ইমাম হাসান মুক্তি :
প্রথম বাংলাদেশি ও বিশ্বের প্রথম মুসলিম নারী হিসেবে বিশ্বের ১৭৮টি দেশ ভ্রমণের রেকর্ড গড়েছেন নাজমুন নাহার।
অস্ট্রেলিয়ার ঠিক উত্তরে এবং ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত পাপুয়া নিউগিনি অপূর্ব সুন্দর একটি দেশ। ২০২৪ সালের ৯ নভেম্বর তিনি ১৭৮তম দেশ হিসেবে পাপুয়া নিউগিনি ভ্রমণের মাধ্যমে এ রেকর্ড গড়েন।
পাপুয়া নিউগিনির উপপ্রধানমন্ত্রী জন রোসো এক বিশেষ সাক্ষাতে নাজমুন নাহারকে বিশ্ব ভ্রমণের এই বিরল রেকর্ড অর্জনের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন।
সর্বশেষ অভিযাত্রায় গত তিন মাস তিনি ভ্রমণ করেছেন ওশেনিয়া মহাদেশের ফিজি, টোঙ্গা, ভানুয়াতু, সলোমন আইল্যান্ড ও পাপুয়া নিউগিনি।
নাজমুন ২০১৮ সালের ১ জুন ১০০তম দেশ ভ্রমণের মাইলফলক সৃষ্টি করেন জাম্বিয়া ও জিম্বাবুয়ের সীমান্তের ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের উপর। ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর ১৫০তম দেশ হিসেবে ‘সাওটোমে অ্যান্ড প্রিন্সিপ’ ভ্রমণের মাধ্যমে ঐতিহাসিক মাইলফলক সৃষ্টি করেন। এরপর ২০২৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ১৭৫ দেশ ভ্রমণের আরেকটি মাইলফলক স্পর্শ করেন।
রোববার (২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) নাজমুন নাহার তাঁর ১৭৮তম দেশ ভ্রমনের অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, ‘পাপুয়া নিউগিনির এ’লে সমুদ্র তীরের শহর জুড়ে অপূর্ব সন্ধ্যাময় মুহূর্তের মাঝে আমি হেঁটে বেড়ালাম। রাজধানী পোর্ট মোর্সবী স্থানটা খুবই অসাধারণ রোমান্টিক আর মায়াময়। পিছনে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে জড়িয়ে আছে ঘর বাড়িগুলো আর সামনে সমুদ্রের নীল পানির উত্তাল ঢেউ। যখনই সন্ধ্যা নেমে এসেছে এই শহরে নিয়ন আলোর মাঝে আমার হেঁটে চলা পৃথিবীর এই নতুন প্রান্ত আমাকে মুগ্ধ করেছে। এখানকার প্রকৃতি, মানুষের জীবন, সমুদ্র, পাহাড় পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে একটু ভিন্ন। এখানে ছন্দ আছে, রূপকথার গল্পের মত এই শহরে আসতে পারাই ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। তবুও এই শহরের রূপের মাঝে এখানকার মানুষ আর তাদের জীবনের এই সময়টুকু দেখতে দেখতে স্মৃতির ঝুড়িতে এদেশের গল্প কথা নিয়ে ফেরা, আর দুচোখ ভরে এই নতুন শহরকে দেখাই যেন আমার স্বপ্নের মাঝে খুঁজে পাওয়া ছন্দের মিলের মত এক প্রশান্তি। আমার ক্লান্ত দুটি পা যেন এই মাটিতে এসে নতুন করে স্পন্দন খুঁজে পেল আবার নতুন কোন দেশে যাওয়ার উদ্দীপনায়।’
নাজমুন বিশ্বভ্রমণের স্বপ্ন পূরণে ছুটেছেন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। বিশ্ব শান্তি, ঐক্য ও নারীর ক্ষমতায়নে কুড়ি বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের ইতিহাস, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি।
দুর্গম পাহাড়, তুষারে আচ্ছন্ন শহর, উত্তপ্ত মরুভূমি, বিশাল সমুদ্র, বিষাক্ত পোকামাকড় কিংবা প্রতিকূল পরিবেশ কোনোকিছুই তাঁর বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। মহামারি করোনাও তাঁর লক্ষ্যে ছন্দপতন ঘটাতে পারেনি। অভিযাত্রায় বিভিন্ন ঝুঁকি আর মৃত্যুমুখে পতিত হয়েও হাল ছাড়েননি।
ভ্রমণের শুরু:
২০০০ সলে ভারতের ভুপালের পাঁচমারিতে ‘ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল এডভেঞ্চার’ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে তাঁর প্রথম বিশ্ব ভ্রমণের সূচনা হয়। সেখানে তিনি প্রথম বিশ্বের ৮০ দেশের ছেলে মেয়ের সামনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
বাংলাদেশ, বিশ্বশান্তি ও পরিবেশ মিশন:
বাংলাদেশের পতাকা হাতে তিনি বিশ্ব শান্তির এক অনন্য দূত হিসাবেও কাজ করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন মহাদেশে লক্ষাধিক শিশু কাছে বাংলাদেশের পতাকাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। পথে পথে স্কুল, কলেজ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে বিশ্ব শান্তির বার্তা পৌঁছে দেন। পরিবেশ রক্ষায় ও বাল্যবিবাহ রোধে সচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখেন। বিশ্বভ্রমণে শিশু ও তরুণদেরকে উৎসাহিত করেন।
একটানা ১৫টি দেশ ভ্রমণ:
গত ২০ বছর তিনি পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে চলেছেন নাজমুন নাহার। এ পর্যন্ত ১৫০টি দেশের মধ্যে ১৪টি দেশ ভ্রমণে সঙ্গী ছিলেন তাঁর মা তাহেরা আমিন। সর্বোচ্চ ৩৬ থেকে ৫৮ ঘণ্টা বাসে ভ্রমণ করেছেন এক দেশ থেকে আরেক দেশে। টানা পাঁচ মাস সড়কপথে ১৫টি দেশে ভ্রমণ করেছেন।
ভ্রমণের খরচ:
তিনি ২০০৬ সালে সুইডেনে পড়াশোনাকালে খণ্ডকালীন কাজ করতেন। প্রতিদিন ১৭ থেকে ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করে শুধু ভ্রমণ করার জন্য টাকা জমাতেন। পৃথিবীর বিভিন্ন ট্রাভেলার্স হোস্টেলে কম খরচে থেকেছেন। কখনো তাঁবু করে, কখনো কোচ সার্ফিংয়ের মাধ্যমে থেকেছেন। কম খরচে পৃথিবী ভ্রমণে সড়ক পথ বেছে নিয়েছে। জোন ভাগ করে ভ্রমণের আগে সেই মহাদেশের ম্যাপ ও দর্শনীয় জায়গাগুলোর উপর গবেষণা করে নিতেন।
ভ্রমণে চ্যালেঞ্জ:
নাজমুন নাহার বলেন, বিশ্ব ভ্রমণের সময় মৃত্যুর হাতছানি থেকে ফিরে এসেছি বহুবার। মধ্যরাতে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে আটকা পড়েছি। সাহারা মরুভূমিতে মরুঝড়ের মধ্যে পড়েছি, রক্তাক্ত হয়েছি। পোকা মাকড়ের কামড় খেয়েছি। অন্ধকারে অচেনা শহরে, আফ্রিকার জংলী শহরে পথ হারিয়েছি। তিনমাস আফ্রিকাতে আলু খেয়ে ছিলাম। কখনো না খেয়ে থেকেছি। কখনো কাঠ, কখনো পাথরের ওপর ঘুমিয়েছি।
কখনো আদিবাসীদের সঙ্গে মাটির ঘরে ঘুমিয়েছি। কখনো রাতের অন্ধকারে বর্ডার ক্রস করতে না পেরে অপরিচিত পরিবারের সঙ্গে থাকতে হয়েছে। পেরুর রেইনবো মাউনটেইনে অভিযাত্রায় ১৪ হাজার ২০০ ফুট উচ্চতায় আন্টিচুডের সমস্যার কারণে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। মৃত্যুকে জয় করে সেই পর্বতশৃঙ্গে উঠতে সক্ষম হয়েছি। সমুদ্রের তলদেশে স্কুবা ডাইভিং-এর সময় পাইপ লিক হয়ে লবণাক্ত পানি খেয়েও বেঁচে ফিরেছি। পশ্চিম আফ্রিকার গিনি কোনাক্রিতে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে আটকা পড়ে ২৬ ঘণ্টা অনাহারে থেকেছি।
কিরগিস্তানের আলা আরচা পর্বত আরোহন করে নামার সময় পড়ে গিয়ে ছোট্ট একটি বুনো গাছের সঙ্গে ঝুলে ছিলাম। পড়ে গেলে হয়তো সেদিনই মৃত্যু হতো।
পশ্চিম আফ্রিকার পথে পথে অনেক কঠিন পরিস্থিতি মানসিক শক্তি দিয়ে জয় করেছি। সিয়েরালিওন থেকে লাইবেরিয়া যাওয়ার পথে ১১টি ভয়ঙ্কর কূপ ও বিপদসংকুল ভয়ঙ্কর পথ পাড়ি দিয়েছি। যখনই কোনো সমস্যায় পড়েছি, কেউ না কেউ এগিয়ে এসেছেন।
