বাবা বহুভাষাবিদ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ছেলে শিল্পী মুর্তজা বশীর। দুজনই খ্যাতিমান। মুর্তজা বশীরের বিভিন্ন সময়ের লেখায় নিবিড়ভাবে ধরা পড়েছে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। এসব লেখা নিয়ে প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হয়েছে ‘ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ: বাবার কাছে ফেরা’ বইটি। এ বই পড়লে পাণ্ডিত্যের খোলসহীন এক পিতা, অন্য এক শহীদুল্লাহর অবয়ব ভেসে ওঠে।
‘আমার বাবা ও আমি’ শিরোনামে বইয়ের প্রথম লেখাটি মুর্তজা বশীর শুরু করেছেন এভাবে, ‘আজ আমার আর কোনো লজ্জা নেই, যদি কেউ আমাকে পরিচয় শেষে বলেন, আমি মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে। কিন্তু এককালে করতাম।’ বিখ্যাত বাবার সন্তান হিসেবে মুর্তজা বশীর মোটেই সহজ ছিলেন না। চালচলনে ছিল ঔদ্ধত্য আর অহমিকা। স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যে পিতা ও পুত্র একেবারেই ছিলেন বিপরীতমুখী। তবে পিতা হিসেবে শহীদুল্লাহ পুত্রের স্বাধীন সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিয়েছেন সব সময়।
শৈশবে একবার বাড়ি ছেড়ে পালালেন মুর্তজা বশীর। যখন বাড়ি ফিরে বুকে ভয় আর অপরাধবোধ নিয়ে দাঁড়ালেন পিতার সামনে, শহীদুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় গিয়েছিলে?’ মাথা নিচু করে মুর্তজা বশীর জবাব দিলেন, ‘লক্ষ্ণৌ পর্যন্ত।’ বাবা বললেন, ‘আগ্রায় গিয়ে তাজমহল তো দেখতে পারতে।’
আবুল খয়র মুর্তজা বশীরুল্লাহ, বাবার দেওয়া এই বংশীয় ভারিক্কি নামের মেদ ঝরিয়ে একসময় নিজেকে পাল্টে ফেলেন ছেলে, নাম তখন তাঁর মুর্তজা বশীর। তো একদিন তাঁদের বাড়িতে চিঠি এল তাঁর এই নতুন নামে। বাবা নাম দেখে ফিরিয়ে দিলেন সেটা। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন মুর্তজা বশীর। ছোঁ মেরে চিঠিটা নিলেন নিজের কাছে। বললেন, ‘দেখি, এটা আমার চিঠি।’ শহীদুল্লাহ অবাক হয়ে তাকালেন ছেলের দিকে। বললেন, ‘তোমরা চিঠি! তুমি মুর্তজা বশীর কবে থেকে হলে!’ অকম্পিত গলায় সম্রাট শাহজাহানের সামনে যেন বিদ্রোহী সন্তান আওরঙ্গজেবের মতো করে উত্তর দিলেন ছেলে, ‘…উল্লাহ কেটে দিয়েছি। নিজের পরিচয়ে দাঁড়াতে চাই।’
এতে পিতা শহীদুল্লাহ খুশি হননি, তবে মেনে নিলেন ছেলের সিদ্ধান্তকে। ঠিক করে দিলেন নামের বানানও।
শিল্পী ছেলের জীবনযাপন নিয়ে বাবা সব সময় শঙ্কিত থাকতেন। একবার লাহোরে সাক্ষাৎ হলো পিতা-পুত্রের। পিতা কোনো কুশল বিনিময় করলেন না। জানতে চাইলেন না কাজের খবর। সোজা প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি নাকি বেজায় মদ খাও?’ মুর্তজা বশীর চতুরতার আশ্রয় নিয়ে বললেন, ‘আমাকে দেখে আপনার কী মনে হয়?’
