শুক্রবার | ২২ নভেম্বর, ২০২৪ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১

একুশে বই মেলা: পৃথিবীর সবচে’দীর্ঘসময়ী বই মহৎসব !

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম

যতদুর জানা যায়, এ পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে যতগুলো বইমেলা আয়োজিত হয়েছে তার মধ্যে আকারে সবচে’ বড় হলো ফ্রাঙ্কফ্রুট বইমেলা। এটা জার্মানীতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যেখানে বিশ্বের ৭৭টি দেশের ৬,১৬৯ টি প্রকাশক প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছিল। সেটা ছিল ১০-১৪ অক্টোবর, ২০১৭। কিন্তু ফ্রাঙ্কফ্রুট বইমেলা মাত্র পাঁচ দিন ব্যাপী স্থায়ী হয়।

বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত একুশে বই মেলাও অনেক বড়। গত বছর থেকে মেলার আকার বেড়ে বাংলা একাডেমী চত্ত¡র পেরিয়ে সোহরাওয়ার্দ্দী উদ্যানে বইয়ের স্টল তৈরীর অনুমতি দিতে হয়েছে। তবুও আকারে অনেক দেশের বই মেলার চেয়ে একুশে মেলা এখনও ছোট। কিন্তু সময়ের বিচারে আমাদের একুশে মেলাকে পৃথিবীর কোন দেশের বই মেলা আজ পর্যন্ত আমাদেরকে ছোট করতে পারেনি। মাতৃভাষার ওপর লেখা বই নিয়ে মাসব্যাপী বা এত দীর্ঘ সময়ব্যাপী ঘটা বইমেলা পৃথিবীর আর কোন দেশে হতে দেখা যায় না! এই দীর্ঘমেয়াদী বইমেলা আমাদের একান্ত অর্জন।  এই বইমেলা আমাদের সবার গৌরবের বিষয়!

আসুন, সারা পৃথিবীতে প্রতিবছর যতগুলো বইমেলা আয়োজিত হয়ে থাকে সেগুলোর প্রধান কয়েকটি থেকে অনুষ্ঠানের দিন-সময়ের কিছু তথ্য জেনে নিই।

বইমেলার নাম

দেশের নামপ্রতিবছর অনুষ্ঠানের তারিখমোট দিনের সংখ্যা
আস্তানা বুক ফেয়ারকাজাখাস্তান২৫ এপ্রিল- ০১ মে০৭ দিন
আলেকজান্দ্রিয়া বুক ফেয়ারমিশরমার্চ ২২- এপ্রিল ০৪১৪ দিন
ইস্তাম্বুল বুক ফেয়ারতুরস্কনভেম্বর ১০- নভেম্বর ১৮০৯ দিন
একুশে বই মেলাবাংলাদেশফেব্রুয়ারী ০১-ফেব্রুয়ারী ২৯+এক মাস + ৪/৭ দিন
কোলকাতা বই মেলাভারতজানুয়ারী ৩০- ফেব্রুয়ারী ১৩১৪ দিন
ক্যাসাবøাঙ্কা বুক ফেয়ারমরক্কোফেব্রুয়ারী০৮- ফেব্রুয়ারী ১৮১০ দিন
ব্রাসেলস বুক ফেয়ারবেলজিয়ামফেব্রুয়ারী ২২- ফেব্রুয়ারী ২৫০৪ দিন
বোলোগনা বুক ফেয়ারইটালীমার্চ ২৬- মার্চ ২৯০৪ দিন
ব্যাঙ্কক বুক ফেয়ারথাইল্যান্ডমার্চ ২৬- এপ্রিল ০৯১৫ দিন
বøাডি স্কটল্যান্ড  বুক ফেয়ারইউ.কে.সেপ্টেম্বর ২১- সেপ্টেম্বর ২৩০৩ দিন
পার্থ বুক ফেয়ারঅস্ট্রেলিয়াফেব্রুয়ারী ০৯- মার্চ ০৪২০ দিন
ভিয়েনা বুক ফেয়ারঅস্ট্রিয়ানভেম্বর ০৭- নভেম্বর ১১০৫ দিন
ডি লা বান্দে ডেসিনে এঙ্গোলিমফ্রান্সজানুয়ারী ২৫- জানুয়ারী ২৮০৪ দিন
নয়া দিল্লী বুক ফেয়ারভারতজানুয়ারী ০৬- জানুয়ারী ১৪০৯ দিন
জেনেভা বুক এন্ড প্রেস ফেয়ারসুইজারল্যান্ডএপ্রিল ২৫- এপ্রিল ২৯০৫ দিন
টোকিও বুক ফেয়ারজাপানজানুয়ারী ২৪- জানুয়ারী ২৯০৬ দিন
হংকং বুক ফেয়ারহংকং (চীন)জুলাই ১৮- জুলাই ২৪০৭ দিন
তাইপে বুক ফেয়ারতাইওয়ানফেব্রুয়ারী ০৬- ফেব্রুয়ারী ১১০৬ দিন
লাহোর বুক ফেয়ারপাকিস্তানফেব্রুয়ারী ২২- ফেব্রুয়ারী ২৫০৪ দিন
লাটভিয়া বুক ফেয়ারলাটভিয়াফেব্রুয়ারী ২৩- ফেব্রুয়ারী ২৫০৩ দিন

