শুক্রবার | ৮ নভেম্বর, ২০২৪ | ২৩ কার্তিক, ১৪৩১

সিন্দুক ও ‘এআই’কালে মধ্যযুগ

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম :

জানুয়ারী ২৩, ২০২৪ তারিখে একটি ছাপানো বাংলা দৈনিক পত্রিকার বড় শিরোনাম হলো দেশে ‘সিন্দুকের বিক্রি বেড়েছে’। এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে টাকা—পয়সা, সোনা—হীরা—মুক্তা ইত্যাদি রাখার জন্য সিন্দুক কেনার ধুম পড়েছে দেশে। শুধু এনালগ বা লোহার তালা—চাবিমারা আদিকালের সিন্দুক নয়। তারা ডিজিটাল ও বায়োমেট্রিক নিরাপত্তাসংযুক্ত সিন্দুকও কিনছেন।

আদিযুগে সাদ্দাদ—কারুনদের সোনা—রুপা মণি—জহরৎ রাখার হাজারো সিন্দুকের চাবি বহন করতো ভারবাহী সুঠামদেহী গাধারা। শতাধিক গাধার পিঠে সেসব তালাচাবির বস্তা বহন করার কাহিনী গল্পকথায় পড়েছি, শুনেছি। সেই যুগ অতীত হয়ে মধ্যযুগের মানুষ চোর ডাকাতের ভয়ে মাটি বা পিতলের কলসীতে ভরে গোপনে মাটির নিচে পুঁতে রাখতো। আবার কেউ কেউ ঘরের মধ্যে মোটা কাঠ অথবা লোহা দিয়ে বড় বড় খোলওয়ালা খাট—পালঙ্ক তৈরী করে তার ভেতরে টাকা—কড়ি, স্বর্ণমুদ্রা ভরে তালাচাবি মেরে রাতে উপরে শুয়ে ঘুমাতো। কারণ তারা ছিল লুটেরা ও কৃপণ। সেসময় তরবারী, বন্দুক ও পেশীর ভয় দেখিয়ে মানুষ কতল করে সম্পদ লুট করে নিজেরা ভোগদখল করতো। এর অনেকদিন পর ব্যাংকে টাকা—সম্পদ রাখার বিধান তৈরী হওয়ায় সম্পদশালীরা হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। কিন্তু সেই এনালগ তালাচাবির যুগও একবারে শেষ হয়ে যায়নি।

এখন ডিজিটাল যুগের ছোঁয়ায় কার্ডের মাধ্যমে সাংখ্যিক পদ্ধতির তালাচাবির ব্যবহার বেড়ে গেছে। আজকাল আংকিক সংখ্যাকেও বশ করতে পটু এক ধরনের ডিজিটাল চোর বা হ্যাকাররা। তারা পাসওয়ার্ড চুরি বা উদ্ধার করে নকল কার্ড তৈরী করে ডিজিটাল ডাকাতি করা শুরু করেছে অতি সংগোপনে।

এরপর বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে হাতের আঙ্গুলের ছোঁয়ায় তালা খোলার পদ্ধতি চালু হবার কয়েক বছরের মধ্যে সেখানেও বেড়েছে বিপত্তি। তাই চালু করা হয়েছে অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে মুখের অবয়ব, পরিচিত কন্ঠের গোপন কমান্ড, আপন চোখের মণির ইশারা ইত্যাদি নানা কৌশলে তালাচাবি ব্যবহার করার প্রবণতা। শুরু হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই—এর মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাদানের প্রচেষ্টা। তবুও নিস্তার নেই।

সব ধরণের ডিজিটাল ও বায়োলজিক্যাল নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে উভয়বিধ হ্যাকারদের স্কুল খোলা হয়েছে কোন কোন দেশে। এসব বিষয় এখন বিভিন্ন গোপন নিরাপত্তা সংস্থার মানুষদের পড়াশুনা ও প্রশিক্ষণেরও বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ফ্রান্সসহ উন্নত দেশগুলোতে।

