শুক্রবার | ১৮ অক্টোবর, ২০২৪ | ২ কার্তিক, ১৪৩১

‘লাশ টানা হাশেম’ নিজেই এখন জীবন্ত লাশ

আনোয়ারা খাতুন শেফালী, নাটোর প্রতিনিধি :
দীর্ঘ সময় লাশ টানা হাশেম নিজেই এখন জীবন্ত লাশ। এক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে অসহায় অবস্থায় দিন কাটছে তাঁর।
নাটোরের লালপুরের কচুয়া কাগিরপাড়া গ্রামের বাবা মৃত আবু বক্কর প্রামানিক ও মা মোছা. শকেজানের ছেলে মো. হাশেম আলী (৬৫)। তাঁকে ‘লাশ টানা হাশেম’ নামে সবাই চেনেন। দীর্ঘ ৪০ বছরে তিন থানার পাঁচ হাজারেরও বেশি লাশ টেনেছেন তিনি।
সোমবার (১৪ অক্টোবর ২০২৪) হাশেম আলী বলেন, প্রায় ৪০ বছর ধরে লালপুর থানার মরদেহ নাটোর মর্গে আনা-নেওয়া করেছেন। যৌতুকের টাকায় একটি পায়ে চালানো ভ্যানগাড়ি কিনে এ কাজ শুরু করেন। পরে কুষ্টিয়া থেকে ইঞ্জিন চালিত ভ্যান কিনে কুড়ি বছরের বেশি সময় লাশ টেনেছেন। লাশ টানা ছাড়াও মামলা জনিত কবর থেকে লাশ উত্তোলন ও দাফন করেছেন। ময়না তদন্তের জন্য ডাক্তার-ডোমের সাথে লাশ কাটা ও বিবরণ লিখতে সহায়তা করেছেন।
তিনি ২৫ বছর বয়সে বিয়ে করেন। বিয়ের আগে স্থানীয় বিভিন্ন চায়ের দোকানে খড়ি সরবরাহ করতেন। বিয়ের ১৪ দিন পর থেকেই লালপুর, বড়াইগ্রাম আর বাগাতিপাড়া থানা পুলিশের ডাকে মরদেহ বহনের কাজ শুরু করেন।
তিন মেয়ে ও দুই ছেলে তার। লাশ টানার কারণে কোন যাত্রী তার গাড়িতে উঠতো না। ছয় বছর সমাজ থেকে ‘একঘরে’ হয়ে ছিলেন। পরিবারের সদস্যরাও তাঁর সাথে থাকেননি। তাঁর হাতে খাবার পর্যন্ত খায়নি। নিজের পরিধেয় পোশাক-কাপড় নিজেকেই পরিষ্কার করতে হয়েছে। শুধুমাত্র এই পেশার কারণে আমার মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চায়নি। মেয়েদের নিয়ে হতাশায় দিন কাটিয়েছেন।
জানা যায়, ২০২২ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রতিবেশী এক ভাতিজার মেয়ের বাড়ি থেকে ফিরছিলেন হাশেম আলী। ওই ভাতিজার নিজেরও ভ্যান গাড়ি রয়েছে। তাই তিনি হাশেমের ভ্যান চালাচ্ছিলেন। আর হাসেম ভ্যানের ডান পাশে বসেছিলেন। মালঞ্চি বাজার পার হওয়ার সময় বিপরীত দিক থেকে ইঞ্জিনচালিত একটি ভ্যান সজোরে তার পায়ে ধাক্কা দেয়। ওই গাড়ির সামনের দুটি রড নাটসহ তার পায়ের মাংসের ভেতর ঢুকে যায়। হঠাৎ ধাক্কায় ভ্যানটি উল্টে গেলে তাঁর পায়ের হাড় ভেঙে যায়।
স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে প্রথমে তাকে রাজশাহী এবং পরে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে পর পর দুইবার অস্ত্রোপচার করতে তাঁর ১৮ কাঠা জমি ও বাড়িতে পালন করা দুটি গরুর বাছুর বিক্রি করতে হয়েছে। এর ২০ দিন পর তার আরও একটি অস্ত্রোপচার হয়। অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা, সংসারের খরচের পাশাপাশি অস্ত্রোপচারের টাকা জোগাড়ে দিশেহারা হয়ে যান হাসেম আলী। এখন শুধুমাত্র বাড়ির ভিটে ৩ কাঠা জমি অবশিষ্ট রয়েছে।
হাশেম আলী বলেন, তাঁর দুই ছেলে আর তিন মেয়ে, সবারই বিয়ে হয়েছে। দুই ছেলে শুকুর আলী আর আব্দুল গাফ্ফার ভ্যান চালান। তাদের সংসার আলাদা। স্ত্রীর এক চোখ অপারেশনের পর অনেক দিন থেকেই অসুস্থ। এখন এক চোখে দেখেন। দুর্ঘটনার পর মাঝে মাঝে দুই ছেলে কিছু সহযোগিতা করেছে। এছাড়া থানা থেকেও সামান্য কিছু টাকা সহযোগিতা পেয়েছেন।
৪০ বছর লাশ টেনেই জীবন চালিয়েছেন। আর এখন নিজেই জীবন্ত লাশ হয়ে জীবনযাপন করছেন। প্রতিদিন ৭০০-৮০০ টাকার ওষুধ লাগে। কোনোভাবেই জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে না। ডাক্তার অপারেশন করে পা কেটে ফেলতে বলেছেন। এতে দুই লাখ টাকার বেশি খরচ হবে। যার সামর্থ তার নেই।
তাঁর স্ত্রী বুলু খাতুন বলেন, প্রথম দিকে লাশ টেনে বাড়ি আসার পর অসস্তি লাগতো। বাড়ির কেউ তাঁর সাথে মিশতো না। এখন সয়ে গেছে। বর্তমান ওসবের চেয়ে জীবন বাঁচানো দুস্কর হয়ে পড়েছে।
লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নুরুজ্জামান রাজু বলেন, তিনি সদ্য থানায় যোগদান করেছেন। মো. হাশেম আলী পুলিশের কাজে সহায়তা দিয়ে এসেছেন। সেবার ব্রত নিয়ে তিনি এই পেশার মাধ্যমে মানুষের উপকার করেছেন। তাঁর এ দুর্দিনে সকলের পাশে দাঁড়ানো উচিত। তাঁর পক্ষ থেকে যতটুকু করা সম্ভব তিনি সহযোগিতায় পদক্ষেপ নেবেন।
অসহায় মো. হাশেম আলীর চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে পুলিশ, প্রশাসনসহ সমাজের হৃদয়বান ও বিত্তবানদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি। সাহায্য করতে যোগাযোগ: মোবাইল- হাশেম আলী- ০১৭১০৬১১৩০৪, ০১৭৩৮৫৩৭৯৯০, ছেলে শুকুর ০১৭৪৬৮৬১৩৬৪ (বিকাশ পার্সোনাল)।