সূত্র:  ইন্টারনেট

উল্লিখিত সারা বিশ্বের প্রধান কয়েকটি বইমেলা অনুষ্ঠানের দিন-সময়ের কিছু তথ্য থেকে জানা যায় কেউই কুড়ি দিনের বেশী বইমেলা চালাতে পারেননি। অথচ, বংলাদেশ একমাসের অধিক সময়ব্যাপী বইমেলার আয়োজন করে সেটা দেখাতে পেরেছে।

বাংলাদেশে ঢাকায় অনুষ্ঠিত একুশে বই মেলা দীর্ঘদিনব্যাপী জনপ্রিয়তার মধ্যে চলতে থাকার কারন নানামুখী। আমাদের ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারী শুরু হয় বই মেলার উদ্বোধনী দিয়ে। বাংলা ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, তাঁদের অমূল্য ত্যাগ-তিতিক্ষার স্মরণ ও বাংলা ভাষার প্রতি ভালবাসার চিরন্তন বহি:প্রকাশ ঘটে একুশে বই মেলার মাধ্যমে। বাঙালীর বইয়ের প্রতি প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও বই পড়ার প্রতি আগ্রহ ও ভালবাসা থেকে ফিবছর দিন গুনতে থাকে- কবে শুরু হবে একুশে বইমেলা। বইমেলায় সবাই শুধু একদিন ঢুঁ মেরেই ক্ষান্ত দেন না বরং এই এক মাসের মধ্যে একই ব্যক্তি বহুবার মেলায় যান। বই মেলায় যাওয়া নেশায় পরিণত হয়। বইমেলায় সবাই শধু নিজের জন্যে বই কেনেন না। কেউ তাকিয়ে তাকিয়ে সাজানো বই দেখেন, কেউ বক্তৃতা শোনেন, লেখক কুঞ্জে আড্ডা দেন, রক্ত দান করেন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শোনেন, পাঠক-দর্শকদের সাথে মত বিনিময় করেন, কেউ বই কিনে প্রিয়জনদের উপহার দেন। বই মেলায় সব বয়সী মানুষের চাহিদা উপযোগী বই কিনতে পাওয়া যায়।

এছাড়া বই মেলা সবার অজান্তেই মানুষের মহা-মিলন মেলায় পরিণত হয়। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষার্থী সবাই একত্রে ভিড় জমান বই মেলায়। কঁচি-কাঁচারা বায়না ধরে- মেলা থেকে তাকে কি কি বই কিনে উপহার দিতে হবে সেটা নিয়ে। এতে বই মেলার পারিবারিক ও সামাজিক মূল্য বহুগুনে বেড়ে চলেছে।

বই কেনা হলো সবচে’ ভাল কেনাকাটা। এর জন্য রাখা বাজেট-বরাদ্দ সবচে’ দামী বাজেট। কারন, গুণীজন বলে গেছেন, বই কিনে কেই কখনও দেউলিয়া হয়না! তাইতো স্বল্প আয়ের দেশের মানুষ হয়েও আমরা একুশে বই মেলায় প্রায় প্রতিদিন যাই, ভীড় করি, বইয়ের দোকানে তাকিয়ে দেখি, বই কিনি, নিজে পড়ি বা কিনে অন্যকে উপহার দিই। আজ পর্যন্ত সব সমাজেই বই উপহার দেয়াটাই সর্বত্তোম উপহার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

বই যে কোন রুচিশীল মানুষের গৃহের সবচে’ দামী আসবাব হিসেবে বিবেচিত। অনেকে বই পড়তে পছন্দ না করলেও দামী বই কিনে ঘরের শেলফে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। কারন বই থাকাটা তার কাছে মর্যাদা ও রুচি বোধের পরিচায়ক।

একুশে বই মেলাকে উপলক্ষ্য করে একজন লেখক মনযোগ দিয়ে নিয়মিত বই লিখেন, অনেক প্রুফ সংশোধনীর পর প্রকাশক যতœ করে প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন। লেখকের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, দক্ষতা, মননশীলতা ও লেখণীর সৌকর্য শেষে প্রচ্ছদকারীর নকশা পেরিয়ে ছাপানো হয় কাঙ্খিত বই। প্রতিবছর ফেব্রæয়ারী মাস শুরু হলেই শুরু হয় আমাদের প্রাণের বই মেলা- যা একুশে বই মেলা নামে পরিচিত। আজ এই বই মেলা পৃথিবীর সবচে’ দীর্ঘদিনব্যাপী ঘটা মহা বই উৎসব।

