মঙ্গলবার | ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ২ আশ্বিন, ১৪৩১

এ আই যুগে গুম ও আয়নাঘরের আদিমতা

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
আয়নাঘর একটি ভয়ংকর টর্চারসেল সম্বলিত ভূতুড়ে ঘরের নাম। এটাকে কেউ কেউ গোপন কারাগার বলে ডাকেন। পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে ২০০৯ সালে এই ঘৃণিত কারাগারের উৎপত্তি ও কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে জানা যায়। তৎকালীণ প্রধানমন্ত্রীর এক নিরাপত্তা উপদেষ্টা আয়নাঘর সৃষ্টির মাস্টারমাইন্ড বলে প্রচলিত। তিনি এর পিছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে গণমাধ্যমে অভিযোগ করেছেন কিছু ভুক্তভোগী।
তবে আয়নাঘর নামক গোপন কারাগারের অবস্থান কোথায় তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। ধারণা করা হয়, এটা কোন একটিমাত্র ঘর নয়। রাজধানী ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে এই নামে একাধিক স্থাপনা রয়েছে। নাম প্রকাশ না করে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আয়নাঘর’নিয়ে তারা বেকায়দায় আছেন। এটি নিয়ে দেশ-বিদেশে সমালোচনার ঝড় বইছে। সরকার পতনের আগপর্যন্ত এখানে কয়েকশ মানুষ আটক ছিল বলে তারা তথ্য পেয়েছেন।’(ইত্তেফাক ১৯.০৮.২০২৪)।
আয়নাঘর কোথায় তা কোন মিডিয়ায় বলেনি, ছবিও প্রকাশ করেনি। গত পনের বছর ধরে দেখানোর সাহসও করেনি। ‘আয়নাঘর’ কচুক্ষেত, উত্তরা, মিন্টো রোডে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ইউনিটে ছিল (দৈনিক দেশ রূপান্তর)। কেউ বলেছেন, এয়ারপোর্ট যাবার ব্যস্ত রাস্তার পাশে সবুজ রঙের থাই গ্লাস লাগানো বিরাট ভবনের নিচে একটি ভয়ংকর আয়নাঘর রয়েছে।
জুলাই ১, ২০২৪ থেকে শুরু হওয়া বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের চাকুরী বৈষম্য নিরসনে কোটা সংস্কার আন্দোলন একসময় ছাত্র-জনতা, অবিভাবক ও সকল শ্রেণিপশার আন্দোলনে রূপ নেয়। এরপর সেটা বৃত্তর আন্দোলনে পর্যবসিত হয়ে আগষ্টে এস সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে গতিপ্রাপ্ত হয় ও জুলাই ১৭-১৯ সারা দেশে এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায় সূচিত হয়ে পুলিশের গুলিতে ৮১৯ জন নিহত (এইচআর এসএস অনুযায়ী) ও প্রায় ২৫ হাজার মানুষ আহত হন। যদিও সরকারীভাবে শুধু ৬৫০ জনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করা হয়েছে।
গত ৫ আষ্টের পর গুম হয়ে নিখোঁজ থাকা অনেকে ফিরে এসেছেন, যাদের দীর্ঘদিন কোনো হদিস ছিল না। তাদের মুখ থেকে বর্ণিত নির্যাতনের কাহিনী গণমাধ্যমে প্রচারিত হতে থাকলে এরপরই আলোচনায় আসে ‘আয়নাঘর’। কিন্তু এটা বাস্তবে আছে কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিল। অনেকে এটাকে গুজব বলে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ফিরে আসা নির্যাতিত ব্যক্তিরা গণমাধ্যমে মুখ খোলার পর জানা আয়নাঘর নামক গোপন কারাগারের বাস্তবতা। প্রচলিত আইন শৃংখলাবাহিনীর নামের আড়ালে গোপন গুন্ডাবহিনী দিয়ে বিরুদ্ধমতের মানুষগুলোকে ধরে এনে আয়নাঘরে রাখা হতো এবং অমানুষিক নির্যাতন করা হতো।
এসব কর্মকান্ড করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্তারা পদোন্নতি পাওয়া থেকে শুরু করে পুরস্কৃতও হয়েছেন। সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পাওয়া ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালকে গ্রেপ্তারের পর ‘আয়নাঘর’সহ নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে নানাতথ্য জানা যায়। তার বিরুদ্ধে রয়েছে খুন, গুম ও অসংখ্য ব্যক্তির ফোনে আড়িপাতার অভিযোগ।’(ইত্তেফাক ১৯.০৮.২০২৪)। তিনি এনটিএমসির দায়িত্বে থাকাকালে একের পর এক কল রেকর্ড ফাঁস করেন। রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য হুমকি এমন সব ব্যক্তির স্পর্শকাতর কল রেকর্ড তার নির্দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিতেন ( দেশ রূপান্তর)।
