মঙ্গলবার | ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ২ আশ্বিন, ১৪৩১

পানিবৈষম্য ও বন্যার্ত মানুষের কান্না থামবে কি?

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
গত ২১ আগষ্ট গভীর রাতে রাস্তা থেকে হঠাৎ শোরগোল ভেসে আসতে থাকলো। তার সাথে এলাকার নাইটগার্ডদের হুইসেলও শোনা যাচ্ছিল। ভাবলাম রাতে দল বেঁধে পাহারারত পাড়ার ছেলেরা মিলে হয়তো চোর-ডাকাত কাউকে ধরে ফেলেছে। কৌতুহলবশত: পড়াশুনা বন্ধ করে বারান্দায় গিয়ে শব্দগুলোর অর্থ অনুধাবন করার চেষ্টা করলাম। পরক্ষণেই বুঝলাম, এগুলো কোন মিছিলের সাধারণ শব্দ বা গঁৎবাধা দাবীর আর্জি নয়। বিশেষ কোন দাবী আদায়ের জন্য সমস্বরে হুঙ্কার দিয়ে শিক্ষার্থীরা ক্রমাগত সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল। গভীর রাতে ছাদ থেকে দেখা অবিশ্বাস্য সাহসীদের হঠাৎ এত লম্বা মিছিল চোখে পড়েনি।
সে রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে জেনেছি- সারা দেশের সকল বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা সীমান্তের ওপাড়ে প্রতিবেশী দেশের বাঁধ নির্মাণ ও পানিসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দশ মিনিটের নোটিশের বার্তায় একযোগ রাস্তায় নেমে পড়েছিল! শ্লোগান ছিল- ‘আমার দেশ ডুবলো কেন, সরকার জবাব চাই’। ‘বন্যায় যখন মানুষ মরে, আবরার তোমায় মনে পড়ে’। ‘দিল্লী না ঢাকা, ঢাকা, ঢাকা’। পরদিন ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জয়গায় বিভিন্ন সংগঠন ‘আন্তদেশীয় নদীগুলোতে ভারতের অবৈধ ও একতরফা সব বাঁধ উচ্ছেদের দাবিতে ঢাকা থেকে ত্রিপুরার ডুম্বুর বাঁধ অভিমুখে ২৭ মার্চ ছাত্র-জনতার লংমার্চ ঘোষণা করে’।
এছাড়া পরদিন টিভি সংবাদে একজন উপদেষ্টার বক্তব্যের মধ্যেও জানা গেছে- ‘আগাম সতর্কতা না জানিয়ে বাঁধের গেইট খুলে দেয়া অমানবিক কাজ হয়েছে।’অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বলেন, “পানি ছাড়ার আগে বাংলাদেশকে জানানো সংক্রান্ত চুক্তি ভারত প্রতিপালন করেনি। উজানের দেশে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হলে এবং পানি ছেড়ে দেওয়ার প্রয়োজন হলে, ভাটির দেশকে আগে থেকেই জানানো উচিত যাতে তারা প্রস্তুতি নিতে পারে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। তবে, এবার ভারত এই জানানোটি করেনি, যদিও আমাদের চুক্তিতে এমনটি করা বাধ্যতামূলক।”
দেশের পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে হু হু করে ঢুকে পড়া বন্যার পানিতে হঠাৎ ডুবে যাওয়া মানুষগুলোর কান্নার আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে সেটা কোটি শিক্ষার্থী-জনতার মাঝে ছড়িয়ে একাত্মতা ঘোষণা করে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল সবাই। বিগত বহু বছর যাবত তিস্তা, ফারাক্কা, টিপাইমুখ ইত্যাদি বাঁধের অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের প্রবঞ্চিত মানুষেরা আর কোন প্রবঞ্চনার শিকার হতে চায় না। তাই তারা রাতের আধারে গর্জে উঠতে দেরী করেনি।
