শনিবার | ২৩ নভেম্বর, ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১

দেরীতে কামান দাগা ও ‘রং ট্রিগার’-এর প্রভাব

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম

সরকারী চাকুরীতে কোটা সংস্কার নিয়ে ১ জুলাই ২০২৪ ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসমাবেশ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়ে প্রথম প্রতিবাদ শুরু হয়। এক সপ্তাহ না পেরুতেই এর সমর্থন ও জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে যায়। কিন্তু জুলাই ১৬ তারিখ পর্যন্ত কোমলমতি শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে তেমন কোন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। রংপুরে বেরোবি-র একজন ছাত্রকে একা পেয়ে কাপুরুষের মতো খুব কাছে থেকে বুলেট বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে। এটাই ছিল প্রথম রং ট্রিগার। এরপরও ক্রমাগত দম্ভ, উপেক্ষা, অবহেলার মাধ্যমে কালক্ষেপণ করায় এটা ভিন্নদিকে গড়িয়ে গেছে। তার উপর বিভিন্নভাবে তকমা দিয়ে টিজিং, বুলিং করে এটাকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি দেখে কর্তৃপক্ষের যখন সম্বিত ফিরে এলো-ততক্ষণে ‘রোম পুড়তে শুরু করেছে।’ একটি হঠকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে হঠাৎ একযোগে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠন বন্ধ ঘোষণা ও আবাসিক হলগুলো খালি করে দিলে শিক্ষার্থীরা বজ্রাঘাতের মতো দিশেহারা হয়ে তাদের থাকার জায়গা অন্বেষণের জন্য হন্যে হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। যে যেখানে পারে সেখানে ঠাঁই নিতে উৎকন্ঠিত হয়ে উঠে। সেসময় রাজধানী ঢাকার আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিত বন্ধু বান্ধবদের বাসায়, মেসে, সস্তা হোটেলে তারা ঠাঁই নেয়। সেখানে পর্যাপ্ত খাদ্য, পানীয়, শৌচাগার ও ঘুমানোর জায়গার অভাবে বিষিয়ে উঠে তাদের মন। সেখানে অবস্থান করে তারা আরো সংগঠিত হয়ে পরেরদিন ভয়ংকর হয়ে উঠে।

এদিকে মওকা বুঝে তাদের সাথে যোগ দেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্যরা। কর্তৃপক্ষ তাদের শক্তির ভারকী প্রদর্শণের জন্য তাদের বিপক্ষে আরো হার্ড লাইনে যাবার ঘোষণা দিলে দেশের সিংহভাগ জনগণ আরো উত্তেজিত হয়ে একসংগে রাস্তায় নেমে পড়ে। দিকে দিকে খর্ব হয়ে যায় তাদেরকে ঠেকানোর শক্তি। এই আন্দোলন ঠেকানোর জন্য নেতাদের ‘ছাত্রলীগ একাই যথেষ্ট’বলে যে উন্নসিকতা ও দম্ভ দেখানো হয়েছিল তা বাস্তবে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তারা ঠেকাতে পারলে হয়তো এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের গতি আরো ভয়াবহ ও মারমুখি হয়ে উঠলে জুলাই ১৭, ১৮ তারিখে দেশের রাস্তা-ঘাট অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবকিছু অচল হয়ে পড়লে আন্দোলনকারীদের সাথে পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব, আনসার ও ছাত্রলীগ ঢাকার রাজপথে ও সারা দেশের অলিতে গলিতে একযোগে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া মারামারি শুরু করলে চরম বিশৃংখলা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

জুলাই ১৯ তারিখে আন্দোলনের গতি আরো বেপরোয়া হয়ে পুড়তে থাকে বিটিভি ভবন, টোলবক্স, পুলিশ বক্স, সেতু ভবন ইত্যাদি। সারা দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে আগুন জ্বলে উঠে। আইন ও আধাসামরিক বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে আন্দোলন ঠেকাতে মরিয়া হয়েও অপর্যাপত প্রতীয়মান হয়ে উঠলে সান্ধ্যআইন জারি করা হয। জুলাই ১৯ তারিখ মধ্যরাতে মাঠে নামানো হয় সেনাবাহিনীকে।

এরপর থেকে দেশে সান্ধ্যআইন চলছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। তবে সান্ধ্য আইনের মধ্যেও বিভিন্ন জায়গায় মারামারি ও থানায় আক্রমণ চলছে। জুলাই ২১ তারিখে সান্ধ্যআইন জারির ভেতরেই সরকারীভাবে উচ্চ আদালতের মাধ্যমে কোটা সম্পর্কিত ২০১৮ সালে পরিপত্র ফিরে আনার আবেদন করা হয়েছে।

