বৃহস্পতিবার | ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫ | ২ মাঘ, ১৪৩১

বিশ্ব ইজতেমার ভবিষ্যৎ কি?

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
তুরাগ নদীর তীরে গত ১৭ ডিসেম্বর ভোরবেলা তাবলীগ জামাতের দুই গ্রæপের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়ে গেল। দীর্ঘদিন যাবত তাবলীগ জামাতের মধ্যে বিভেদ ও দ্ব›দ্ব চলে আসছিল। একপক্ষ আরেক পক্ষকে বাতিল ও নিজেরা হক হিসেবে মনে করা থেকে নানা বক্তব্যের জেরে এই দ্ব›দ্ব চরমে রূপ নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এর সংগে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে উদ্ভুত নতুন কিছু অনুষঙ্গ। দেশের বর্তমান পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রতিবেশী দেশের সংগে সম্পর্ক অনেকটা শিথীল থাকা অবস্থায় এবং সেই দেশের ধর্মীয় নেতার সমর্থনকারী হবার অজুহাতে এই ঘটনাটি একটি ব্যাপক জল্পনা কল্পনার অবকাশ তৈরী করেছে।
গেল ১৭ ডিসেম্বর মঙ্গলবার দিবাগত রাত রাত ৩টার দিকে ভারতীয় মাওলানা সাদপন্থিরা টঙ্গির তুরাগ নদীর পশ্চিম তীর থেকে কামারপাড়া ব্রীজসহ বিভিন্ন রাস্তা ধরে ইজতেমা ময়দানে প্রবেশ করতে থাকে। তখন ময়দানে বহু মুসুল্লি চটের সামিয়ানার নিচে ঘুমাচ্ছিলেন। ভোর চারটার দিকে এ সময় ময়দানের ভেতর থেকে বাংলাদেশী মাওলানা যোবায়েরপন্থিরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। জবাবে মাওলানা সাদপন্থিরাও পাল্টা হামলা চালায়। একপর্যায়ে মাওলানা সাদপন্থিরা ময়দানে প্রবেশ করলে উভয়পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। দুই গ্রুপের এই সংঘর্ষে চারজন নিহত ও ৫০ জন আহত হয়েেেছন বলে জানিয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যম।
অন্তবর্তী সরকারের আইনশৃংখলা বাহিনী ও বিজিবি বিশ্ব ইজতেমা মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ১৮ ডিসেম্বর মাওলানা সাদ ও মাওলানা জুবায়েরপন্থিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং জোড় ইজতেমা বন্ধ করে সবাইকে মাঠ ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন। টঙ্গি ও আশেপাশের এলাকায় সভা, মিছিল, জমায়েত করা নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। তুরাগ তীরে গভীর রাতে রক্তের খেলা নিয়ে কেন এমন নির্মমতা শুরু হলো তা বাংলাদেশ সহ বিশ্বের আপামর মুসলমান ও শান্তিকামী সবাইকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে।
তাবলীগ জামাতকে বলা হয় সবচেয়ে বড় অরাজনৈতিক একটি ধর্মীয় সংগঠন। সেখানে প্রতিবছর ইজতেমার সময় সব রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী মুসলিমগণ যোগ দিয়ে থাকেন। পবিত্র হজের পর তুরাগের তাবলীগ সম্মেলন মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বাইরে তাবলীগের শিক্ষা ও আদর্শ প্রচারিত হওয়ায় এর একটি বৈশ্বিক পরিচিতি রয়েছে। প্রতিবছর বিশ্বের প্রতিটি কর্ণার থেকে ৭০-৮০টি দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান টঙ্গির তীরে আসেন ইসলামের শান্তির বাণী শুনে নিজেকে সুশীতল করে সেই বাণী পুনরায় সারা বিশ্বের মানুষের মাঝে দ্বীনি দাওয়াত হিসেবে প্রচারের জন্য। বিগত কয়েক দশকে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর মাধ্যমে তাবলীগের অনুসারীর সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসলামের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ বেছে আরো অনেক বেশী।
