-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
সম্প্রতি দুই দিন ধরে রাজধানীতে কলেজে-কলেজে ভয়ংকর মাথাফাটা যুদ্ধ হয়ে গেল। আগের দিন প্রচারণা চলেছে ‘সুপার সানডে’এর পরদিন এর পাল্টায় শুরু হয়েছিল ‘মেগা মানডে’অপারেশন। অনেক দূর থেকে দল দলে গিয়ে শিক্ষার্থীরা একে অপরের কলেজে হামলা চালিয়ে একে অপরকে রক্তাক্ত করেছে, স্থানীয়রাও জড়িত হয়ে মালামাল লুট করেছে, আতঙ্ক ছড়িয়েছে চারপাশে। সেই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির চিত্র অতি কদর্যভাবে জনমনে স্থান করে নিয়েছে। যার রেশ কিছুটা কেটে গেলেও আতঙ্ক এখনও কাটেনি।
রাজধানীর ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের এক শিক্ষার্থী ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। শিক্ষার্থীরা জানান, তাদের কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী অভিজিৎ হাওলাদার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ওই হাসপাতালে ভর্তি হয়। ‘ভুল চিকিৎসায়’অভিজিৎ মারা যায় বলে অভিযোগ করে তারা। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের দাবিতে গত ২৪ নভেম্বর তারা মেডিকেল কলেজটির সামনে বিক্ষোভ করেন। ওই দিন পুরান ঢাকার কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের ওপর হামলা চালান। এর প্রতিবাদে তারা ন্যাশনাল মেডিকেলের সামনে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় আবার পুরান ঢাকার সরকারি শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কলেজসহ আশপাশের কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের ওপর হামলা চালায়।
একদল শিক্ষার্থী কলেজের ভেতর ঢুকে ভাঙচুর চালায় ও একইসঙ্গে কলেজের একটি অ্যাম্বুলেন্সও ভাঙচুর করে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারির ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের গেট ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে ভাঙচুর শুরু করে আরেকদল শিক্ষার্থী । শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কলেজেও ব্যাপক ভাঙচুর চালায়।
ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাহাবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিতের মৃত্যুর ঘটনায় রোববার ঘেরাও কর্মসূচি দেয়া হয়েছিল। ‘পূর্বঘোষিত সেই ‘সুপার সানডে’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজসহ প্রায় দশটি কলেজের শিক্ষার্থীরা সেদিন দুপুরে ন্যাশনাল মেডিকেলের সামনে অবস্থান নেয়। এছাড়া আব্দুর রউফ কলেজ, বিজ্ঞান কলেজ, নটরডেম, সিদ্ধেশ্বরী, ডিএমআরসি, ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ, খিলগাঁও মডেল কলেজ, তেজগাঁও কলেজ, যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল কলেজসহ রাজধানীর বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা ন্যশনাল মেডিকেল কলেজ ঘেরাওয়ে অংশ নেন।’ এছাড়াও সেদিন ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকার ডিএমআরসি কলেজ, নারায়ণগঞ্জ সরকারি কলেজ, খিলগাঁও সরকারি কলেজসহ ৩৫টির বেশি কলেজের শিক্ষার্থীরা সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুল কলেজে হামলা ও ভাঙচুর চালান এবং দুই পক্ষ দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে অন্ত:ত ৪০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।’
কলেজ প্রাঙ্গণে থাকা একটি প্রাইভেট কার, মাইক্রেবাস, অ্যাম্বুলেন্স ও মোটরসাইকেল এ সময় ভাঙচুর করা হয়। এসময় কলেজের ট্রফি, চেয়ারসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে যেতে দেখা যায় হামলাকারীদের। পরে শিক্ষক ও কর্মচারীদের অনুরোধে শিক্ষার্থীরা কলেজ প্রাঙ্গণ ছেড়ে দেন। কলেজে থাকা পরীক্ষার্থীরাও তখন ধীরে ধীরে বেরিয়ে যান।
‘সুপার সানডে’ হামলার পরের দিন ঘোষণা আসে ‘মেগা মানডে’ কর্মসূচির। গত ২৫ নভেম্বর দুপুর ১২টার দিকে এ সংঘর্ষ শুরু হয়। ‘ডেমরায় ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে (ডিএমআরসি) হামলা চালিয়েছেন কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা। দুই পক্ষ দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছেন আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা কলেজটির ভেতরে ঢুকে প্রধান ফটক বন্ধ করে দেন। আর বাইরে থেকে কলেজটি লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়ছেন নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা।’
কথা হলো- পূর্বঘোষণা দিয়ে দলে দলে, কলেজে কলেজে দুইদিনব্যাপী হামলা, তুমুল মারামারি হলো, ঠেকানো গেল না কেন?
