-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
সংস্কার কমিশনগুলো অনেক পরিশ্রম করে তাদের দৃষ্টিতে মূল্যবান সুপারিশসহ যেসব প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, দুদক সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধানগণ প্রধান উপদেষ্টার হাতে প্রতিবেদন তুলে দিয়েছেন।তবে আগে সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়ন শুরু হবে নাকি নির্বাচন হবে তা নিয়ে এখনও চলছে নানাকথা।
গত ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ রাজধানীর খামারবাড়িতে ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন বিষয়ক জাতীয় সংলাপের ‘সংস্কারের দায় ও নির্বাচনের পথরেখা’ শীর্ষক সংলাপ অধিবেশন–৪ হয়েছে। সেখানে নির্বাচন নিয়ে বক্তাদের কেউ বলেছেন, ‘দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ হতেই হবে।’
এর আগে ১৯ নভেম্বর ২০২৪ আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা জানিয়েছিলেন,-‘অতি প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেয়া হবে।.. আমরা মোস্ট এসেনশিয়াল (অতি প্রয়োজনীয়) কিছু সংস্কার করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেব। আমরা জাস্ট এই জিনিসটা চাই না যে আগের মতো কোনো ভুয়া নির্বাচন হোক।’
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতায় একটি গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ‘অল্পকিছু সংস্কার’ করে দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করা হলে তা জাতীয় স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্রের বিকাশ এবং জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপনে ভূমিকা রাখতে পারে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘কিছু অত্যাবশ্যকীয় সংস্কারকাজ শেষ করেই নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। তবে নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে। এটা আর থামবে না।’ তিনি ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ এক সভায় ভোটারদের বয়স কমিয়ে ১৭ বছর করার কথা বলেছেন।
তবে একথা বলার কয়েকদিন পরেই অন্তবর্তী সরকারের একজন তরুণ উপদেষ্টা ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীতে এক জনসভায় মন্তব্য করেছেন, ‘সংস্কার শেষ হলে নির্বাচনের দিকে যাওয়া হবে।’ তার আগে ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪ তিনি বলেছিলেন, ‘কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচন নিয়ে অধৈর্য্য হয়ে উঠেছেন।’
এর মাত্র একদিন পর ঠাকুরগাঁওয়ের শিবগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ মাঠে অপর একটি জনসভায় বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘প্রয়োজনে ভোটাধিকার আদায়ে ৫ আগস্টের মতো রাস্তায় নামতে হবে’।
এরই মাঝে ৩১ ডিসেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নবগঠিত মোর্চা জাতীয় নাগরিক কমিটির দেরীতে হলেও ৫ আগষ্ট সংঘটিত বিপ্লবের উপর ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভ্যুলেশন’ ঘোষণাপত্র এবং নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের দিকনির্দেশনা দেয়ারে কথা ছিল। তারা বলেছিলেন, ‘কমরেডস, নাউ অর নেভার।’ অন্তবর্তী সরকার বলেছিল, এই ঘোষণার সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই।
কিন্তু ৭২-এর সংবিধানকে কবর দেয়ার ঘোষণায় আগামী জাতীয় নির্বাচনে এর প্রতিক্রিয়া কি হবে তা নিয়ে ছাত্র-রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকগণের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। সরকার হঠাৎ জানায়, ‘জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেবে অন্তর্বর্তী সরকার।’ তাই সেটা স্থগিত করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’(ঐক্যের জন্য যাত্রা) কর্মসূচি পালন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং দাবী জানিয়েছে ১৫ জানুয়ারি ২০২৫-এর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করতে হবে কিন্তু তা হয়নি।
এসব অবস্থা পরিদৃষ্টে ও বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে গনঅভ্যুথ্থানকারী, সরকার ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কিছু মতের ঘাটতি তৈরী হয়েছে। পারস্পরিক যোগাযোগহীনতা ও তরুণদের একলা চলো নীতির কারণে অনৈক্য তৈরী হয়েছে। কিন্তু এত হযবরল কেন?