তবে ইতোমধ্যে সারা দেশে ইন্টারনেট ও ফোরজি মোবাইল সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় দেশে অর্থনীতির গতি শতভাগ অচল হয়ে পড়েছে। সফট্ওয়্যার তৈরী খাতে দৈনিক ৮০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। দেশীয় ও বৈদেশিক আমদানী-রপ্তানী, বিমান, সমুদ্রজাহাজ, ট্রেন, বাস, এটিএম সবকিছুর সেবা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। ফ্লাইট বন্ধ থাকায়, যাত্রা বাতিল করায় এবং ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় অনেক প্রবাসী শ্রমিক তাদের চাকুরী হারিয়ে ফেলেছেন বলে বিমান বন্দরের বারান্দায় শুয়ে বিষন্ন হয়ে করে কেঁদেছেন।

এরপরে সান্ধ্যআইন চলাকালীণ আরো দুই দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করায় খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে চরম দুর্গতি নেমে এসেছে। সান্ধ্যআইনের কারণে সাধারণ কর্মজীবি মানুষ ভয়ে ঘর থেকে বাইরে বের না হওয়ায় যাত্রীর অভাবে দিনমজুর ও রিক্সাওয়ালারা বিপাকে পড়েছেন। মাত্র দুই ঘন্টার জন্য সান্ধ্য আইন শিথীল থাকার সময় সবাই একসংগে কাঁচা বাজারে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। নিত্যপণ্যের বাজারে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় পণ্য ঘাটতি থাকায় দাম বেড়েছে বহুগুণ। এর কুফল স্বরুপ মানুষ আরো বেশী হতাশ হয়ে পড়ছেন।

আমাদের কোটা আন্দোলনকারী কোমলমতি বাচ্চারা দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক বা তথ্যভান্ডারে কেন আগুন দিতে যাবে? কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা সরকারের ডাটা সেন্টারে আগুন দিতে পারে না। কারণ, তারা ফোর জি ডাটা ব্যবহার করেই তাদের আন্দোলনকে বেগবান করেছে।

দেশে তিনদিন ধরে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় এর ব্যবস্থাপনা দারুণ সমালোচনার মুখে পড়েছে। কেউ কেউ বলছেন সরকার স্বত:স্ফুর্ত আন্দোলন দমানোর জন্য নিজেরাই তিনদিন ধরে ইন্টারনেট বন্ধ করে রেখেছে। কিন্তু সরকার তো তাহলে এমনিতেই সেবা বন্ধ রাখতে পারতো। আগুন ধরিয়ে সবকিছু পুড়ে দেবে কেন? সরকার দোষ দিচ্ছে বিএনপি-জামাতকে। বিএনপি-জামাত সেটা অস্বীকার করছে।

বিএনপি-জামাত যদি আগুন দিয়ে থাকে তাহলে তারা এই আগুন দিয়ে নিজেদের আন্দোলনের উদ্দেশ্যকে অজান্তেই কবর দিয়ে ফেলেছে। মোবাইলের ফোর জি ব্যবহার করতে না পেরে তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ হারিয়ে আন্দোলনের গতি হারিয়ে ফেলেছে। আমাদের দেশে কোনকিছু ঘটলে কর্তৃপক্ষ সেটাকে রাজনৈতিক কালার দিয়ে বিরোধী দল দমনে তৎপর হয়ে উঠেন। তারা আমাদের প্রতি ইর্ষাকাতর দেশের প্রতি সবসময় নতজানু। এসব বৈদেশিক গুপ্তচর ও তাদের ক্ষতিকর এজেন্টদেরকে নিয়ে চলাফেরা করতে ভালবাসেন।

তাই অপরদিকে দেশের এই অভ্যন্তরীণ আন্দোলনকে পুঁজি করে বৈদেশিক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর গোপন কালো হাত রয়েছে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। বিশেষ করে গত তিনদিন ধরে একটানা ইন্টারনেট ও ফোরজি মোবাইল সেবা বন্ধ হবার পিছনে দেশীয় আন্দোলনকারীদের চেয়ে বিদেশী শক্তিকে বেশী সন্দেহ করা হচ্ছে। যারা আদতে বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য ইর্ষাকাতর। যারা বাংলাদেশ থেকে শুধু নিতে চায়, দিতে চায় না অথবা দিতে কার্পণ্য করে, সীমান্তে গুলি করে হত্যা করে, সমুদ্রে হামলা করে অথবা রোহিঙ্গা শরণার্থী ঠেলে দেয় তাদেরকে বেশী সন্দেহ করা হচ্ছে।

