শুক্রবার | ১৮ অক্টোবর, ২০২৪ | ২ কার্তিক, ১৪৩১

সবাই কেন উপাচার্য হতে চান?

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
সম্প্রতি একটি বহুল আলোচিত সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘৫০০ শিক্ষক’ ভিসি হতে চান, বিস্মিত শিক্ষা উপদেষ্টা’- এ প্রসঙ্গে পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেকের সভার সময় মোবাইল ফোনে এল একটি কল। রিং টোনের শব্দে উপদেষ্টা ফোনটি ধরলেন না। তবে তিনি যে বিরক্ত তা বোঝা গেল প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে করা স্বগতোক্তিতে।’ …তিনি বলতে থাকলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের এত শিক্ষক… ৩০০-৪০০-৫০০ শিক্ষক সবাই কেন এত ভিসি হতে চায়, আমি বুঝি না।”
আরেকটি আলোচিত সংবাদ হলো- অন্তর্বর্তী সরকারের একজন তরুণ উপদেষ্টা সেদিন দ্বিতীয়বারের মতো বললেন, ‘পঞ্চাশজনের মধ্যে আটচল্লিশ জনই তদ্বির নিয়ে আসেন’(ইত্তেফাক ১৬.০৯.২০২৪)। অর্থাৎ, তার কাছে বা দপ্তরে যারা দেখা করতে আসেন তাদের ছিয়ানব্বইভাগই আসেন কোন না কোন কাজ উদ্ধারে অবৈধ ‘তদ্বির’নিয়ে।
এসব শিরোনাম নিয়ে সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের টিটি টেবিলের পাশে এক সহকর্মীর সংগে গল্প করছিলাম। হঠাৎ বিভিন্ন পদ লাভের জন্য এত তদ্বির বেড়ে গেছে কেন?
তার ঝট্পট উত্তর। এখন এই ঘুষমুক্ত সময়ে এতদিন নীরব থাকা সৎ প্রার্থীরা সরব হয়ে উঠেছেন ! এখন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়টা ঘুষমুক্ত হিসেবে বৈষম্যমুক্ত থাকার দাবী করছে। কেউই প্রকাশ্যে ঘুষ-দুর্নীতির কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। হাসিনা সরকারের আমলে বা কিছুদিন আগেও পকেটে ২-৩ কোটি টাকা না থাকলে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কেন- সরকারী চাকুরতে ডিসি, ওসি হিসেবে পোষ্টিং পাবার কথা চিন্তাও করতো না। যাদের মনে ঘুষ লেনদেনের অবৈধ বিষয়ে ঘৃণা বা ভয়ডর ছিল তারা চুপ করে এসব বিষয় এড়িয়ে থাকতেন। ঘুষমুক্ত এই পরিবেশে সৎ মানুষেরা বড় বড় পদ লাভের জন্য সুযোগ নিতে চেষ্টা করতেই পারে। তার কথায় আবারো বেশ জোর লক্ষ্য করলাম।
তবে কর্তৃপক্ষের সাথে যাদের কোন না কোন ভাবে ব্যক্তিগত পরিচয় ও একাডেমিক যোগাযোগ বেশী রয়েছে তারাই বেশী সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন বলে তার ধারণা । ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগ থেকে তিনজন ভিসি হয়েছেন। এ ব্যাপারে একটি প্রতিষ্ঠান বিশেষ প্রাধান্য পেলেও সেসব প্রার্থীদের বিশেষ যোগ্যতা ছিল- তা স্বীকার করতেই হবে।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় যারা আসেন তারা মোটামুটি সবাই ভিসি হবার যোগ্যতা রাখেন। কারণ ব্যাচেলর বা মাস্টার্সে অন্তত: একটি ফার্স্টক্লাশ না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার জন্য প্রাথমিক আবেদনই করা যায় না। এরপরও দু’একটি পদের জন্য আজকাল শত শত ফার্স্টক্লাশধারীর আবেদন জমা পড়লে নিয়মানুযায়ী তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মেধা ও উচ্চতর ডিগ্রীধারীকে নিয়োগ দেয়া হয়। যদিও বিগত কয়েক বছরে এর কিছু ব্যত্যয় ঘটতে দেখা গেছে তথাপি এখনও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরা মেধাবীরাই পড়াতে আসেন। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