আর বাংলাদেশের উঠতি বিত্তশালীরা টাকা—পয়সা ও সোনদানা রাখার জন্য ব্যাংকের উপর আস্থা রাখতে না পেরে নিজেরাই সিন্দুক কেনার ধুম তুলেছেন।

এর প্রধান কারণ একদিকে ব্যাংকে টাকা রাখার লোকসান ও নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে যাওয়া অন্যদিকে দুনীর্তির মাধ্যমে অর্জিত অর্থকে আইনের ভয়ে আড়াল করে রাখা। ঘুস, দুনীর্তি বেড়ে যাওয়ায় একশ্রেণির মানুষ অতি দ্রুত বিত্তশালী হয়ে পড়ায় তাদের অঢেল অবৈধ অর্থকে লুকিয়ে রাখার জন্য সিন্দুক কিনে ভরে রেখে মধ্যযুগীয় কায়দায় নিজেদেরকে দুনীর্তি খেকে আড়াল করার অপকৌশল শুরু করেছেন।

দেশীয় এনালগ পদ্ধতিতে তৈরী সিন্দুক কিনছেন বেশীরভাগ নিম্ন শ্রেণির কর্মজীবি মানুষ। মুদি দোকানদার, ছোট ব্যবসায়ী যারা দৈনিক কিছু টাকা আয় করেন এবং আগে ব্যাংকে দৈনিক জমা দিতেন তারা অনেকেই ব্যাংকের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। কারণ, সম্প্রতি ব্যাংগুলোতে সরকারী নির্দেশনায় নানা উপায়ে আমানতের টাকা অথবা লাভের টাকা কেটে নেয়া হয়ে থাকে। একজন চতুর্থ শ্রেণির চাকুরীজীবি বলেছেন, তার ব্যাংক হিসেবে গত নভেম্বর মাসে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা জমা ছিল। জানুয়ারীতে টাকা তুলতে গিয়ে দেখেন সেখানে উক্ত পরিমাণ অর্থ নেই। অনেকটা পাগল হয়ে কারণ খুঁজতে গিয়ে জানতে পারলেন তার অর্থ থেকে সরকারী ট্যাক্সসহ আরো নানা অফিসিয়াল খরচের ফর্দ দেখিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা কেটে নেয়া হয়েছে।

অথচ, তার ধারণা ছিল হয়তো ইতোমধ্যে আরো কিছু মুনাফা জমা হয়েছে। এছাড়া উক্ত পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে তার পরিবারের জন্য একমাসের খাবারের চাল কেনার কথা ছিল! তার কথা হলো— এমন অদ্ভুত নিয়মে করের ফাঁদে পড়লে নিম্ন আয়ের মানুষ কেন ব্যাংকের দ্বারে যাবেন?

ব্যাংকে যাদের কোটি কোটি টাকা থাকে তাদের হিসেবের মধ্যে দিন দিন মুনাফা বা সুদের পরিমাণও বাড়ে। সেখানকার মুনাফা থেকে করের টাকা কেটে নেবার পর আরো উদ্বৃত্ত অর্থ জমা থাকে। তাই তাদের গায়ে কর্তিত করের বোঝা আঘাত করে না। কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষ সেটা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছেন।

যাদের বৈধ ও প্রকৃত আয়ের সাথে ব্যায়ের কোন মিল নেই তারা সবাই দুনীর্তিবাজ তা বলা যাবে না। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই কিনছেন ডিজিটাল সিন্দুক। সন্দেহটা সেখান থেকে শুরু করা যায়। অথার্ৎ, বৈধ ও প্রকৃত আয়ের উৎস ছাড়া হঠাৎ ব্যায়ের বহর ও বেহিসেবী তৎপরতা দেখে ধরে নেয়া যায় তাদের আয় অবৈধ। এসব ডিজিটাল সিন্দুক দেশের তৈরী আবার বিদেশ থেকে আমদানী করা হচ্ছে। চীন, ভারত, থাইল্যান্ড থেকে আমদানী করা হচ্ছে সিন্দুক। তবে চীন থেকে আমদানী করা ডিজিটাল সিন্দুক হাল্কা ও দামে সস্তা হওয়ায় চীনের তৈরী সিন্দুকের ক্রেতা বেড়ে গেছে।

