিলেন। তৎকালীন ক্রিকেট-সম্রাট রণজিৎ সিং সেই টিমের ক্যাপ্টেন। নাটোর পার্কে নাটোর ইলেভেনের সাথে তাদের খেলা হলো। নিষ্পত্তি হলো ড্র হয়ে। ঐ টিমের অগাধশঙ্কর পরে মহারাজের দলে খেলতেন
যদুনাথ চক্রবর্তী বলেছেন, ‘ মহারাজ স্বয়ং যে একজন সুযোগ্য ক্রিকেট-খেলোয়াড় ছিলেন এবং দেশের ছাত্রবৃন্দকে ক্রিকেট খেলাতে উৎসাহিত করিতে যে তিনি কত আন্তরিক যত্ন লইতেন, তাহা বোধ হয় অনেকেই জানেন না।’
সারাদেশে ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করার জন্য জগদিন্দ্রনাথ খ্যাতনামা প্রত্যেক ক্লাবকে খেলায় আহ্বান করতেন। বোম্বাই ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল থেকে প্রতিবছর তিনি খ্যাতনামা খেলোয়াড়দের আনাতেন। এদের মধ্যে বালু, বিঠল, শিবরাম, অগাধশঙ্কর, ওয়ার্ডেন, শেষাচারি, রাজ্জাক, আজিজ, মাসি, শ্যামপার, মিস্ত্রি অন্যতম। কলকাতার মানুষ অপেক্ষায় থাকতো কবে ক্যালকাটা ক্লাব কিংবা বালিগঞ্জ ক্লাবের সাথে নাটোর টিমের খেলা হবে।
কোচবিহার ক্লাবে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড় থাকতে। কিন্তু নাটোর টিমে বিদেশি খেলোয়াড় ছিল না। খেলার মাঠে যাবার জন্য মহারাজ জনে জনে কথা বলে উদ্বুদ্ধ করতেন। তাঁর অজস্র অর্থব্যয়ে কেনা সরঞ্জাম বৃথা যায়নি। সারদারঞ্জনের সহায়তায় মহারাজের ক্রিকেট টিম ভারত ছাড়াও বিদেশের টিমের সাথে লড়ে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়েছে বারবার। রাজশাহী কলেজের ক্রিকেট টিমের সাথেও মহারাজের টিম জয়ী হয়েছে নাটোর ইলেভেন গঠনের সময়। সে খেলা হয়েছে রাজশাহী কলেজ মাঠে।
ক্রিকেট নিয়ে আমরা অনেক কাহিনি কিংবদন্তি শুনি। তবে বাংলার ক্রিকেটের পুরোধা-পুরুষ জগদিন্দ্রনাথ ও সারদারঞ্জন আমাদের কাছে বিস্মৃত। আমরা তাদের কথা জানি না বললেই চলে। অথচ বাংলার ক্রিকেটের ইতিহাস তাদের কথা বাদ দিয়ে তৈরি হওয়াটা বিস্ময়কর মনে হয়। অথচ তাই হয়। তাই হচ্ছে। জগদিন্দ্রনাথের ক্রিকেট ও শরীরচর্চায় অবদান নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। তবে সংক্ষেপে এই ক্ষুদ্র উপস্থাপন।
তথ্য সূত্র –
১। মানসী মর্ম্মবাণী, কলকাতা, মাঘ-১৩৩২
২। সমর পাল : পঞ্চদশ প্রসঙ্গ, ১৯৯২
৩। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান
৪। সমর পাল : অনাদৃত অধ্যায়, ২০০৬
৫। অতুল সুর : ৩০০ বছরের কলকাতা ঃ পটভূমি ও ইতিহাস
৬। সমর পাল : নাটোরের ইতিহাস, ১৯৮০
৭। শ্রীহেমেন্দ্রকুমার রায় : যাঁদের দেখেছি ।