এ সময় ছেলেকে শহীদুল্লাহ বললেন, ‘তোমার মুর্তজা নামের বানানে ম-এর নিচে দীর্ঘ ঊ-কার দাও কেন? মূর্খের বানানে ম-এর নিচে দীর্ঘ ঊ-কার হয়। তুমি তো মূর্খ নও, তাই তুমি ম-তে লিখবে হ্রস্ব উ-কার।’ উল্লেখ্য, নিজের প্রবর্তিত নামটি প্রথমে ছেলে লিখতেন দীর্ঘ ঊ-কার দিয়ে—মূর্তজা বশীর। পরে বাবার যুক্তির কাছে হেরে গিয়ে নামের বানান সংশোধন করেন তিনি।
একদিন পিতা-পুত্র মিলে গেলেন ব্রিটানিয়া হলে ‘সুইস ফ্যামিলি রবিনসন’ ছবি দেখতে। ছবি দেখা শেষ করে পিতা-পুত্র ফিরছেন ঘোড়া গাড়ি চড়ে। এমন সময় হঠাৎ পিতা পুত্রকে প্রশ্ন করলেন, ‘শিস বাজাতে পারো?’ তারপর শহীদুল্লাহ আনমনে শিস বাজাতে লাগলেন। তবে পুত্রকে সতর্ক করতে ভুললেন না যে যখন-তখন শিস বাজানো খারাপ।
পিতা হিসেবে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চেয়েছিলেন সামাজিক ও পরিশীলিত হয়ে সন্তান বেড়ে উঠুক। শিল্পী হোক তা চাননি। প্যারিসে থাকার সময় তিনি দেখেছিলেন শিল্পীদের জীবন কত মানবেতর ও কষ্টসাধ্য। কিন্তু ছেলে তখন শিল্পী হওয়ার সিদ্ধান্তে অবিচল। তত দিনে আবার আস্থা রেখেছেন মার্ক্সবাদে। চোখে সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন। দলের নির্দেশ ভর্তি হতে হবে আর্ট কলেজে। ছেলের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ মাথায় রেখে কঠিন দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হলেন বাবা। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, ‘বেশ। তবে সিনারি এঁকো।’ হাতে তুলে দিলেন ভর্তির টাকা।
এই বাবাই ছেলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন বিবস্ত্র রমণীর ছবির বই। কারণ, তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, অন্যদের কাছে যেটি নেকেড, ছেলের কাছে সেটি ন্যুড।
শিল্পী ছেলের জীবনযাপন নিয়ে বাবা সব সময় শঙ্কিত থাকতেন। একবার লাহোরে সাক্ষাৎ হলো পিতা-পুত্রের। পিতা কোনো কুশল বিনিময় করলেন না। জানতে চাইলেন না কাজের খবর। সোজা প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি নাকি বেজায় মদ খাও?’ মুর্তজা বশীর চতুরতার আশ্রয় নিয়ে বললেন, ‘আমাকে দেখে আপনার কী মনে হয়?’ তিনি পুত্রের চতুরতা বুঝতে পারলেন, কিন্তু কোনো জবাব দিলেন না।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নিয়মিত ছেলের কাজের খোঁজখবর রাখতেন। একবার এক প্রদর্শনীতে ‘ডেড লিজার্ড’ ছবিটি দেখে ছেলের কাছে ছুটে গিয়ে বলেছিলেন, ‘জানো, তোমার সেই ছবিটা কিছুতেই ভুলতে পারি না। আমার ভেতরটা নড়ে ওঠে।’
মুর্তজা বশীর শেষ বয়সে প্রবলভাবে ফিরে এসেছিলেন এই উপলব্ধিতে, ‘আজ আমার বলতে মোটেই দ্বিধা নেই—আমি মুর্তজা বশীর, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পুত্র। কোনো কুণ্ঠা আজ এতে নেই।’
‘ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ: বাবার কাছে ফেরা’
মুর্তজা বশীর
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
দাম: ২৫০ টাকা।