একটি এনালগ সিন্দুকের দাম পাঁচ হাজার থেকে একলক্ষ টাকা এবং একটি ডিজিটাল সিন্দুকের দাম পঞ্চাশ হাজার থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা। বলা হচ্ছে, যারা পাঁচলক্ষ টাকা দিয়ে ডিজিটাল সিন্দুক কিনছেন তারা সেটাতে কত পরিমাণ সম্পদ জমা করে রাখছেন সেটার হিসেব মেলানোর কোন মাপনী আমাদের জানা নেই।

বিশ্লেষকগণ বলছেন, দেশে নানা কারণে সিংহভাগ মানুষের আয় কমে গছে। পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যস্ফীতি অসহনীয় পযার্য়ে চলে গেছে। কিন্তু আশ্চয্যর্জনকভাবে গেল বছরগুলোতে কিছু মানুষের ব্যাপক আয় বেড়েছে। বৈধ উৎস ছাড়াই হঠাৎ আয় বেড়ে যাওয়া মানুষগুলোর অর্থের হিসেবে বেশ গরমিল রয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানে রুপন ভ্রাতৃদ্বয়ের বাড়িতে পাঁচটি টাকাভর্তি সিন্দুক পাওয়া গেছে। গত জাতীয় নিবার্চনের সময় প্রার্থীদের হলফনামায় সম্পদের গরমিলের তথ্য নিয়ে খোদ সরকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে উপর মহলের হস্তক্ষেপের ফলে সমালোচনা শোনা গেছে। নিবার্চন শেষ হলেও সেসব তথ্যের কোন আইনী ব্যবস্থা এখনও শুরুই হয়নি।

কয়েক বছর আগে থেকে বিদেশে অর্থ পাচারের মহরৎ শুরু হয়েছে। সিন্দুকে রাখা গচ্ছিত অর্থ অপ্রদর্শিত এবং কালো টাকা। এসব অপ্রদর্শিত টাকার হিসেব সরকারের খাতায় নেই। কারণ ঘুস—দুনীর্তির মাধ্যমে উপার্জিত অবৈধভাবে অর্জিত হয়েছে এসব টাকা। অপ্রদর্শিত অর্থ বিদেশে পাচার করতে সুবিধা। সিন্দুকের মধ্যে রাখা অপ্রদর্শিত অবৈধ অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কর প্রদানের ঝুঁকি নেই। তাই আইনের চোখে ফাঁকি দেয় অতি সহজ। আইনের চোখে ধরা পড়া এবং ব্যাংকের মুনাফা কেটে নেয়ার ভয়ে এক শ্রেণির দুনীর্তিবাজ কর্মকতার্র নেটওয়ার্কের সহায়তায় অবৈধ ভাগবাটোয়ারার অন্তড়ালে তৈরী হওয়া মুদ্রাপাচার এখন আমাদের দেশের একনম্বর অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে আবিভূর্ত হয়েছে। এই সমস্যা ধনী—দরিদ্রের মধ্যে চরম আয় বৈষম্য সৃষ্টি করে দৈনন্দিন খাদ্যবাজারকে অগ্নিমূল্যে রুপান্তরিত করে তুলেছে।

এছাড়া হঠাৎ সৃষ্ট অবৈধ ও লোভী বিত্তশালীদের কপটতার কব্জায় পড়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক দুনীর্তি, স্বজনপ্রীতি ও দলকানা রোগ ছড়িয়ে পড়ায় দেশের দরিদ্র পরিবারের উচ্চশিক্ষিত তরুণরা অসহনীয় বেকারত্বের জ্বালায় ভুগছে।