কারণ, নির্বাচন নিয়ে সরকারী মহলের এখনকার ভাবনা অনেকটা ভিন্ন। অনেকেই ভাবছেন, যতই চাপাচাপি করুন না কেনো আগে দীর্র্ঘ সংস্কার তারপরে নির্বাচন! যারা বা যে দল এই পথে বাধা হয়ে দাড়াবে জনগণ তাদেরকে অবশ্য্ই রুখে দিবে! বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিশ্লেষণ থেকে জানা যাচ্ছে নানা গুঞ্জন।
বলা হচ্ছে, সরকার এত সহজে নির্বাচন দিবেনা কারন তারা দল গঠন করছে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার জন্য নয়। তারা নতুন দল তৈরীতে সহায়তা করছেন। বিএনপি, জাতীয় পার্টিও ও একই ফরমুলায় সৃষ্টি হয়ে ছিল। এ সকল দলকে কিংস পার্টি বলে । নতুন নতুন দল সৃষ্টি, তাদের নিবন্ধন ও প্রচারণা না হওয়া পর্যন্ত আগে নির্বাচন দেবে কেন? অন্যদিকে ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর আমলা, ব্যবসায়ীরা এখনও প্রতিবিপ্লব ঘটানোর জন্য সদা তৎপর। সচিবালয়ে দিনে মিছিল ও রাতে উপদেষ্টাদের অফিস ভবনে ভয়ংকর অগ্নিকান্ড ঘটছে। সবক্ষেত্রে সরকারী নিয়ন্ত্রণ না নির্বাচন আগে সেটাও ভাবনার বিষয় হয়ে গেছে।
এরূপ নানা ভাবনা থেকে সরকার ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনেকটা দূরত্ব তৈরী হয়ে গেছে। দেরীতে নির্বাচন করা নিয়ে বিতর্র্কও শুরু হয়ে গেছে চারদিকে। তবে কিছু মিশ্র প্রতিক্রিয়াও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
যেমন, বিএনপির একজন নেতা তার এক পোষ্টে বলেছেন, ‘প্রয়োজনীয় সংস্কারের পরেই নির্বাচনে যেতে হবে সরকারকে। তার আগে করলে ‘নির্বাচন’ এর বদলে খুনি হাসিনার ভোট ডাকাতির প্রহসন হবে। ..তবে এই অজুহাতে নির্বাচন বিলম্ব করার গোপন উদ্দেশ্য থাকলে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ ও আত্মঘাতী।’
বাংলাদেশের জনগণ ১৬ বছর ধরে লড়াই সংগ্রাম করেছে তাদের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে। কেউ কেউ বলছেন, ‘গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলের অনুপস্থিতির কারনে যে ভয়াবহ জুলুম, নির্যাতন, বৈষম্য ঘটেছে, তার বিরুদ্ধে তিল তিল করে রক্ত ঝরিয়ে ও অকাতরে জীবন বিলিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করা হয়েছিল।’
এই গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও নির্বাচনের প্রশ্নে এক চুল ছাড় দেয় হবে না। আমার হাজার হাজার ভাইবোনেরা গণতন্ত্রের জন্যেই জীবন দিয়েছে। ..প্রয়োজনে যুদ্ধে হবে আরেকবার। নির্বাচন বিলম্বিত করে কেও ভিন্ন উদ্দেশ্যে বাস্তবায়ন করতে চাইলে তারাই সবার আগে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ..একটি নির্বাচনের জন্যই কি আগস্ট বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল?’