তাবলীগ পরিচালিত হয় মুরুব্বীভিত্তিক একটি ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে। যেখানে মুরুব্বির আদেশ, ইসলামের বয়ানকে বেশ শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সাথে গ্রহণ করে কঠোর ধর্মীয় নিয়মানুবির্তিতার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি চালিয়ে মুসুল্লিরা নিজেকে সংশোধন করে নেন। বক্তিগত জীবনে ইসলামের গভীর চর্চ্চার সাথে পরিবার ও সমাজ জীবনে এর ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়। এর আন্তর্জাতিক চরিত্রও বেশ প্রশংসনীয় হয়ে উঠেছে। সাথে এত বড় মুসলিম জমায়েতকে পরিচালনা করার সক্ষমতা ও সামর্থ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের মর্যাদাও বেড়ে গেছে।
তবে দিন বদলেছে। ইসলামের নামে অসংখ্য দল, উপদল সৃষ্টি হয়েছে। অনেক জায়গায় কিছু উগ্রপন্থি লোকেরা ইসলামের নামে নানা সংগঠন খুলে বসেছেন। এতে এর সমালোচনা করতে দেখা যায় বিভিন্ন ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে। এত কিছুর পরেও তাবলীগকে বিতর্কিত হতে দেখা যায়নি। কারণ, কেউ তাবলীগের বিরুদ্ধে খুনসুটি বা বিরুদ্ধাচারণ করে কথা বললেও সেখানে পাল্টা বা প্রতিবাদ না জানিয়ে বরং মুব্বিদের সাথে পরামর্শ করে অত্যন্ত আদবের সাথে বিষয়টির সমাধান করার ব্যাপারে জোর দেয়ার নিয়ম রয়েছে। এর উপর প্রকাশনাও খুব হাতেগোনা। তাই তাবলীগী বিষয় নিয়ে পারস্পরিক দ্ব›দ্ব-কলহ হবার নজির খুব কম।
কিন্তু খুনসুটি, ফতোয়া ইত্যাদি পেরিয়ে কয়েক বছর আগে থেকে গোটা তাবলীগ জামাত হঠাৎ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। তাদের গোলমাল জটিল আকার ধারণ করলে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয় সেসব সমস্যা নিরসণে। রাষ্ট্র দু’পক্ষের মুরুব্বীদের নিয়ে দুই দলকে আলাদা আলাদা সময়ে ইজতেমা করার নির্দেশনা দেন। গেল কয় বছর ধরে দুটি ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল।
কিন্তু দিনে দিনে মানুষ খুব অস্থির ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। করোনা পরবর্তী সময়ে এই অস্থিরতা সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে সামান্য বিষয়ে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে। দিকে দিকে যুদ্ধ বিগ্রহ ও ধর্মীয় আবরণে নানা সহিংস ঘটনার জন্ম নিয়েছে এবং প্রতিনিয়ত সেসব সহিংসতা ভয়াবহ আকার ধারণ করে হিংসা ও প্রতিহিংসার জন্ম দিচ্ছে।
তাবলীগ জামাত হঠাৎ দ’ুভাগে ভাগ হয়ে যাবার পর থেকে পারস্পরিক বিদ্বেষ মেটানোর কোন উপায় কেউ গ্রহণ করতে এগিয়ে আসেনি। তৎকালীণ সরকারও না বর্তমান সরকারও না। গত মাসে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মাওলানা যোবায়েরপন্থিদের বৃহৎ সমাবেশ থেকে বড় উত্তেজনা তৈরী হলে সেটা নিরসণে শুধু ছাত্র সমন্বয়কদের কয়েকজনকে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেটা স্থায়ী হয়নি। সরকার তাৎক্ষণিকভাবে প্রো-একটিভ হয়ে উঠলে এই সংকট এড়ানো যেত বলে মনে হয়। যার ফলস্বরুপ টঙ্গী ময়দানে হঠাৎ বড় সহিংসতা ও রক্তপাত হয়েছে বলে বিশ্লেষকগণ মনে করছেন। এটাকে বার বার খুনসুটি ও ফতোয়া থেকে বিস্ফোরণের দায় হিসেবে মেনে নিতে হবে রাষ্ট্রকেই। একটি অরাজনৈতিক সরকার ভিন্নদিকে মনোনিবেশ করার সুবাদে আমাদের সামাজের এত বড় একটি ইস্যুকে জিইয়ে রেখে রাষ্টীয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন বলে অনেকে মনে করছেন।