অন্যদিকে অখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ ব্যবসায়িক আদলে সনদ বিক্রিকরণের কারখানা হিসেবে গজিয়ে উঠায় উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে একটি চাকুরী কেনার জন্য দরকষাকষি করতে বহু প্রার্থী ভিড় করছে। তেমন ভিড়, ভোটের ক্ষেত্রে মনোনয়নলাভে ইচ্ছুক অসংখ্য বিত্তশালী প্রার্থীরাও করছে। চাকুরী কেনা—বেচার হাটের মতো ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। ঘরের সিন্দুকে রাখা গচ্ছিত দুনীর্তির অর্থের জোর যাদের বেশী তারাই এসব ক্ষেত্রে চাকুরী বাগিয়ে নেয়ার সুযাগ নিচ্ছে।

এসব ক্ষেত্রে নগদ অর্থ ব্যবহারের আস্থা বেশী, এতে ঝুঁকি কম তাই প্রচলন ও কদর বেশী। সিন্দুকে রাখা গচ্ছিত অপ্রদর্শিত অর্থের লেন—দেন করাটাও খুব সহজ।

আমাদের দেশে শত শত ব্যাংক ও হাজার হাজার তাদের শাখা—প্রশাখা। আমানতকারীরা সেগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার নানাবিধ কারণ আমাদের অর্থনীতির ডুবন্ত চরিত্রকে ভাবিয়ে তুলেছে। পত্রিকাটির তথ্য থেকে দেখা গেল, এত নামীদামী ব্যাংকিং সেবা থাকলেও অতিরিক্ত চাজ্জর্ কেটে নেয়ায় এটিএম কার্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ব্যাংকের আ্যাপস দিয়ে ঘরে বসে ডিজিটাল সেবাগুলো নিতে গিয়ে নেটওয়ার্ক জটিলতা, একজনের হিসেবে প্রেরিত টাকা অন্য গ্রাহকের হিসাবে চলে যাওয়া, সেটা উদ্ধার করতে গিয়ে দীর্ঘদিন, মাসপর্যন্ত সময় ক্ষেপণ ইত্যাদি চরম হয়রানি শুরু হয়েছে। ব্যাংক ছাড়াও অন্যান্য ডিজিটাল আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতেও গ্রাহক হয়রানীর সংখ্যা বাড়ছে।

একদিকে ব্যাংকের আমানতের লাভের উপর সরকারী হস্তক্ষেপের ফলে গ্রাহক করের বোঝাবৃদ্ধি, অন্যদিকে অপ্রদর্শিত আয়ের অর্থের মাধ্যমে অবৈধ ব্যবসা করে কর ফাঁকির দেয়া অপচেষ্টা সিন্দুক কেনা—বেচার ব্যবসাকে চাঙ্গা করে তুলছে। অপ্রদর্শিত টাকা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সিন্দুক কেনা—বেচার উপর নিয়ন্ত্রণ ও সিন্দুক ব্যবহারকারীদের উপর লাইসেন্স সিস্টেম চালু করতে হবে। দুনীর্তিবাজ, চোর—ডাকাত, ঘুসখোর আমলা, ও করফাঁকিবাজ ব্যবসায়ীরা ভয়ে বাসা বাড়িতে সিন্দুক কিনে ব্যবহার শুরু করেছেন। এজন্য ব্যাংকের নগদ অর্থপ্রবাহ কমে গেছে। দেশে গত দশ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে সিন্দুক বিক্রি।

এভাবে বসতবাড়িতে ব্যবহারের জন্য সিন্দুক বিক্রি বেড়ে যাওয়া অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। আধুনিক ডিজিটালযুগের সেবা এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই—এর মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নেবার অত্যাধুনিক প্রচেষ্টা ছেড়ে মানুষ কেন মধ্যযুগীয় পদ্ধতিতে চলে যাচ্ছে সেটা অর্থনীতিবিদগণকে ভাবিয়ে তুলছে। এটা আর্থ—সামজিক উন্নতির লক্ষণ নয়—বরং সম্পদ গোপন করে কর ফাঁকি দেয়া আর্থ—সামজিক ও পারিবেশিক ভাঙ্গন ধরার স্থানীয় ও বৈশ্বিক চোর চক্রান্তের ভয়াবহ সংমিশ্রণ।