প্রতিবেশী দেশের কর্তৃপক্ষ কালবিলম্ব না করে তার পরদিনই আমাদের প্রধান উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাত করে জানিয়ে দিয়েছেন তারা ত্রিপুরার ডম্বরু বাঁধ খুলে দেননি। পানির চাপ বেশী হওয়ায় বাঁধের কপাট নিজে নিজেই খুলে গেছে! এই ঘটনার সত্যাসত্য যাচাই করার সময় তখন ছিলনা।
জি-নিউজ, স্ক্রল.কমসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে জানা গেছে আগষ্ট ২১ তারিখে সকাল ৮.৩৫মিনিটে ত্রিপুরার একজন ম্যাজিষ্ট্রেটের উপস্থিতিতে ডম্বুর জলবিদ্দুৎ উৎপাদন প্রকল্পের বাঁধের কপাট খুলে দেয়া হয়। ১৯৭৪ সালে নির্মিত পুরাতন এই জলবিদ্দুৎ প্রকল্পটির ধারণক্ষমতার বেশী পানি জমা হওয়ায় ধ্বসে পড়ার আশঙ্কায় বিপদসংকেত না জানিয়ে হঠাৎ করে গেইট খুলে দেয়া হয়। কিন্তু ভারতীয় সরকারী গণমাধ্যমে গেইট খুলে দেয়ার কথা অস্বীকার করেছিল।
ফেণী, নোয়খালী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম এলাকার চলতি বন্যার বৈশিষ্ট্য হলো হঠাৎ প্রবল তোড়ে সবছিু ডুবিয়ে- ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া। হঠাৎ প্রবল স্রোতের গতি বলে দিচ্ছে এগুলো ড্যামের গেইট খুলে দেয়া অগাধ পানি। কারণ, উজানে গত এক সপ্তাহে এত বেশী পরিমাণ বৃষ্টির পানির রেকর্ড করা নেই! ডম্বুর বাঁধের ছেড়ে দেয়া পানি এই আকস্মিক বন্যার মূল কারণ। এই মনুষ্যসৃষ্ট বন্যাকে অনেক বিশেষজ্ঞ সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক বলে অভিহিত করেছেন।
বাস্তবতা হলো- বাংলাদেশের ১২টি জেলার মানুষের ঘরবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, গবাদিপশু, হাঁস-মুর্গীর ফার্ম, ফসলী মাঠ, মাছের পুকুর গভীর পানির নিচে ডুবে গেছে। বিদ্দুৎহীন হয়ে গেছে গোটা বন্যাক্রান্ত এলাকা। ঢলের পানির তোড়ের আকস্মিকতায় মানুষ হতভম্ব হয়ে পড়ায় যে যেটা পারেন হাতে নিয়েও ঘরের বাইরে বেড়িয়ে যেতে পারেননি। কারণ, চারদিকে শুধু পানি আর পানি। জীবনের নিরাপত্তার জন্য শুকনো জায়গা খুঁঝে না পেয়ে অনেকে শুধু কান্নাকাটি করছিলেন। আশেপাশের স্কুল, কলেজভবন ও বহুতল পাকাবাড়ি হাতেগোণা। সেগুলোর নিচতলা জলমগ্ন। উপরে বা ছাদে এত বন্যাক্রান্ত মানুষের ঠাঁই দেয়া যাচ্ছে না। এসব এলাকায় মোট ৪৫ লক্ষ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এবং ২৩ তারিখ বিকেল পর্যন্ত ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের স্বজনদের কান্না শোনার মতো দরদী কেউ সেখানে ছিল না।
এতটা আতঙ্কাবস্থা তৈরী হয়েছে যেটা পরবর্তী ৩০ ঘন্টার পরে এসব জায়গায় হু হু করে পানি ঢোকা অব্যাহত ছিল। ফেণীর দাগনভূইয়াঁ, ছাগলনাইয়া, কুমিল্লার বুড়িচং, চট্টগ্রামের মিরসরাই এলাকার সব জায়গায় জায়গায়শুধু থৈ থৈ পানি। এসব এলাকায় গ্রাম, শহর, নগর, পুকুর, মাঠ আলাদা করে চিহ্নিত করা যাচ্ছিল না। শুকনো জায়গা নেই, খাবার পানি নেই, খাদ্য নেই। ২৩ তারিখ রাত পর্যন্ত উপদ্রুত অঞ্চলে একটি চরম মানবিক বিপর্যয় চলছিল।