এই ঘটনার সময় কেউ কারো কথা শুনেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। অতি উত্তেজিত ছাত্র-জনতা ‘মব’হয়ে উঠেছিল। আরো অভিযোগ রয়েছে যে, রাজনৈতিক ইন্ধন যুগিয়ে এই আন্দোলনকে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত করতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন একটি স্বাথান্বেষী গোষ্ঠী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সংঘাতের মধ্যে ‘সুপার সানডে’ ঘোষণা এবং এর পরদিন ঘোষিত হয়েছিল ‘মেগা মানডে’ নামক পাল্টা অপারেশন! বিষয়টি খুব গভীরভাবে দেখা শুরু হয়ে যায় যখন এর সাথে শত শত বাসভর্তি নিরীহ মানুষকে লোন দেবার নামে গভীর রাতে রাজধানীতে হঠাৎ জড়ো করা শুরু হয় তখন।
রাজধানী জুড়ে নির্বিঘ্নে সংঘঠিত ‘সংঘবদ্ধ’ এমন হামলা-পাল্টা হামলার পর প্রশ্ন উঠেছিল, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ‘খবর থাকলেও’ রক্তক্ষয়ী এ সংঘর্ষে ঠেকান গেল না কেন? সংঘাতময় পরিস্থিতিতে তথ্য জানা থাকার পরও কেন থামনো গেল না এমন অপ্রীকিতর এমন ঘটনা। এজন্য পুলিশের কার্যকর পদক্ষেপ না থাকাসহ বেশ কিছু বিষয় সামনে এনেছেন সংশ্লিষ্টরা। মিছিল নিয়ে সাত কিলোমিটার দূরত্বের কলেজে তান্ডব চালানো হল, চোখের সামনে দিন দুপুরে রক্ত ঝরল শতাধিক শিক্ষার্থীর, ভাঙচুর-লুটপাট চলল নির্বিচারে- এমন অবস্থা কোন পক্ষ থেকে প্রতিরোধ করার কোন প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়নি কেন? ছাত্র সমন্বয়কদের বলিষ্ঠ ঘোষণা কেন সেদিন শোনা যায়নি? রাজনৈতিক দলগুলো থেকে আন্দোলনরত কলেজ শিক্ষার্থী, স্থানীয় জনতাকে নিবৃত্ত করার কোন তৎপরতার কথাও শোনা যায়নি কেন? ..‘এ হামলায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ এবং ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের কিছু ছাত্র নামধারী ব্যক্তি নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের মদদে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। হামলাকারীদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী নয়, বরং সন্ত্রাসী কার্যক্রমে লিপ্ত ব্যক্তিবর্গ।’
পর পর দুইদিন ৩৫টির বেশি কলেজের শিক্ষার্থীদের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ থাকায় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে নগরবাসীকে। যানবাহনসহ ভাঙচুর করা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সরঞ্জাম। হামলার শিকার হয়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া ‘ড. মাহাবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের ছাত্র-শিক্ষকরা এজন্য দুষছেন ‘সরকারের দুর্বলতাকে’। তারা বলছেন, পুলিশের সহায়তা চেয়েও সময়মত পাননি। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে হামলা চালিয়ে নির্বিচারে মারধর, ভাঙচুর ও লুটপাট কলেজটির ধারেকাছেই ভেড়েনি পুলিশ।’ …”ফেইসবুকে ঘোষণা দিয়েছিল তারা, এটা সবাই জানে। তারা হামলা করলে আমরা পুলিশকে আসতে বলি ৯৯৯-এ কল দিয়ে। পুলিশ এসেছে অনেক পরে।” তবে কর্তৃপক্ষ বলেছেন, “যাত্রাবাড়ী মোড়ে ব্যারিকেড দিয়ে প্রায় হাজারখানেক ফোর্স অবস্থান করছিল। আমরা ভেবেছিলাম, শিক্ষার্থীরা আসলে হয়ত তাদেরকে বুঝিয়ে আটকে দেওয়া সম্ভব হবে। তাতে কাজ না হওয়ায় তারা জোর করলে আর আটকে রাখা পুলিশের পক্ষে সম্ভব হয়নি।’ ম্যজিষ্ট্রেসী পাওয়ার থাকলেও এই ঘটনায় অন্যান্য বহিনীর কেউই ছাত্রদের সাথে সংঘাতে জড়াতে চায়নি। তখন জরুরী সভাও করেনি। এত বড় ঘটনার ঘনঘটায় ধ্বংসযজ্ঞ থামাতে মধ্যস্থতা করার কেউ এগিয়ে আসেনি তখন!