 

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীনE-mail: [email protected]

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম

 

জানুয়ারী ২৩, ২০২৪ তারিখে একটি ছাপানো বাংলা দৈনিক পত্রিকার বড় শিরোনাম হলো দেশে ‘সিন্দুকের বিক্রি বেড়েছে’। এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে টাকা—পয়সা, সোনা—হীরা—মুক্তা ইত্যাদি রাখার জন্য সিন্দুক কেনার ধুম পড়েছে দেশে। শুধু এনালগ বা লোহার তালা—চাবিমারা আদিকালের সিন্দুক নয়। তারা ডিজিটাল ও বায়োমেট্রিক নিরাপত্তাসংযুক্ত সিন্দুকও কিনছেন।

আদিযুগে সাদ্দাদ—কারুনদের সোনা—রুপা মণি—জহরৎ রাখার হাজারো সিন্দুকের চাবি বহন করতো ভারবাহী সুঠামদেহী গাধারা। শতাধিক গাধার পিঠে সেসব তালাচাবির বস্তা বহন করার কাহিনী গল্পকথায় পড়েছি, শুনেছি। সেই যুগ অতীত হয়ে মধ্যযুগের মানুষ চোর ডাকাতের ভয়ে মাটি বা পিতলের কলসীতে ভরে গোপনে মাটির নিচে পুঁতে রাখতো। আবার কেউ কেউ ঘরের মধ্যে মোটা কাঠ অথবা লোহা দিয়ে বড় বড় খোলওয়ালা খাট—পালঙ্ক তৈরী করে তার ভেতরে টাকা—কড়ি, স্বর্ণমুদ্রা ভরে তালাচাবি মেরে রাতে উপরে শুয়ে ঘুমাতো। কারণ তারা ছিল লুটেরা ও কৃপণ। সেসময় তরবারী, বন্দুক ও পেশীর ভয় দেখিয়ে মানুষ কতল করে সম্পদ লুট করে নিজেরা ভোগদখল করতো। এর অনেকদিন পর ব্যাংকে টাকা—সম্পদ রাখার বিধান তৈরী হওয়ায় সম্পদশালীরা হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। কিন্তু সেই এনালগ তালাচাবির যুগও একবারে শেষ হয়ে যায়নি।

এখন ডিজিটাল যুগের ছোঁয়ায় কার্ডের মাধ্যমে সাংখ্যিক পদ্ধতির তালাচাবির ব্যবহার বেড়ে গেছে। আজকাল আংকিক সংখ্যাকেও বশ করতে পটু এক ধরনের ডিজিটাল চোর বা হ্যাকাররা। তারা পাসওয়ার্ড চুরি বা উদ্ধার করে নকল কার্ড তৈরী করে ডিজিটাল ডাকাতি করা শুরু করেছে অতি সংগোপনে।

এরপর বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে হাতের আঙ্গুলের ছোঁয়ায় তালা খোলার পদ্ধতি চালু হবার কয়েক বছরের মধ্যে সেখানেও বেড়েছে বিপত্তি। তাই চালু করা হয়েছে অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে মুখের অবয়ব, পরিচিত কন্ঠের গোপন কমান্ড, আপন চোখের মণির ইশারা ইত্যাদি নানা কৌশলে তালাচাবি ব্যবহার করার প্রবণতা। শুরু হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই—এর মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাদানের প্রচেষ্টা। তবুও নিস্তার নেই।

সব ধরণের ডিজিটাল ও বায়োলজিক্যাল নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে উভয়বিধ হ্যাকারদের স্কুল খোলা হয়েছে কোন কোন দেশে। এসব বিষয় এখন বিভিন্ন গোপন নিরাপত্তা সংস্থার মানুষদের পড়াশুনা ও প্রশিক্ষণেরও বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ফ্রান্সসহ উন্নত দেশগুলোতে।