এসব মেধাবীদের মধ্যে যাদের অনেক বিদেশী ডিগ্রী ও গবেষণাকাজ রয়েছে এবং কিছুটা উচ্চাভিলাষী তারা মনে করছেন- ঘুষবিহীন বর্র্তমান সময়ে যদি একটু নড়াচড়া করলে ভিসি হওয়া যায় তাহলে দোষের কী? তাই ঘুষমুক্ত এই সময়ে যার যেভাবে নড়াচড়া করার সুযোগ রয়েছে তিনি সেভাবে তৎপরতা দেখাতে শুরু করেছেন। এক্ষেত্রে শিক্ষা উপদেষ্টা মহোদয়ের বিস্ময় প্রকাশ করারই কথা। কারণ দেশে এখন ৪টি স্বায়ত্বশাসিত পাবলিক, ৫১টি সরকারী বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১০৫টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।
এগুলোতে ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারার পদে প্রতিটিতে তিনজন করে হিসেব করলে মোট ৪৮০ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা প্রয়োজন। সেখানে বিস্ময়ের তেমন কিছু নেই। বরং এতগুলো উচ্চপদে নিয়োগের জন্য একটি সুষ্ঠু নীতিমালা তৈরী হলে এত জটিলতা হতো না। দেশের ৪টি স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগীয় চেয়ারম্যান, ডীন ইত্যাদি পদে সুষ্ঠু নীতিমালা থাকায় সেখানে নিয়োগ নিয়ে কোন জটিলতা দেখা যায় না।
কিন্তু এবার ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারার পদে নিয়োগে সমস্যা শুরু হয়েছে অন্য জায়গায়। কৌতুহল ভরে জিজ্ঞাসা করলাম সে সমস্যা কি এবং কোন জায়গায়?
সেটা হলো কে, কীভাবে, কার কাছে আবেদন করবেন তার কোন নিয়ম খুঁজে পাওয়া যায়নি। কোন দেশের ডিগ্রী, কত বয়স, কোন ধরনের গবেষণা প্রকাশনা, কতটি বই, কত অভিজ্ঞতা থাকলে কে কত স্কোর পাবেন তা কেউ অনুধাবন করতে পারেননি বলে মনে হচ্ছে। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের উন্মুক্ত সার্কুলেশন না থাকায় অনেক প্রতিভাধর শিক্ষক আবেদন করতে পারেননি। অনেকে বিগত আন্দোলনে শরীক থেকেও সরাসরি ছাত্রদের হাতে নিজের সিভি জমা দিয়ে ভিসি হতে লজ্জা পেয়েছেন।
তারপরেও এই ঘুষমুক্ত সময়ে অনেক প্রতিভাধর শিক্ষক সপ্নবাজ হয়ে ভিসি হতে চেয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ সেখানে রাজনৈতিক আবরণ ও আভরণ জাগ্রত হওয়ায় শুরুতে যে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া দেখা গেছে তা অল্পদিনের ব্যবধানে থমকে গেছে । এছাড়াও অনেকে নিয়োগকর্তাদের স্বজনপ্রীতি ও নিজ প্রতিষ্ঠানপ্রীতির অভিযোগ করেছেন। এর সাথে তদ্বিরও বেড়ে গেছে বহুগুণ।
কথা হলো তদ্বিরকারীরা আগের মতো সচল হয়ে উঠলে বৈষম্য দূর হবে কীভাবে? তোয়াজ-তোষণ তদ্বিরের দ্বারা অপরের ‘হক’কেড়ে নেয়া হয়। ঘুস, দুর্নীতমুক্ত সময়েও তদ্বিরের মাধ্যমে স্বজনপ্রীতি, এলাকাপ্রীতিকে প্রশ্রয় দেয়ার সুযোগ তৈরী করে দেয়া হয়। এতে প্রকৃত মেধাকে চরম অবমূল্যায়ণ ও অপমান করা হয়। এর ফলে অফিস-আদালত, সমাজ, রাষ্ট্রের প্রতিটি কর্ণারে বৈষম্য মাধা চাড়া দিয়ে উঠে। এর ফলে অরাজকতা তৈরী হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে ভাঙ্গন ধরে। যেটা কিছুদিন আগে আমাদের দেশে প্রকট নামাজিক অরাজকতা সৃষ্টি করে সামাজিক বিপ্লব সূচিত করেছিল।
এমন বিষয়গুলো মাথায় রেখে একটি দৈনিক পত্রিকা মন্তব্য করেছে, ‘পূর্বাপর এমন অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা উপদেষ্টা ও স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ে করা মন্তব্যকে সত্য ও সাহসী উচ্চারণ হিসেবেই মনে হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে সৃষ্টি হওয়া এই অচলায়তন ভাঙবে কে? জাতির অন্ধকার দূর করে আলোর পথে আনবেন যে শিক্ষকরা তাদের মনের অন্ধকার প্রবণতা দূর করবে কে?’