এরপর প্রকাশিত হয় জনাব ফিরোজ, কামরুজ্জামান, বেলাল, সোহেল রানা, সালাহউদ্দিন, ব্যারিষ্টার কাশেম, মাইকেল চাকমাসহ অনেক আয়নাঘরফেরত বন্দিদের করুণ কাহিনী। তারা কেউ কেউ বলেন, ‘ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে তাদের বাধ্য করা হয়েছে। রিমান্ডে নিয়ে ফিরোজ ও কামররুজ্জামানকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি হিসেবে একটি স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করতে বাধ্য করা হয়। ফিরোজ বলেন, সেই স্ক্রিপ্টের একটি অনুলিপি আদালতে জমা দেওয়া হয়েছিল।’.. “ওরা কোমরের নিচে লাঠি দিয়ে পেটাতো আর বৈদ্যুতিক শক দিতো এবং একটি স্টিলের চেয়ারে হাত বেঁধে বসিয়ে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির্যাতন করত।”
লেক্সাস গ্রুপের চেয়ারম্যান জনাব বেলাল আয়নাঘরের বর্বর নির্যাতন, প্রতিনিয়ত মৃত্যুর ভয়, তওবা পড়ানোসহ অমানবিক বিভিন্ন কষ্টের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ছোট্ট কবরের সমান একটা জায়গা, চোখ-হাত বাঁধা,.. রাত গভীর হলেই ঝিঁঝি পোকার ডাক। অনেকই এখানে বন্দি ছিল, তাদের কান্নার আওয়াজ ও আর্তনাদ প্রায়ই শোনা যেত। আমাকে যখন ধরে নিয়ে যায় তখন আমার ওজন ছিল ৯০ কেজি। যখন ছেড়ে দেয় তখন ওজন হয় ৬০ কেজি ‘চোখ বাঁধা অবস্থায় ছিলাম ৪০ দিন, বলত চোখ খুললেই মেরে ফেলব।’
সুপ্রি কোর্টের আইনজীবী জনাব সোহেল রানা ছয় মাস বন্দি ছিলেন ‘আয়নাঘর’ নামক নির্জন স্থানে। দীর্ঘ সময় ধরে সেই ঘরে থাকাবস্থায় প্রতি মুহূর্তে গুনছেন মৃত্যুর ক্ষণ। নানা অনুনয় বিনয়ের পর এক দিন চোখ বাঁধা অবস্থায় ফেলে রাখা হয় জঙ্গলে। কেন তাকে ধরা হয় এই বিষয় তিনি বলেন, কুয়াকাটায় কিছু জমি নিয়ে একজন সেনাকর্মকর্তার সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব ছিল। তাকে ছাড়ার আগে হুমকিও দেওয়া হয়। যদি গণমাধ্যমসহ কোথাও মুখ খুলেন, তবে তার দুটো সন্তানকে মেরে ফেলা হবে।’
একটি বেসরকারী টিভিতে দেয়া সাক্ষাতকারে সালউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আয়নাঘরে একষট্টি দিন থেকে ভারতের শিলংয়ের গলফ ক্লাবের রাস্তায় নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন কার ইশারায়?’ ভবঘুরে হিসেবে তাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে একটি মিশন হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়া হয় কিছু লোক। সেখান থেকে শিলং পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। তার মতো অনেক গুম হওয়া মানুষ এখনও ফিরে আসেননি। কোনদিন ফিরে আসতে পারবেন কি-না জানেন না। তিনি নিজে জীবিত ফিরে আসতে পেরেছেন এজন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের কাছে হাজারো শুকরিয়া জ্ঞাপন করেছেন।
আরেক সাক্ষাতকারে ব্যারিষ্টার কাশেম বলেন তার পিছনে হাত বেঁধে ফেলে রাখা হতো সবসময়। গন্ধযুক্ত পঁচা খাবার দেয়া হতো। নামাজ, নফল রোজা করতে চাইতেন। রোজা রাখলে ইফতারে মাঝে মাঝে পিঁয়াজুভাজা খেতে দিত। সেটা তার কাছে একটা ভাল লাগতো। এটা জানার পর, ইসলামে এত বেশী রোজা রাখার নিয়ম নেই-বলে রোজা রাখতে দিত না। বাইরের মৃদু শব্দে আযান শোনার চেষ্টা করে নামাজ আদায় করতেন তিনি। কিন্তু আযানের সময় হলে মিউজিক বাজানো হতো।
এছাড়া আরেক সাক্ষাতকারে গুম হওয়া মাইকেল চাকমা বলেন, ‘তার বোনেরা তিনবার লাশ খুঁজেতে গিয়ে চিহ্নিত করতে না পেরে ফিরে এসে হতাশ হয়েছেন। তারা বাড়িতে মাইকেল চাকমার অন্তেষ্ঠিক্রিয়া পালন করেছেন’। এই বলে তিনি কান্নাকাটি করেছেন। তার মতো নির্দোষ ছেলের কোথাও খোঁজ না পেয়ে শোকে, দু:খে মুহ্যমান হয়ে তার বৃদ্ধ বাবার মৃত্যু ঘটে।
জনাব চাকমা অপেক্ষা করেছিলেন এই ভেবে যে, মানুষ মরণশীল। ‘শেখ হাসিনা বৃদ্ধ মানুষ। তারও একদিন মৃত্যু ঘটবে।’ এরপর তারপর তার মুক্তি হবে-এটাই ছিল তার আকাঙ্খা। কি মর্মান্তিক ভাবনা। একজনের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত বন্দিদশা থেকে নিজের মুক্তি মিলবে না। এটা কতবড় অভিশাপের কথা! এই আশায় শতকষ্ট সহ্য করে হলেও তার বন্দিকারীর মৃত্যুপ্রহর গুণে তিনি আয়নাঘরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে গেছেন!