হাশেম আলী তাঁর জীবনের গল্প বলেন, যৌবনের শুরুতে হাশেম খড়ি (জ্বালানী) বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। প্রায় ৪০ বছর আগে একদিন লালপুর বাজারে খড়ি বিক্রি করতে এসে দেখেন ঘোড়ার গাড়ি (টমটম) চালকদের লালপুর থানার এক পুলিশ অফিসার নাটোর মর্গে লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য বলছেন। কিন্তু ঘোড়া গাড়ির চালকরা এতে রাজি না হয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের ধারণা লাশ টানলে ঘোড়া মারা যাবে। অবশেষে এক ঘোড়ার গাড়ির চালক ৭ শ টাকায় লাশ নাটোর মর্গে নিতে রাজি হন। তখন তিনি ভাবলেন, আমি সারাদিন খড়ি বিক্রি করে ৩০-৪০ টাকা উপার্জন করি। আর একটি লাশ টানলে পাবো ৭০০ টাকা। এ চিন্তা থেকেই হাশেম আলী উপজেলার বিলশলিয়া গ্রামের আব্দুল জব্বারের মেয়ে বুলু খাতুনকে ৬ শ টাকা যৌতুক নিয়ে বিয়ে করেন। যৌতুকের ওই টাকা দিয়ে একটি ভ্যান গাড়ি কিনে উপার্জন শুরু করেন। একদিন রাতে লালপুর থেকে গোপালপুর যাওয়ার পথে শিমুলতলা নামক স্থানে দেখলেন, একটি বেওয়ারিশ লাশ মর্গে পাঠানোর জন্য পুলিশ বিভিন্ন ভ্যান চালকদের অনুরোধ করছেন। কিন্তু এতে কেউ রাজি হচ্ছেন না। এমতাবস্থায় সামনে পেয়ে পুলিশ হাশেম আলীকে প্রস্তাব দিলেন। তিনি কোন চিন্তা না করেই তার স্বপ্ন বাস্তব করতে রাজি হয়ে নাটোর মর্গে লাশ নিয়ে যান। প্রথম লাশ টানার জন্য খরচ পান ৬ শ টাকা। সেই থেকে দীর্ঘ ৪০ বছরে ৫ হাজারেরও বেশি লাশ টেনেছেন। লাশ টানার জন্য সরকারি কোন বরাদ্দ পাননি। মৃতের স্বজনদের কাছ থেকে সামান্য টাকা পেয়েছেন। বেওয়ারিশ লাশের ক্ষেত্রে থানা থেকেই কিছু টাকা দেওয়া হতো। অন্য সময় মাঠে কাজ করেছেন।

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.