এর সাথে প্রতিবেশী দেশের সাথে দূরত্ব তৈরীর বিষয়টিকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। কিছুদিন পূর্বে চট্টগ্রামে একজন আইনজীবিকে হত্যা করার কাজটিও ছিল ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভিন্ন একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর মদদে ঘৃণ্য ঘটনা। এর আলামত ৫ আগষ্টের পট পরিবর্তনের পর থেকে বেশ গভীরভাবে লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছিল। সেদিন কাকডাকা ভোরে তুরাগ মাঠে টুপি দাড়ি পড়ে কারা আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণে মানুষ হত্যায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল তা কি তদন্ত করে বের করা দরকার। এটা খুব কঠিন কাজ নয়। রাষ্ট্র এই কাজে সময় পাননি বলে কোন ধরণের এক্সকিউজ চাইবেন সেটা এই ঘটনায় অন্তত: মানায় না।
এর সাথে আমাদের দেশে কিছু ধর্মীয় রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী অন্য ধর্মীয় দল বা গোষ্ঠীকে সবসময় আন্তরিকভাবে মেনে নিতে পারে না। তারা সব সময় বাড়াবাড়ি করে ধর্মীয় বিভেদ ছড়ায়। সে বিষয়টিও মাথায় রেখে কাজ করা উচিত।
এই মুহূর্তে টঙ্গীর সহিংস ঘটনায় আসলে করণীয় কি? ইজতেমা কি তাহলে এবছর হবে না? যদিও হত্যা মামলা রুজু হওয়ায় এই ঘটনা একটি আইনী সমস্যা তৈরী করেছে তবুও এটাকে শক্ত হাতে সমাধান করতে তৎপরতা চালাতে হবে। কারণ, তুরাগ তীরের এই মর্মান্তিক ঘটনা শুধু আমাদের দেশে নয়- আন্তর্জাতিকভাবে ভুল বার্তা ছড়ানোর কাজ করছে। প্রতিবেশী দেশের অসংখ্য গণমাধ্যম এই সরকারের প্রতি অত্যন্ত বিরোষ হয়ে শুরু থেকে ন্যক্কারজনক প্রচারণা চালানোর কাজে সায় দিয়ে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচার চালাচ্ছে। প্রতিবেশীর সংগে দূরত্ব সৃষ্টির এই নাজুক সময়ে টঙ্গীর ঘটনার কাভারেজ শুধু ইসলামোফোবিয়া থেকেই নয় বরং পালিয়ে থাকা দেশী দের মাধ্যমে ঘৃণ্য রাজনৈতিক দাবাখেলায় মত্ত হবার উপাদান হিসেবে কাজে লাগানো হচ্ছে।
মুসলমানরা আজকাল এক অপরের ভাই নয়- বরং পরস্পরের দুশমন হিসেবে বিবেচিত হবার জাহেলিয়াত যুগের ঘটনা সদৃশ ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিনিয়ত বিভেদ সৃষ্টির কাজে রত হয়ে পড়েছে। মুসলমানরা নিজেদের অজ্ঞতাবশত: অনৈসলামিক কাজে বিধর্মীদের সাথে হাত মিলিয়ে সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করে চলেছে পবিত্র ইসলামের।
তাই তাবলীগ ইস্যুতে মুসলিম বিশ্বের ঐক্য খুব জরুরী হয়ে দেখা দিয়েছে। ইসলামের নামে বিভেদসৃষ্টি, মারামারি, রক্তপাত মুসলমানদের কাজ নয়। যারা তুরাগের ময়দানে কলহ করে এটাকে কারবালা ময়দানের শহীদি মৃত্যুর মতো রংদিয়ে খোঁড়া অজুহাত নিয়ে দিনাতিপাত করছেন তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। ইজতেমাওয়ালারা কেন পরস্পর বিগড়ে গিয়ে তাদের শান্তির ধর্মপ্রচারের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছেন তা বোধগম্য নয়। তারা কেন দেশী-বিদেশী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে দহরম মহরম করতে গিয়ে তাবলীগের ইমেজ খুইয়ে নিজেরা অপবাদ মাথায় নেবেন?
কিংবা ভিনদেশী গণমাধ্যমের বৈরিতায় অপপ্রচারের শিকার হয়ে জঙ্গিবাদের ক্রীড়নক হয়ে যাবেন-সেটাও বোধগম্য নয়। সেজন্য সকল তাবলীগি ভাইদের প্রতি আবেদন তারা যেন সময় থাকতে সকল দ্ব›দ্ব-সংঘাত ভুলে আত্মশুদ্ধির পথে ফিরে এসে ইসলামের শান্তির বাণী প্রচারে মনোযোগী হোন-এটাই চাওয়া। একটি সুদৃঢ় ঐক্যের মাধ্যমে টঙ্গীর তুরাগ তীরের ইজতেমা ময়দান আবারো ইসলামের সুমহান বাণীর সুরে সরব হয়ে উঠুক বিশ্ব ইজতেমার সুন্দর ভবিষ্যৎকে জাগিয়ে রাখুক সেই প্রত্যাশা।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.