-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়কালীণ জাপানের উপর রাশিয়ার দৃষ্টি সরানোর নানা পরিকল্পনা হতে নেয় মার্কিনীরা। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় পরিকল্পনা ছিল জাপানকে যেভাবেই হোক ধ্বংস ও পঙ্গু করে দেয়া। এজন্য তারা মরিয়া হয়ে জাপান আক্রমণ করতে বদ্ধপরিকর হয়। অবশেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের নির্দেশে ১৯৪৫ সালের ৬ আগষ্ট হনশু দ্বীপের হিরোশিমা নগরে ‘লিটল বয়’ নামক পারমাণবিক বোমা ছুঁড়ে। এর তিনদিন পর ৯ আগষ্ট কিউসু দ্বীপের নাগাসাকিতে ‘ফ্যাটম্যান’ নামক নামক পারমাণবিক বোমা ছুঁড়ে মাটির সাথে মিশিয়ে সেখানকার দেয় মানুষ ও সেখানকার মানব সভ্যতাকে।
জাপান আগ্নেয়গিরি সঞ্জাত চারদিকে সমুদ্রবেষ্টিত ও খুবই ভূমিকম্পপ্রবণ একটি লম্বা মানচিত্রের দ্বীপ দেশ। যেখানে বড়-ছোট হাজারো দ্বীপের সমাহার রয়েছে। সবচেয়ে বড় চারটি দ্বীপ হলো- হোক্কাইদো, হনশু, কিউশু ও শিকোকু। অতীতকাল থেকে এই দ্বীপগুলো নিজেদের দখলে রেখে শাসন করতো সেখানকার সামন্তপ্রভূরা। ঘন ঘন অগ্নুৎপাত ভূমিকম্প, তাইফু ও সুনামীর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অতীতে জাপানের মানুষ খুব অভাবী ছিল। তাদের মধ্যে গোত্রপ্রীতি ধারণা প্রকট ছিল। দ্বীপে দ্বীপে ভিন্ন গোত্রগুলোর মধ্যে নানা কারণে দ্ব›দ্ব সংঘাত লেগে থাকতো। তবে তারা খুব পরিশ্রমী ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ জাতি হওয়ায় নিজেদের ‘কেন’ বা এলাকাগুলোর উন্নতি সাধন করে সুরক্ষিত করে রাখতো। এজন্য জাপানের প্রায় সব অঞ্চলে অনেক সুরক্ষিত দুর্গ দেখতে পাওয়া যায়।
ষোড়শ শতকে জাপানে সামন্ত প্রভূদের কর্তৃত্ব ছিল অনেক বেশী। তাদের তৈরী প্রাসাদ, দুর্গ ইত্যাদি পরবর্তীতে সোওয়া ও মেইজী আমলে বিভিন্ন দানশীল প্রতিষ্ঠানে রুপান্তরিত হয়। পরবর্তীতে সেগুলোর অনেক জমি ও সম্পদে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ লাভ করে। হিরোসীমা দ্বীপটি জাপানের সবচেয়ে সমতল ও প্রশস্থ দ্বীপ হনশুতে অবস্থিত। জাপানীজ ভাষায় হিরোই অর্থ প্রশস্থ এবং সীমা অর্থ দ্বীপ। এই প্রশস্থ ভূমিতে ‘গো-কাসুন’ বা পাঁচটি মৌজা নিয়ে গড়ে উঠে হিরোসীমা দূর্গ। ১৮৬৮ সালে হিরোসীমা হনশু দ্বীপের বড় সামরিক কেন্দ্র ছিল। তাই এর উপর নজর ছিল রাশিয়া, চীন, কোরীয়া ও মার্কিনীদের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়কালীণ তাই এটা মিত্রবাহিনীর হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
অপরদিকে কিউসু দ্বীপের ‘নাগাসাকি কেন’ বা জেলার সবচেয়ে বড় শহরের নাম নাগাসাকি। নাগাসাকিতে আগ্নেয়পর্বতের কোলে উৎপন্ন ‘ওনসেন’ বা হটস্প্রিং বাথের জন্য বিখ্যাত। সদুর অতীতকাল থেকে নাগাসাকি ছিল বিদেশীদের জন্য জাপানে প্রবেশের সহজ দ্বার। ইউরোপ আমেরিকার বৈদেশীক বাণিজ্য জাহাজের বড় অংশ নাগাসাকি বন্দরে ভিড়তো বলে এই বন্দরের নামডাক খুব বেশী। স্বভাবতই বৈদেশিক আক্রমণ থেকে সতর্কতার জন্য এখানে অনেক সুরক্ষিত ক্যাসেল ও দুর্গ গড়ে তোলা হয়। আধুনিক যুগে জাপানের বড় বড় ‘জো’বা মিউজিয়ামের অবস্থান হয়েছে এসব ক্যাসেল ও দুর্গের ভবনগুলোতে। জাপানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকালীণ অত্র লেখকের সুযোগ হয়েছিল এদো, মেইজী, তাইসো ডাইনেষ্টির বিভিন্ন সামন্ত রাজাদের ঐতিহাসিক ক্যাসেল ও স্থাপনাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখার। জাপানে অধ্যয়নরত বিদেশী শিক্ষার্থীরা সেখানে স্টাডিট্যুর করার সুযোগ পায় এবং ছুটির দিনে পর্যটকগণ সেগুলোতে ভিড় করে থাকেন।