আবার কেউ কেউ বলছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের সরকার। তারা কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন না। রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনের জন্য বলার অধিকার কে দেয়? বাংলাদেশের জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে কখন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন, যার উদ্দেশ্য হবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্রুত ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা এবং নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করা। এজন্য সমমনা সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বহুবার গভীর সংলাপ অত্যন্ত জরুরি।
যা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো চূড়ান্ত করা ও সবার আস্থার জন্য নির্বাচন কমিশনের উপর রাজনৈতিক দলগুলোর পূর্ণ সমর্থন নিশ্চিত করা। কারণ, এখনও কোন ধরনের সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে তা নিশ্চিত করে বলা হয়নি। ইসলামী দলের কেউ এখনও জাতীয় সরকার, কেউ কেউ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের কথা বলছেন। আবার কেউ কেউ আনুপাতিক হারে নির্বাচনের কথা বলছেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, ‘আনুপাতিক নির্বাচন কীসের জন্য? এটা কী তৃণমূলের মানুষ বোঝে? যেসব রাজনৈতিক দলের ভোটারের সংখ্যা বেশি নয়, ..তারা এটা একটা কৌশল হিসেবে নিয়েছেন। ‘আনুপাতিক হারে নির্বাচনের নামে কোনো ষড়যন্ত্র করলে তা দেশের মানুষ মেনে নেবে না।’
বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচনের জন্য অল্পকিছু সংস্কার একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে। স্বল্প সময়ে এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। এছাড়া কেউ কেউ বলছেন, কোন কিংস পার্টির মতো দল গঠন করে সেটার জন্য জনমত তৈরী করে নির্বাচনে যাবার প্রস্তুতির সুযোগ দেবার জন্য সময়ক্ষেপন করা অন্তবর্তী সরকারের জন্য আত্মঘাতি হতে পারে। কারণ বিএনপি বা জাতীয় পার্টির মতো সরকারী ছায়ায় ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে দল গঠন করার সময় আর আজকের সময়ের প্রেক্ষাপট এক নয়। তবে জানুয়ারী ১৫, ২০২৫ পর্যন্ত মাত্র নতুন ২টি রাজনৈতিক দল কাজ শুরু করেছে।
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি কোনো রাজনৈতিক প্লাটফর্ম না, আগামীতে হবেও না।
অভ্যুথ্থানকারীদের মধ্যে রাজনৈতিক দল মত নির্বিশেষে ছাত্র-শ্রমিক-জনতা-গৃহিণী সব ধরণের মানুষ আছে। তারা ক্রমাগত এরকম অনৈক্য অবলোকন করতে থাকলে ভবিষ্যতে নিজেদের মতো দূরে সরে যেতে পারে। সমমনা রাজনৈতিক দলের সাথে ঐক্যমত্য হারালে নতুন রাজনৈতিক দল নিয়ে তারা ভোট করবেন কাকে দিয়ে, কার ভরসায়? মানুষ এখন আর কোন অপরিচ্ছন্ন বা কোন নিশীরাতের ভোট চায় না। জুলাই বিপ্লবের সময় যে আহবান ও সাড়া ছিল-নির্বাচন করতে গেলে ভোটের মাঠে সেই সাড়া পাওয়া কঠিন হতে পারে।
এছাড়া বিপ্রবের মাধ্যমে স্বৈরাচার পালাতে বাধ্য করা যায় কিন্ত দেশে বেকারত্ব, দুর্নীতি চাঁদাবাজি, লুটপাট, দখলবাজি বন্ধ করার জন্য একটি পরিচ্ছন্ন নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে শক্তিশালী রাজনৈতিক কমিটমেন্ট প্রয়োজন।
ভোটারদের বয়স কমিয়ে ১৭ বছর করার কথা বলা হলেও বিশ্লেষকগণ মনে করেন, ভোটারদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন কেবল একটি রাজনৈতিক প্রয়োজন নয়, এটি সামাজিক উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। যদি ভোটাররা সামাজিক ও মানসিকভাবে আরও পরিপক্ব হন, তবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ ও কার্যকর হবে।সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে সমাজে স্থিতিশীলতা, ন্যায়বিচার, এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
এরসাথে ভোটারদের সামাজিক ও মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি কেন তা বোঝার জন্য গণতন্ত্র, সমাজব্যবস্থা, এবং নেতৃত্বের সঙ্গে ভোটারদের ভূমিকার সম্পর্কটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। ভোটচুরির জন্য বিগত দিনের অভিজ্ঞতা স্মরণ হলে ভোটারদের অন্তরাত্মা এখনও শুকিয়ে যায়! আবেগপ্রবণ, অজ্ঞ, বা প্রভাবিত ভোটারদের মাধ্যমে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে, তার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর পড়ে। সুতরাং, ক্রমাগত কুটতর্র্ক ভুলে চুলচেরা বিশ্লেষণ করার পর অতি জরুরী অল্পসংস্কার করে এবছরের মধ্যেই একটি মসৃণ নির্বাচনী আয়োজনের সন্ধানে সবাইকে দ্রুত হাঁটা শুরু করা উচিত। এজন্য অচিরেই জাতীয় নির্বাচনী ঐক্য গড়ে তোলা খুব জরুরী।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]