সবচেয়ে কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছি মৌরিতানিয়ায়। সাহারার তপ্ত মরুঝড়ে আক্রান্ত হয়ে ধারালো বালির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছি। সেনেগালের রোজ লেকে যাওয়ার সময় তিন ঘণ্টা জঙ্গলে হেঁটেছি। সেন্ট লুইতে একাকী পথ হারিয়ে আট কিলোমিটার অন্ধকার পথ হেঁটেছি। ইথিওপিয়ার জঙ্গলে হামার আদিবাসীদের সঙ্গে গরুর কাঁচা মাংস খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে। সর্বোচ্চ আড়াই দিন না খেয়ে থেকেছি। আফ্রিকাতে গাছের সাদা রস খেয়ে দুই দিন পর পানির পিপাসা মিটিয়েছি। চিলির আতাকামা যেখানে ১০০ বছরে বৃষ্টি হয়নি এমন জায়গাতেও পা রেখেছি। তার পরও জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত ১৯৫ দেশ পর্যন্ত অভিযাত্রা অব্যহত থাকবে।
সম্মাননা:
দুঃসাহসিক অভিযাত্রার জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে পেয়েছেন পিস টর্চ বিয়ারার অ্যাওয়ার্ড, আর্থ কুইন অ্যাওয়ার্ড, জাম্বিয়া থেকে পেয়েছেন ফ্ল্যাগ গার্ল উপাধি, অনন্যা শীর্ষ দশ অ্যাওয়ার্ড, জনটা ইন্টারন্যাশনাল থেকে গেম চেঞ্জার অব বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড, অতীশ দীপঙ্কর গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ডসহ অর্ধশতাধিক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন ভ্রমণপিপাসু নাজমুন নাহার। বিদেশি গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা, রাষ্ট্র প্রধান, মন্ত্রী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবী, হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টসহ অনেকের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছেন তিনি। তাঁর অর্জনের ঝুলিতে যুক্ত হয়েছে ৫৫টির অধিক পুরস্কার ও সম্মাননা।
জন্ম ও পরিবার পরিচয়:
নাজমুন নাহার ১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার গঙ্গাপুরে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ইরান থেকে কয়েক শতাব্দী আগে বাংলাদেশের লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে বসতি স্থাপন শুরু করেছিলেন দৌলত গাজী খান। তাঁরই বংশধর নাজমুন নাহার। বাবা মোহাম্মদ আমিন একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। মা তাহেরা আমিন। দাদা আলহাজ ফকীহ আহমদ উল্লাহ তৎকালীন সময়ের একজন ফিকাহ শাস্ত্রবিদ ও ইসলামিক স্কলার ছিলেন।
দাদা আহমদ উল্লাহ ১৯২৬-১৯৩১ সালে ঘোড়ায় চড়ে, পায়ে হেঁটে, জাহাজে আরবের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন। দাদার এই অভিযাত্রা ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন দেশের ভ্রমণকাহিনী পড়া ও ম্যাপের উপর গবেষণা গবেষণায় উৎসাহ যোগায়। বাবার সমর্থন পৃথিবী ভ্রমণের স্বপ্ন পূরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। তিনি তাঁর মাকে নিয়েও ভ্রমণ করেছেন পৃথিবীর ১৪টি দেশ।
শিক্ষা ও কর্মজীবন:
নাজমুন নাহার সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটি থেকে এশিয়ান স্টাডিজ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড এশিয়া বিষয়ে পড়াশোনা করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে তিনি স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করেন। তিনি লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ, দালাল বাজার নবীন কিশোর উচ্চ বিদ্যালয় ও নন্দনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। একজন গবেষক হিসেবে বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করেছেন।