আর বাংলাদেশের উঠতি বিত্তশালীরা টাকা—পয়সা ও সোনদানা রাখার জন্য ব্যাংকের উপর আস্থা রাখতে না পেরে নিজেরাই সিন্দুক কেনার ধুম তুলেছেন।

এর প্রধান কারণ একদিকে ব্যাংকে টাকা রাখার লোকসান ও নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে যাওয়া অন্যদিকে দুনীর্তির মাধ্যমে অর্জিত অর্থকে আইনের ভয়ে আড়াল করে রাখা। ঘুস, দুনীর্তি বেড়ে যাওয়ায় একশ্রেণির মানুষ অতি দ্রুত বিত্তশালী হয়ে পড়ায় তাদের অঢেল অবৈধ অর্থকে লুকিয়ে রাখার জন্য সিন্দুক কিনে ভরে রেখে মধ্যযুগীয় কায়দায় নিজেদেরকে দুনীর্তি খেকে আড়াল করার অপকৌশল শুরু করেছেন।

দেশীয় এনালগ পদ্ধতিতে তৈরী সিন্দুক কিনছেন বেশীরভাগ নিম্ন শ্রেণির কর্মজীবি মানুষ। মুদি দোকানদার, ছোট ব্যবসায়ী যারা দৈনিক কিছু টাকা আয় করেন এবং আগে ব্যাংকে দৈনিক জমা দিতেন তারা অনেকেই ব্যাংকের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। কারণ, সম্প্রতি ব্যাংগুলোতে সরকারী নির্দেশনায় নানা উপায়ে আমানতের টাকা অথবা লাভের টাকা কেটে নেয়া হয়ে থাকে। একজন চতুর্থ শ্রেণির চাকুরীজীবি বলেছেন, তার ব্যাংক হিসেবে গত নভেম্বর মাসে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা জমা ছিল। জানুয়ারীতে টাকা তুলতে গিয়ে দেখেন সেখানে উক্ত পরিমাণ অর্থ নেই। অনেকটা পাগল হয়ে কারণ খুঁজতে গিয়ে জানতে পারলেন তার অর্থ থেকে সরকারী ট্যাক্সসহ আরো নানা অফিসিয়াল খরচের ফর্দ দেখিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা কেটে নেয়া হয়েছে।

অথচ, তার ধারণা ছিল হয়তো ইতোমধ্যে আরো কিছু মুনাফা জমা হয়েছে। এছাড়া উক্ত পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে তার পরিবারের জন্য একমাসের খাবারের চাল কেনার কথা ছিল! তার কথা হলো— এমন অদ্ভুত নিয়মে করের ফাঁদে পড়লে নিম্ন আয়ের মানুষ কেন ব্যাংকের দ্বারে যাবেন?

ব্যাংকে যাদের কোটি কোটি টাকা থাকে তাদের হিসেবের মধ্যে দিন দিন মুনাফা বা সুদের পরিমাণও বাড়ে। সেখানকার মুনাফা থেকে করের টাকা কেটে নেবার পর আরো উদ্বৃত্ত অর্থ জমা থাকে। তাই তাদের গায়ে কর্তিত করের বোঝা আঘাত করে না। কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষ সেটা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছেন।

যাদের বৈধ ও প্রকৃত আয়ের সাথে ব্যায়ের কোন মিল নেই তারা সবাই দুনীর্তিবাজ তা বলা যাবে না। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই কিনছেন ডিজিটাল সিন্দুক। সন্দেহটা সেখান থেকে শুরু করা যায়। অথার্ৎ, বৈধ ও প্রকৃত আয়ের উৎস ছাড়া হঠাৎ ব্যায়ের বহর ও বেহিসেবী তৎপরতা দেখে ধরে নেয়া যায় তাদের আয় অবৈধ। এসব ডিজিটাল সিন্দুক দেশের তৈরী আবার বিদেশ থেকে আমদানী করা হচ্ছে। চীন, ভারত, থাইল্যান্ড থেকে আমদানী করা হচ্ছে সিন্দুক। তবে চীন থেকে আমদানী করা ডিজিটাল সিন্দুক হাল্কা ও দামে সস্তা হওয়ায় চীনের তৈরী সিন্দুকের ক্রেতা বেড়ে গেছে।