এভাবেই হিরোসীমা ও নাগাসাকি একদিকে দুর্গ ও অন্যদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসিদ্ধির জন্য বিশ্বব্যাপী আকর্ষণ ও পরিচিতি পেয়ে যায়। জাপান অক্ষশক্তির সাথে হাত মেলানোর ফলে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বড় বড় শক্তিধর দেশগুলোর নিকট আক্রোশের শিকার হয়ে শেষমেশ আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে।
ঘটে যায় তখনকার পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী আক্রমণের শিকার হবার ঘটনা। তিন দিনের ব্যবধানে মার্কিনীদের নিক্ষিপ্ত পর পর দুটি পারমাণবিক বোমার আঘাতে হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরদুটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। পারমাণবিক বোমার আঘাতে ২ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষ ও ৯ হাজার জাপানী সৈন্য মৃত্যুবরণ করে। এর পরের ইতিহাস অনেকের জানা আছে। যে ইতিহাসটি হলো পারমাণবিক বিকিরণের ফলে সেখানকার অধিবাসীদের পঙ্গুত্ববরণ করার ইতিহাস ও বিকলাঙ্গ মানুষের জন্ম হবার করুণ ইতিহাস।
এই করুণ ইতিহাসের যেন আর কোন পুনুরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য সারা বিশ্বের মানুষ অদ্যাবধি মার্কিনীদের ছোঁড়া সেসব পারমাণবিক বোমার প্রতি উষ্মা ও ঘৃণা প্রদর্শণ করে থাকে। এজন্য বিশ্বব্যাপী সৃষ্টি হয় প্রতিবাদী আন্দোলন। গড়ে উঠে অনেক মানবহিতৈষী সংগঠন।
পারমাণবিক আঘাতের পর থেকে জাপানের অভ্যন্তরে যে বিষয়টি অতীব ঘৃণা, বৈষম্য সামাজিক বিভেদ ছড়াতে থাকে তা হলো- ‘হিবাকুসাইয়া’ নামক অভিশাপ। এটাকে ‘হাই’-আক্রান্ত, ‘বাকু’-বোমা, ও ‘শা’-ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এভাবে যারা হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় পঙ্গু হয়েছিলন অথবা যারা কোনরকমে বেঁচে গিয়ে নতুনভাবে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন তাদের উপর নেমে আসে ‘হিবাকুসাইয়া’ নামক নানা রকমের দৈহ-মানসিক যন্ত্রণা ও সামাজিক বৈষম্যের খড়গ। ‘হিবাকুসাইয়া’কথিত জেনেটিক সমস্যার গুজব ছাড়িয়ে নানা অর্থনৈতিক, সামাজিক, মানসিক সমস্যার জন্ম দিতে থাকে।
কারণ পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়তার জন্য বিকিরিত রশ্মিকে সর্বজনীন সংক্রমণ ভাবা হতো। তারা সুস্থ সন্তানধারণে অক্ষম ও কর্মক্ষমতাহীন বিবেচিত হওয়ায় হিবাকুসাইয়া প্রজন্মকে কোণঠাসা হতে হয়। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার এত বছর পর জাপানের হিবাকুসাইয়া প্রজন্ম শেষ হবার পথে। ২০২৪ সালে এসে এখন ভয় হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইসরাইলের নৃশংসতায় এআই যুগের পৃথিবীতে রোবটের ভুলে আবার কোন নতুন হিবাকুসাইয়া জন্ম নেয় কি-না!