তবে কারো অনুভূতিতে কি এই কান্না নাড়া দিতে পেরেছিল? মাইকেল চাকমার এই বক্তব্য ভবিষ্যতে সব নির্যাতনকারীদের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকলে সেটাই হবে ইতিহাসের বড় একটি শিক্ষণীয় বিষয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একই ক্যাম্পাসে পড়াশুনার সুবাদে ইলিয়াস আলীর পরিবারের সাথে আমাদের দীর্ঘদিনের পরিচয়। তার স্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিষয়ে পড়তেন। ইলিয়াস আলী গুম হবার পর অভিভাবকবিহীন পরিবারে তার বাচ্চাদের নিয়ে লুনা আপার প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামের করুণ কাহিনী এখনও খুব পীড়া দেয়।
গত পনের বছর ধরে আয়নাঘরের বেআইনী কাজের বর্ণনা করা যে কারো জন্যে খুব দুষ্কর ছিল। তথ্য জানলেও কেউ মুখ ফুটে সেটা প্রকাশ করার সাহস করেনি। একটি সভ্য স্বাধীন দেশে কেন এমন আয়নাঘর তৈরীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল? এটা কি কারো মনের জিঘাংসা চরিতার্থ করতে সৃষ্টি হয়েছিল? অথবা কারো ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে? হয়তোবা এগুলোর কোন একটা বা অন্য কোনকিছু।
কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না- দুনিয়াতে কারো ক্ষমতা, ভোগবিলাস, অনন্তকালের জন্য নয়। মানুষ ক্ষমতার মোহে এটাই ভুলে যায়। ফেরাউন বেহেস্ত বানিয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল। বাদশাহ সাদ্দাদও তাই। বাদশাহ কারুণ সোনাদানার ভেতর নিজেকে আবৃত করে রেখে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল।
এগুলো শুধু ইতিহাসই নয়- মানব সভ্যতার করুণ পরিণতির বাস্তব ঘটনা। এসব ঘটনা পড়ে, শুনে জ্ঞান অর্জন করা জ্ঞানপাপীরা সেটা ভুলে যাবার চেষ্টা করে। ধনসম্পদ ও ক্ষমতার মোহে আড়ষ্ট করে দিয়ে শয়তানী প্ররোচনায় যুগে যুগে তবুও অত্যাচারীদের জন্ম হয়, নিরীহদের উপর নির্মম নিপীড়ন চলে।
এসব অত্যাচার, নিষ্পেষণের শেষ কোথায়? ইতিহাস থেকে মানুষ অনেক কিছু জানে, বোঝে। তবুও সততার খরস্রোতের অভাবে নদীর পানি দ্রুত ঘোলা হয়ে উঠে। সল্পমিঠা পানি অথৈ সমুদ্রের নোনা জলে মিশে ভেসে থাকা সামান্য তেলের মতো ধাক্কা খেয়ে অনবরত ঘুরপাক খেতে থাকে। আর এভাবে অন্যায়ের ঘূর্ণি বেড়ে গেলে গণবৈষম্য সৃষ্টি করে গণবিপ্লবের সূচিত করে।
এ ধরণের গণবিপ্লব কিছুদিন পর পর ঘূর্ণির মতো মোচড় দিতে ফিরে ফিরে আসে। গত ২৯ জুলাই ২০২৪ অন্তবর্তী সরকারের অধীনে গুম বন্ধকল্পে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠিত হয়েছে। গুমের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালের কনভেনশনে বাংলাদেশ সই করেছে। এর মাধ্যমে সমাজ থেকে সবধরনের গুম, নির্যাতন, বৈষম্য নিপাত যাক। ‘আয়নাঘর’নামক ঘৃণিত শব্দ চিরতরে বিলীণ হোক। বার বার গর্জে উঠুক তরুণ-জনতা। বেঁচে থাকুক মানবতা। এভাবে মানবতা জেগে উঠলে পৃথিবীটার আয়ু বেড়ে যাবে।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.