বিদেশী গুপ্তচররা ভালোভাবে জানেন আমাদের সরকারী ডাটা সেন্টারের উৎস কোথায়। তারা জানেন, শুধু সরকারী তথ্যভান্ডারেকে ভন্ডুল করে দিতে পারলেই বাংলাদেশের সকল ডিজিটাল সেবা বন্ধ করা যেতে পারে-এটা তাদের পরিকল্পনা হতে পারে। সুতরাং একাজে সহায়তার জন্য বৈদেশিক গুপ্তচরের যে কেউ জড়িত থাকতে পারে।

তবে এর সাথে আমাদের দেশের সাম্প্রতিক মেগা-দুর্নীতিবাজদের যোগসাজশকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিছুদিন যাবত মেগা মেগা-দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতি প্রকাশ শুরু হওয়ায় এর পেছনে যারা আছেন তারা খুব আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তারা নিজেদেরকে নিরাপদ রাখার জন্য বৈদেশিক শক্তির সাথে হাত মিলিয়ে আমাদের সরকারী ডিজিটাল তথ্যভান্ডার ধ্বংস করার কাজে নিয়োজত হয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের উপর ভর করে অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলে পাঁয়তারা করতে পারেন বলে কথা উঠেছে। তাই এটাকে শুধু গুজব বলে একবারে উড়িয়ে দেয়া ঠিক হবে না!

আমাদের ব্যবসায়ীদের সংগঠনের তথ্যানুযায়ী (২০১৫) দেশে হরতালে একদিনের ক্ষতি হলো সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে দীর্ঘদিন যাবত ‘হরতালের বাবা’সংঘটিত হচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে দৈনিক কত হাজার বা কত লক্ষকোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তা অনুমান করা কঠিন। কারণ, জানা গেছে শুধু সেতু ভবন প্রাঙ্গনেই ৫৫টি সরকারী দামী গাড়ি ও মূল্যবান যন্ত্রপাতি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। দেশের অন্যান্য জায়গায় কি ঘটছে তা ইন্টারনেট সচল না থাকায় বলা যাচ্ছে না। কারণ, সরকারের ভয়ে নিয়ন্ত্রিত রেডিও-টিভি-তে সকলতথ্য ঠিকমতো প্রচারিত হয় না। শুধু দু’একটি ছাপানো পত্রিকা বলেছে, গত কয়েকদিনে দেশে ১৯৭ জন নিহত হয়েছে, আহত হাজার হাজার। অন্যান্য প্রচারমাধ্যমগুলো নিরীহ মানুষের সঠিক মৃত্যুসংখা প্রচারে ভয় পাচ্ছে অথবা কপটতা প্রদর্শণ করেছে!

এর জন্য সাধারণ মানুষের সৃষ্ট ক্ষোভ ও অভিমান দিন দিন আরো বেড়ে চলেছে। অপরদিকে দম্ভ দেখিয়ে চরম অবহেলা করে এগুলো নিরসনের জন্য সময় ক্ষেপণ করা বড় ভুল হয়ে গেছে। অবশেষে চলমান পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে সারাদেশে ‘কারফিউ’ঘোষণা করতে হয়েছে। দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান প্রচেষ্টা চালাতে তৎপর হতে গিয়ে আদালতের মাধ্যমে তাড়াহুড়ো করে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। এরপরেও সান্ধ্য আইন বলবৎ থাকায় এবং ইন্টারনেট ও প্রিপেইড মিটারে বিদ্দুৎ না থাকায় দেশের মানুষের যে অবর্নণীয় কষ্ট হচ্ছে তা বলাই বাহুল্য।

প্রশ্ন হলো- এত দেরীতে কামান দাগা ও ক্রমাগত ভুল ট্রিগারের ফলে এখনও যে ক্ষতির ঢেউ বয়ে যাচ্ছে তার দায় কেউ নিতে এলেও সেই ক্ষত দ্রুত সেরে উঠবে কি? অনির্দিষ্টকাল ধরে ‘কারফিউ’চলতে থাকলে যে পরিমাণ আর্থ-সামজিক ও মানসিক ক্ষতি সাধিত হবে সেই ক্ষতি খুব দ্রুত পুষিয়ে ওঠা কঠিন।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীনE-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.