এমনকি এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলমান উত্তেজনা প্রশমনে তিন কলেজের অধ্যক্ষকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বৈঠকে বসার আমন্ত্রণে রাজি হননি সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুল কলেজের দুই অধ্যক্ষ। কবি নজরুল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ বলেছেন, এমন তান্ডবের পর বিচার না হওয়া পর্যন্ত বৈঠকে বসতে রাজি নন তিনি।’
তাহলে এধরনের মারামারি, সৃষ্ট যানজট, ভাংচুর, রক্তপাত, সম্পদের ধ্বংসলীলা- বিশেষ করে নৈরাজ্যকজর পরিস্থিতি তৈরী করে শিক্ষাক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করাটা কার স্বার্থে চলল? এর উত্তর খুঁজতে না পারা ব্যর্থতা কার ঘাড়ে কে দেবে?
এমনিতেই নানা বিষয়ে সংস্কারে হাত দেয়া হলেও শিক্ষাখাতে কোনরুপ সংস্কারে হাত দেবার প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। অথচ, শিক্ষার্থীদের ত্যাগের মাধ্যমে মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার ভিত্তি সুদৃঢ় হয়েছে, প্রথম স্বাধীনতা, দ্বিতীয় স্বাধীনতা সবকিছুর মধ্যে শিক্ষার্থীদের গর্জে উঠার বিষয়টি সর্বপ্রথম প্রাধান্য পেয়েছে। তরুণ শিক্ষার্থীরাই আজকের নতুন বাংলাদেশকে সামনে তুলে ধরার চেষ্টায় রত রয়েছে।
তবে কেন শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ কলেজের নামে দল বেঁধে পরস্পরের বিরুদ্ধে ধাবংসলীলায় মেতে উঠেছিল? পাঁচ আগষ্ট থেকে মাত্র তিন মাস পার হলো। এর মধ্যেই কলেজ কেন্দ্রিক যে বিশৃংখল পরিস্থিতি তৈরী হলো তা খুবই বেদনাদায়ক। এত দ্রুত কলেজ শিক্ষার্থীদের এই ভগ্নদশা কিসের ইঙ্গিত বহন করে। এই অরাজকতা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। তাহলে আমাদের এতবড় অর্জন কি এতই ঠুনকো হয়ে যাবে?
কলেজে কলেজে মারামারি, আন্দোলন, সংঘাত বেড়েই চলেছে। গণতন্ত্রের শত্রæ-মিত্রদের না চিনেই ভোটের মাঠে নামলে সামনে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
দেশে এখন সেই অর্থে রাজনীতির চর্চ্চা নেই। শুধু কথায় কথায় রাস্তায় দাবী আদায়ের মহরৎ চলায় শুরু হয়েছে চরম রাজনৈতিক সংকট। সেই সুযোগে বাড়ছে অস্থিরতা। এখনও ৫ আগষ্টের অঙ্গহারা আহতরা হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। পতিত সরকারের অনুচররা সুবিধা নিচ্ছে। অন্তবর্তী সরকারের মিত্ররা এখনও উপেক্ষিত হচ্ছে। শত্রু-মিত্র না চিনে শিক্ষার্থীরা নিজেরা মারামারিতে লিপ্ত হতে থাকলে কোন ভবিষ্যতের দিকে আমরা অগ্রসর হচ্ছি? মনে রাখতে হবে এসব ‘সুপার সানডে’ ও ‘মেগা মানডে’ মারামারিতে লাভটা আসলে কার?
তাই সকল অস্থিরতা ঝেড়ে ফেলে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইস্পাতকঠিন ঐক্যকে ধরে রাখা এখন মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করা উচিত। বর্তমানে তরুণ-প্রবীণদের সমন্বিত স্বরে বাংলাদেশ তথা বিশ্ব মানবতার ঘৃণা গর্জে উঠুক সকল প্রকার লোভ, নৈরাজ্য, অরাজকতা, বৈষম্য, দুর্নীতি, নিষ্ঠুরতা ও শঠতার বিরুদ্ধে। দিকে দিকে কল্যাণকামী মানুষের ছায়ায় তরুণ প্রজন্ম নিজেদের চেতনা ও শক্তি দিয়ে আগলে রাখুক এই সুন্দর দেশ ও পৃথিবীটাকে। বেঁচে থাকুক ক্রমাগত দারিদ্র, বঞ্চনা ও রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার হওয়া এর নিরীহ মানুষগুলো, জেগে থাকুক নিষ্কলুষ মানুষগুলোর আশা-ভরসা নিয়ে বুকভরা মানবতা চিরদিনের জন্য।
*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]