কিছু কিছু জায়গায় সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীর সাথে অন্যান্য সংস্থাগুলোর সাহায্যকারীরা উদ্ধার করার চেষ্টা চালানো শুরু করেছেন। তবে কোথাও কোথাও হেলিকপ্টার দিয়ে শুকনো খাবার ছুঁড়ে দিয়ে এবং পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করতে দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-তে কেন্দ্র বানিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের আহবানে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করার ব্যবস্থা হয়েছে এবং সেগুলো উপদ্রুত এলাকায় দ্রুত পাঠানো শুরু হয়েছে।
কথা হলো- বার বার এই খামখেয়ালীপনাসৃষ্ট বন্যার জন্য ক্ষয়ক্ষতির দায় কার? এবছরের শুরু থেকে মাত্র আটমাসে সিলেট বিভাগে সাত বার বন্যা হয়েছে। তিস্তা এলাকায় গত বছর আটবার বন্যা হয়েছে। সেখানে গেল চৈত্র মাসেও প্রবল ফ্লাশ-ফ্লাড হয়ে মানুষের আলু, গম, পিঁয়াজ, রসুন, মিষ্টি কুমড়া, চিনাবাদামসহ উঠতি ফসলের ব্যাপক ধ্বংসলীলা সাধিত হয়েছে। তিস্তাপাড়ের দরিদ্র কৃষকদেরকে আরো হতদরিদ্র বানানোর জন্য দায়ী এসব ফ্লাশফ্লাড। এর দায় এবং দরিদ্র প্রান্তিক কৃষকদের ঋণের বোঝা শোধ করার দায়-ই বা কে নিতে এগিয়ে আসবে?
এসব হঠাৎ বন্যাসৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির দায় অনেক। এগুলো শুধু বন্যা নয়- এগুলো দরিদ্র মানুষের আহাজারি ও অবিরাম কান্নার প্রতিধ্বনি। সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা ঢলে প্রতিবছর হঠাৎ করে হাজির হয় এই বন্যা। যার জন্য কান্না থামার পূর্বেই শুরু হয় নতুন কান্না। যুগ যুগ ধরে এর কোন প্রতিকার দেখা যায় না।
তিস্তা ছাড়াও বিশেষ করে ফেণী ও কুমিল্লা জেলার মানুষ গত ৪০ বছরেও এত পানির তোড় দেখেননি। ঢলের পানি তাদের বাড়িঘর ডুবিয়ে দেবে এমন কল্পনাও করেননি অনেকে। দৈত্যের মতো ছুটে আসা ঢলের তোড় তারা ভাবতেও পারেননি। মূল্যবান জিনিষ কিছুই সরাতে না পারায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত বেশী হয়েছে সেটা এখনই অনুমান করা কঠিন।
ফেণী জেলার উজানে উঁচু, কিন্তু নিম্নাঞ্চল সমুদ্রের সমতল তটরেখা স্পর্শ করে আছে। উজানের ঢল সন্দীপ ও এর সংলগ্ন উড়ির চর, দুবলার চরের মানুষ সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। উপকূলীয় এলাকায় তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আবাদ সবকিছু ভেসে গেছে। তাই উজানের যে কোন ব্যারাজের গেইট খুলে দেবার আগে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরামে অতিবৃষ্টি হলে তার আগাম তথ্য ও সতর্কবার্তা দ্রুতগতিতে বাংলাদেশে পৌঁছাতে বিলম্ব হলে ঘটতে পারে বড় বিপর্যয়।