বর্তমানে নোটকেন্দ্রিক পড়াশোনা ও এম.সি.কিউ পরীক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের কল্পনাশক্তি জাগায় না। বই পড়া মানুষের কল্পনাশক্তি শানিত করে এবং মানুষ ভবিষৎ নিয়ে বেশী চিন্তা করে সুপথে চলতে পারে। প্রযুক্তি বিকাশের এযুগে মানুষ পড়তে ভুলে যাচ্ছে- শুধু মনিটরে একনজর দেখেই ক্ষান্ত দেয়। অধুনা- টিভি, কম্পিউটার, বিলবোর্ড, সেলফোন, ট্যাব, আইপ্যাড, ক্লাশরুমের পাওয়ার পয়েন্টের ঢাউস স্ক্রিন সব জায়গায় শুধু দেখার সুবিধা তৈরী করে দেয়া হয়েছে। বর্তমান যুগ- শুধু চেয়ে চেয়ে দেখার যুগ। প্রতিদিন প্রতিটি মুহুর্তে এত বেশী দেখার জিনিষ আমাদের সামনে ভেসে ওঠে যে আমরা সবসময় দেখার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে বই মেলা আমাদের জন্য প্রতিবছর দেখার একঘেয়েমি থেকে মনযোগ দিয়ে পড়ার জন্য বিরাট সুযোগ  এনে দেয়- যা আমাদের কল্পনাজগৎকে প্রসারিত করে ভবিষ্যতে ভালভাবে বেঁচে থাকতে শেখায়।

বইমেলার ফলে ছাপানো বই বেড়েছে। কিন্তু প্রতিবছর পাঠকরা বলেন- বইগুলোর মান বাড়েনি। বইগুলোর অর্ন্তনিহিত বিষয়বস্তু কী? ছাপার কাগজ কেমন? শেষের দিকে এসে বইমেলায় নোট বই ও বিদেশী নকল ও ফটোকপিকৃত বই ভরে সয়লাব হয়ে যায়। দেশের প্রকাশকদের কল্যাণে এদিকটাতে কঠোরভাবে নজর দেয়া উচিত। অন্যদিকে একুশে বইমেলা উপলক্ষ্যে শুধু ব্যবসা নয়- পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধি করা চাই। প্রকাশকদের কল্যাণে তাঁদের নিজেদেরকে বইয়ের পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধির প্রকল্প হাতে নেয়া জরুরী। এবছর ২০২৪ সালে বইয়ের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মেলায় আগত ক্রেতাদের মধ্যে বেশ অসন্তোষ দেখা গেছে। তারা কাগজের বইয়ের পরিবর্তে সস্তায় পড়া যায় এমন ই-ভার্সন খুঁজছেন।

কাগজের বইয়ের প্রয়োজন সব সময় থাকবে। যতই  এআই লিখন-পঠণ, ই-বুক ও ডিজিটাল সামগ্রীর শিক্ষা উপকরণ চালু করা হোক না কেন কাগজে ছাপার অক্ষরের কোন বিকল্প নেই। কারণ, দিনের বেলায় কাগজের বই পড়তে আলাদা এনার্জি বা জ্বালানীর দরকার হয় না। যুদ্ধের প্রভাবে পৃথিবীতে কোনদিন জ্বালানীর অভাব হলেও মানুষ কাগজে ছাপানো এনালগ বই পড়বে।

আজকাল সবজায়গা থেকে আসল বাংলা হারিয়ে যাচ্ছে। টেলিভিশন তথা অনেক গণমাধ্যমে বিকৃত বাংলা বলা হয়। অনেকে ভালভাবে বাংলা উচ্চারণ করতে না পেরে তা ঢাকতে গিয়ে ভুল ইংরেজী দিয়ে ধাপ্পা দিয়ে বিকৃত ও উদ্ভটভাবে বাংলা কথা বলার চেষ্টা করেন। টেলিভিশন কর্তৃপক্ষগুলোকে এ ব্যাপারে দ্রুত সচতেন হওয়া বেশ জরুরী। আসলে যারা মাতৃভাষা ভালভাবে জানেন ও বলতে পারেন তারা সহজেই যে কোন বিদেশী ভাষাতেও কথা বলা শিখে ফেলতে পারেন। যার মাতৃভাষায় দুর্বলতা ও ভুল আছে তিনি বিদেশী ভাষাতেও লিখতে পড়তে গিয়ে ভুল করবেন- এটাই স্বাভাবিক। তাই প্রতিটি মানুষের ভাষার ভিত্তি হওয়া উচিত তার মাতৃভাষা।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.