এই সোনালী সময়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নায়কদের কাছে যদি শতকরা ছিয়ানব্বইভাগ মানুষ ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুবাদে ভিন্নভাবে তদ্বির নাম ভয়ংকর অসুখের বার্তা নিয়ে হাজির হবার সাহস পায় তাহলে দেশের অন্যান্য ক্ষেত্রে কি অরাজকতা চলছে তা নতুন করে বলার অপেক্ষায় নেই। তা হলে কাঙ্খিত পরিবর্তন হলো কোথায়?
দেশের সকল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি ইতিবাচক পরিবর্র্তনের জন্য বিভিন্ন সংস্কার কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে সংস্কার শুরু হয়নি। ভিসি বা শিক্ষক নিয়োগ বা পদন্নোতির জন্য নতুন করে নীতিমালাও তৈরী হয়নি। এমতাবস্থায় পুরনো নিয়মে ভিসি বা শিক্ষক নিয়োগ হলে পুনরায় পক্ষপাতিত্ব মাথা চাড়া দিয়ে একটিমাত্র রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা সযোগ পাবে এবং এভাবে সুযোগ্যরা বঞ্চিত হয়ে বৈষম্য সৃষ্টি হতে থাকবে। তখন আরো নিত্যনতুন সমস্যা তৈরী করতে পারে।
তাই নতুন নীতিমালা ও কঠিন শর্ত তৈরী করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ভিসি নিয়োগের সার্কুলার জারি করলে কেউই আর ভিসি হবার জন্য ব্যক্তিগতভাবে কারো কাছে ধর্ণা দিতে যাবার কথা নয়। সুনির্দিষ্ট যোগ্যতায় যার সর্বচ্চো স্কোর হবে শুধু তিনিই পদ লাভ করতে পারবেন। একটি পদের জন্য ৫০০ জনের দৌড়াদৌড়ি করার প্রয়োজন হবে না। কারণ, এটা একটি মর্যাদাপূর্র্ণ পদ। এই পদকে আর কলুষিত করে নিচে নামানোর অবকাশ নেই।
এই ঘুষমুক্ত সময়ে দেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রতিভাধর শিক্ষক সপ্নচারী হয়ে সকল নীরবতা ভেঙ্গে ভিসি হতে চেয়েছেন। তাদের সবার দিকে দৃকপাত না করার ফলে নানাবিধ শুণ্যতা সৃষ্টি হয়েছে। যোগ্যতা শুধু একটি বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে-এমন ধারণার বাস্তবায়ন জাতিকে ইতোমধ্যে হতাশ করে তুলেছে।
এখন আপাতত: ঘুষ নেই কিন্তু স্বজন, বন্ধু, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, বিশেষ প্রতিষ্ঠানপ্রীতি ইত্যাদি বিষয়গুলো ঘুষের চেয়েও মারাত্মক ইস্যু হয়ে দেখা দিয়েছে। যা একজন তরুণ উপদেষ্টার নিকট তদ্বিরস্বরুপ প্রতীয়মান হয়েছে। একটি সুষ্ঠু নীতিমালা তৈরী করে সবার কথা মনে রেখে আমাদের প্রতিটি মূল কাজে দ্রুতগতি ফেরানোর সময় এখন। দেশ গড়ার সময় এখন প্রকৃত মেধা ও এ.আই-এর তালে সামঞ্জস্য রেখে। তা-না হলে আমরা বার বার হোঁচট খেতেই থাকবো।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.