প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের উজানের নদীগুলোতে কমপক্ষে ত্রিশটি বড়ছোট বাঁধ দিয়ে পানি আটকিয়ে একচেটিয়াভাবে একাই ব্যবহার করে আসছে। যেটা আন্তর্জাতিক নদী আইনের চরম লঙ্ঘণ।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মিঠাপানির উৎসকে একচেটিয়াভাবে আটকিয়ে ভোগ করার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। এমনকি একটি দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রদেশ ও জেলার মধ্যেও নদীর পানি বন্টন নিয়ে কলহ বিদ্যমান রয়েছে। ভারতের গঙ্গা, নর্মদা ও জাপানের তোনেগাওয়া নদীর পানি বন্টন নিয়ে অতীতে বিভিন্ন প্রদেশ, জেলা বা কেনের মধ্যে নানা যুদ্ধের কথা জানা যায়। এসব পানিযুদ্ধের রকমফের ভুগিয়েছে অপেক্ষাকৃত দুর্বল অঞ্চলের শাসকদেরকে। কিন্তু ভারতের হিসেবটা ইউনিক ও অমানবিক।
এগুলোকে পানিসন্ত্রাস, বন্যাদস্যুতা, পানিবৈষম্য হিসেবে আখ্যায়িত করে অনেক গবেষণা হয়েছে, লেখা হয়েছে অনেক পিএইচডি থিসিস। কিন্তু শক্তিশালী দেশের বা প্রদেশের একগুঁয়েমীতার কারণে এসকল পানিবন্টন সমস্যার যৌক্তিক সমাধান হয়েছে খুব কম অথবা মোটেও হয়নি। যেমন, ইউফ্রেটিস, আমাদের তিস্তা সমস্যা ও সম্প্রতি ত্রিপুরার ডম্বুর।
বন্যা বন্ধ হোক বললেই বন্যা বন্ধ হয় না। বন্যা থেকে সৃষ্ট নদীভাঙ্গনের জন্য প্রতিবাদ স্বরুপ তৈরী মানবন্ধন ও লেখা ব্যানারের ভাষা নদীগুলো পড়তে জানে না। নদীতীরের মানুষগুলোও সবাই সেটা বুৃঝে না। এজন্য রাষ্ট্রীয় কমিটমেন্টকে কাজে লাগাতে হয়। সুবিধাবাদী, ঘুসকোর ও নতজানুরা কখনও নিজেদের দাবী আদায় করতে পারে না। ফলে এসকল সমস্যার কোন সমাধান লাভ হয়ে উঠে না।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের আহবানে দশ মিনিটে যে কোন প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাগিদে যে উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে তাতে দেশে বিদেশে আমাদের আন্তর্জাতিক নদীর পানিবন্টন সমস্যার বৈষম্যগুলোর কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সারা পৃথিবী নতুন করে জেনে ফেলেছে আমরা বাংলাদেশীরা প্রতিবেশী দেশের নিকট থেকে চরম পানিসন্ত্রাসের শিকার। এই পানিবৈষম্য আমাদের কৃষি, যোগাযোগ, মৎস্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, সুন্দরবন সবকিছুর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে আসছে। তিস্তাসহ বহু ক্যাচমেন্ট এলাকার কৃষকদের আরো দরিদ্র হবার কারণ উজানের দেশের বাঁধসন্ত্রাস ও পানিবৈষম্য।
শিক্ষার্থীরা গত বায়ান্ন বছরে এসবের কড়া প্রতিবাদ করতে পারেনি। নিজেদের একতা না থাকায় তারা প্রতিবাদ করার পরিবেশ পায়নি। তারা এতদিন সংগঠিত হতে পারেনি, উপযুক্ত নেতৃত্বও খুঁজে পায়নি। এখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশী-বিদেশী সব ধরণের বৈষম্য থেকে বাংলাদেশ অচিরেই মুক্তি পাবার পথ খুঁজে পাক্, এই প্রত্যাশা।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.