পারমাণবিক বোমার আঘাতের প্রভাবে সৃষ্ট ‘হিবাকুসাইয়া’ নামক বৈষম্য ও পারমাণবিক যুদ্ধস্ত্রের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করার নিমিত্তে অনেক সংগঠনের মতো ১৯৫৬ সালে সৃষ্টি হয় ‘নিহোন হিদাঙ্কিয়’ নামক জনকল্যাণমূলক সংগঠনটি। যেটি এবছর ২০২৪ সালে এসে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। ‘নিহোন হিদাঙ্কিয়’-র শ্লোগান হলো ‘নো মোর হিবাকুসাইয়া’। এর মনোগ্রামের প্রতীক হলো ‘ওরিজুরু’ বা ওরিগ্যামিক ক্রেণ বা কাগজে ভাঁজ করা বক। ‘নিহোন হিদাঙ্কিয়’-র প্রতীক বক সবার জন্য সুস্থতা ও সৌভাগ্যের প্রতীক। এর দ্বারা শান্তি ও সহনশীলতাকেও বুঝানো হয়ে থাকে। বাস্তবের এই বক সমুদ্রে থেকে দ্বীপ-দ্বীপান্তরে শান্তি ও সৌভাগ্যের বারতা নিয়ে উড়ে বেড়ায়। তারা সেই বার্তা দেয় যাতে পৃথিবীতে আর কোন ‘হিবাকুসাইয়া’ বা সুস্থ সন্তানধারণে অক্ষম ও কর্মক্ষমতাহীন মানুষ জন্ম নিক তা চান না।
বিশেষ করে এবারের নাবেল শান্তি পুরস্কারের ঘোষণাটি এমন সময় এসছে যখন পৃথিবীতে নতুন করে পারমাণবিক বোমা আক্রমণের সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে। ইসরাইলের বর্বরোচিত আক্রমণের ফলে ফিলিস্তিন সহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যে ভয়াবহ অবস্থা তৈরী হয়েছে তার বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কারের সংবাদ এসে অনেকটা নতুন আলোচনা ও ভাবনার জন্ম দিয়েছে। মানুষ নতুন করে কিছু ভাবতে শুরু করেছে।
ইরানের প্রতি ইসরাইলের তাক করা পারমাণবিক বোমার বিপক্ষে ইরান নতুন করে তাদের দিকে একই বোমা তাক করে প্রতিবাদ তৈরী করে আছে। ইসরাইল নিজে কখনও যুদ্ধ করে না। তাকে যুদ্ধ করতে সবসময় রসদ ও অনুপ্রেরণা দেয় মার্কিনীরা ও কিছু ইউরোপীয় দেশ। ফিলিস্তিনে প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষ হত্যার পর মার্কিনী সমর্থনে ইসরাইল এখন লেবানন, ইয়েমেন ও ইরানে আক্রমণ চালাচ্ছে। মার্কিনীদের মারণাস্ত্র বিক্রির ব্যবসা এবং ইসরাইলের প্রতি তাদের নগ্ন সমর্থন প্রতিদিন একেকটি জঘন্য ইতিহাসের জন্ম দিলেও তারা কারো কথায় কর্ণপাত না করে সাধু সেজে মোড়লীপনা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইউরোপীয় দেশ সুইডেন, নরওয়ের এ ব্যাপারে আপত্তি জানানো সত্বেও তারা ইসরাইলকে মাথায় তুলে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের উপর আরো বেশী খড়গহস্ত হয়ে উঠেছে। সারা পৃথিবীর যুদ্ধ-নিপীড়িত মানুষ আবারো যাতে পারমাণবিক হামলার শিকার না হয় সেজন্য ‘নিহোন হিদাঙ্কিয়’-র ২০২৪ সালের শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন অনেকটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে বলে নোবেল কমিটি মনে করলেও তাদের দোসররা দিব্যজ্ঞানে কখনও সেটা মনে করে বলে মনে হয় না। সেটা মনে করতে পারলে এতদিন মার্কিন-রাশিয়াসহ বড় বড় ক্ষমতাধর দেশগুলো দেশে দেশে অনবরত যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে স্বার্থ হাসিল করতে পারতো না।
এ.আই. যুগের পৃথিবীতে রোবটের ভুলে আবার কোন নতুন হিবাকুসাইয়া জন্ম নিক সেটা কোন সভ্য মানুষ চায় না। আমরা আর কোন ট্রম্যান চাই না, নেতানিয়াহু নামক আর কোন অসভ্য বর্বরকে চাই না। পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়তার জন্য বিকিরিত রশ্মিকে আবার সর্বজনীন সংক্রমণ ভাবা হোক এমন বৈষম্যের পৃথিবীকে চাই না।
আমরা চাই ‘নিহোন হিদাঙ্কিয়’নামক আরো অনেক জনকল্যাণমূলক সংগঠন তৈরী হোক। তারা সমস্বরে গর্জে উঠুক ইসরাইলের নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার বিরুদ্ধে। বিশ্ব মানবতার ঘৃণা গর্জে উঠুক মার্কিনীদের অতিচালাকি ও শঠতার বিরুদ্ধে। দিকে দিকে কল্যাণকামী মানুষেরা নিজেদের চেতনা ও শক্তি দিয়ে আগলে রাখুক এই সুন্দর পৃথিবীটাকে। বেঁচে থাকুক এর নিরীহ মানুষগুলো, জেগে থাকুক নিষ্কলুষ মানুষগুলোর আশা-ভরসা চিরদিনের জন্য।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]