একটি এনালগ সিন্দুকের দাম পাঁচ হাজার থেকে একলক্ষ টাকা এবং একটি ডিজিটাল সিন্দুকের দাম পঞ্চাশ হাজার থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা। বলা হচ্ছে, যারা পাঁচলক্ষ টাকা দিয়ে ডিজিটাল সিন্দুক কিনছেন তারা সেটাতে কত পরিমাণ সম্পদ জমা করে রাখছেন সেটার হিসেব মেলানোর কোন মাপনী আমাদের জানা নেই।

বিশ্লেষকগণ বলছেন, দেশে নানা কারণে সিংহভাগ মানুষের আয় কমে গছে। পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যস্ফীতি অসহনীয় পযার্য়ে চলে গেছে। কিন্তু আশ্চয্যর্জনকভাবে গেল বছরগুলোতে কিছু মানুষের ব্যাপক আয় বেড়েছে। বৈধ উৎস ছাড়াই হঠাৎ আয় বেড়ে যাওয়া মানুষগুলোর অর্থের হিসেবে বেশ গরমিল রয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানে রুপন ভ্রাতৃদ্বয়ের বাড়িতে পাঁচটি টাকাভর্তি সিন্দুক পাওয়া গেছে। গত জাতীয় নিবার্চনের সময় প্রার্থীদের হলফনামায় সম্পদের গরমিলের তথ্য নিয়ে খোদ সরকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে উপর মহলের হস্তক্ষেপের ফলে সমালোচনা শোনা গেছে। নিবার্চন শেষ হলেও সেসব তথ্যের কোন আইনী ব্যবস্থা এখনও শুরুই হয়নি।

কয়েক বছর আগে থেকে বিদেশে অর্থ পাচারের মহরৎ শুরু হয়েছে। সিন্দুকে রাখা গচ্ছিত অর্থ অপ্রদর্শিত এবং কালো টাকা। এসব অপ্রদর্শিত টাকার হিসেব সরকারের খাতায় নেই। কারণ ঘুস—দুনীর্তির মাধ্যমে উপার্জিত অবৈধভাবে অর্জিত হয়েছে এসব টাকা। অপ্রদর্শিত অর্থ বিদেশে পাচার করতে সুবিধা। সিন্দুকের মধ্যে রাখা অপ্রদর্শিত অবৈধ অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কর প্রদানের ঝুঁকি নেই। তাই আইনের চোখে ফাঁকি দেয় অতি সহজ। আইনের চোখে ধরা পড়া এবং ব্যাংকের মুনাফা কেটে নেয়ার ভয়ে এক শ্রেণির দুনীর্তিবাজ কর্মকতার্র নেটওয়ার্কের সহায়তায় অবৈধ ভাগবাটোয়ারার অন্তড়ালে তৈরী হওয়া মুদ্রাপাচার এখন আমাদের দেশের একনম্বর অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে আবিভূর্ত হয়েছে। এই সমস্যা ধনী—দরিদ্রের মধ্যে চরম আয় বৈষম্য সৃষ্টি করে দৈনন্দিন খাদ্যবাজারকে অগ্নিমূল্যে রুপান্তরিত করে তুলেছে।

এছাড়া হঠাৎ সৃষ্ট অবৈধ ও লোভী বিত্তশালীদের কপটতার কব্জায় পড়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক দুনীর্তি, স্বজনপ্রীতি ও দলকানা রোগ ছড়িয়ে পড়ায় দেশের দরিদ্র পরিবারের উচ্চশিক্ষিত তরুণরা অসহনীয় বেকারত্বের জ্বালায় ভুগছে।

অন্যদিকে অখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ ব্যবসায়িক আদলে সনদ বিক্রিকরণের কারখানা হিসেবে গজিয়ে উঠায় উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে একটি চাকুরী কেনার জন্য দরকষাকষি করতে বহু প্রার্থী ভিড় করছে। তেমন ভিড়, ভোটের ক্ষেত্রে মনোনয়নলাভে ইচ্ছুক অসংখ্য বিত্তশালী প্রার্থীরাও করছে। চাকুরী কেনা—বেচার হাটের মতো ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। ঘরের সিন্দুকে রাখা গচ্ছিত দুনীর্তির অর্থের জোর যাদের বেশী তারাই এসব ক্ষেত্রে চাকুরী বাগিয়ে নেয়ার সুযাগ নিচ্ছে।

এসব ক্ষেত্রে নগদ অর্থ ব্যবহারের আস্থা বেশী, এতে ঝুঁকি কম তাই প্রচলন ও কদর বেশী। সিন্দুকে রাখা গচ্ছিত অপ্রদর্শিত অর্থের লেন—দেন করাটাও খুব সহজ।

আমাদের দেশে শত শত ব্যাংক ও হাজার হাজার তাদের শাখা—প্রশাখা। আমানতকারীরা সেগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার নানাবিধ কারণ আমাদের অর্থনীতির ডুবন্ত চরিত্রকে ভাবিয়ে তুলেছে। পত্রিকাটির তথ্য থেকে দেখা গেল, এত নামীদামী ব্যাংকিং সেবা থাকলেও অতিরিক্ত চাজ্জর্ কেটে নেয়ায় এটিএম কার্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ব্যাংকের আ্যাপস দিয়ে ঘরে বসে ডিজিটাল সেবাগুলো নিতে গিয়ে নেটওয়ার্ক জটিলতা, একজনের হিসেবে প্রেরিত টাকা অন্য গ্রাহকের হিসাবে চলে যাওয়া, সেটা উদ্ধার করতে গিয়ে দীর্ঘদিন, মাসপর্যন্ত সময় ক্ষেপণ ইত্যাদি চরম হয়রানি শুরু হয়েছে। ব্যাংক ছাড়াও অন্যান্য ডিজিটাল আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতেও গ্রাহক হয়রানীর সংখ্যা বাড়ছে।

একদিকে ব্যাংকের আমানতের লাভের উপর সরকারী হস্তক্ষেপের ফলে গ্রাহক করের বোঝাবৃদ্ধি, অন্যদিকে অপ্রদর্শিত আয়ের অর্থের মাধ্যমে অবৈধ ব্যবসা করে কর ফাঁকির দেয়া অপচেষ্টা সিন্দুক কেনা—বেচার ব্যবসাকে চাঙ্গা করে তুলছে। অপ্রদর্শিত টাকা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সিন্দুক কেনা—বেচার উপর নিয়ন্ত্রণ ও সিন্দুক ব্যবহারকারীদের উপর লাইসেন্স সিস্টেম চালু করতে হবে। দুনীর্তিবাজ, চোর—ডাকাত, ঘুসখোর আমলা, ও করফাঁকিবাজ ব্যবসায়ীরা ভয়ে বাসা বাড়িতে সিন্দুক কিনে ব্যবহার শুরু করেছেন। এজন্য ব্যাংকের নগদ অর্থপ্রবাহ কমে গেছে। দেশে গত দশ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে সিন্দুক বিক্রি।

এভাবে বসতবাড়িতে ব্যবহারের জন্য সিন্দুক বিক্রি বেড়ে যাওয়া অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। আধুনিক ডিজিটালযুগের সেবা এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই—এর মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নেবার অত্যাধুনিক প্রচেষ্টা ছেড়ে মানুষ কেন মধ্যযুগীয় পদ্ধতিতে চলে যাচ্ছে সেটা অর্থনীতিবিদগণকে ভাবিয়ে তুলছে। এটা আর্থ—সামজিক উন্নতির লক্ষণ নয়—বরং সম্পদ গোপন করে কর ফাঁকি দেয়া আর্থ—সামজিক ও পারিবেশিক ভাঙ্গন ধরার স্থানীয় ও বৈশ্বিক চোর চক্রান্তের ভয়াবহ সংমিশ্রণ।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীনE-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.