বুধবার | ১২ মার্চ, ২০২৫ | ২৭ ফাল্গুন, ১৪৩১

শাবিপ্রবি’র জন্মদিন

নুরুজ্জামান বিশ্বাস :
কলেজের গণ্ডি পেরিয়েছি। নাটক সিনেমায় পাহাড় ও ট্রেন দেখেছি, বাস্তবে দেখিনি, তাই ১৯৯৫ সনে শাবিতে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। উল্লেখ্য, শাবি তখন সেশনজট মুক্ত এবং দেশের প্রথম ও একমাত্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি)। ১৯৯৪ সনে আমরা যারা এইচ এস সি পাশ করেছি, তাঁদের সম্ভবত বুয়েটে প্রথম, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শাবিতে প্রথম ভর্তি পরিক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
ঢাবির জসিম উদ্দিন হলে এলাকার বড় ভাইয়ের বন্ধুর ছোট ভাইকে সহয়তা করার জন্য শুধু ছবি ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিলে চলবে। বাকীটা সে-ই করবে। তাই সুযোগ হাত ছাড়া করলাম না। উল্লেখ্য, তখন ক্যাম্পাসে গিয়ে ভর্তি পরিক্ষার ফরম ফিলআপ করে জমা দিয়ে প্রবেশপত্র সংগ্রহ করা হত।
‘রথ দেখা কলা বেচা’। জসিম উদ্দিন হল থেকে আমরা ৪ জনের গ্রুপ রওনা দিলাম। গন্তব্য কমলাপুর রেলস্টেশন। আমি একা বরিশালের। বাকীরা ময়মনসিংহের। লঞ্চে করে ঢাকা এসেছি। জীবনের প্রথম ট্রেনে উঠব। চরম কৌতূহল ও উত্তেজনা নিয়ে এগিয়ে চলেছি। ক্লাশ এইটে ‘পথের পাঁচালি’তে অপু ও দুর্গার কাহিনী মনে পড়ে গেল। ট্রেনে উঠে নিজের সীটে বসলাম। না ঘুমিয়ে সারা রাত ট্রেন জার্নি উপভোগ করলাম। সকালে সিলেট রেল স্টেশনে নেমে ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য রিক্সা পাচ্ছিলাম না। কারনটা পরে জেনেছি।
আমরা রিক্সাচালককে ‘রিক্সাওয়ালা’ বলে ডেকেছিলাম, তাই তারা সাড়া দেননি। এক রিকশাওয়ালার দয়া হল। তিনি যেতে রাজি হলেন এবং বুঝতে পারলেন আমরা আবাদি (নন সিলেটীদের সিলেটীরা আবাদি বলে ডাকে)। তিনি আরও একটা রিক্সা ঠিক করে দিলেন। আমরা আমাদের গন্তব্যে এগিয়ে চলছি। ‘ঢাকা ৮৬’ ছবিতে একটা গান ছিল ‘ঢাকার শহর আইসা আমার আসা পুরাইছে’। গানটা মনে পড়ে গেল। গেয়ে উঠলাম ‘কীন ব্রিজ দেইখা আমার আশা পূরাইছে’। রিকসাওয়ালা আমার বিটলামি বুঝতে পারল। রিকসা এগিয়ে চলছে, সাথে আমার প্যারোডী গান। শাবির মেইন গেটে এসে সাইনবোর্ড দেখে নিশ্চিত হলাম রিকসাওয়ালা আমাদেরকে জায়গামতো নিয়ে এসেছেন।
এখনকার মনোরম ‘এক কিলো’ তখন ছিল গাছপালাহীন মরুভূমি। তখন ক্যাম্পাসে ‘এ’ আর ‘বি’ বিল্ডিং ছাড়া আর কোন বিল্ডিং ছিল না। লাইব্রেরি ও ‘সি’ বিল্ডিংয়ের নির্মান কাজ চলছিল। গোলচক্করের পর শাহপরান হল পর্যন্ত ছিল ইটের রাস্তা। রিক্সার ঝাকুনির কারনে রিক্সা ছেঁড়ে দিয়ে আমরা হেটে চলেছি। সকালের মিষ্টি রোদে ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী টিলাগুলো দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। জীবনে প্রথম টিলা দেখা। তাই দেখছি আর মুগ্ধ হচ্ছি। আমরা শাহ পরান হলের দিকে হেটে চলেছি। টিচার্স ক্লাবের সামনে এসে কোন বড় বিল্ডিং না দেখে থমকে দাঁড়ালাম। এক পথচারীর সহযোগিতা নিয়ে হলের দিকে এগিয়ে চলেছি। একটু এগোতেই সুন্দর ঝকঝকে বিল্ডিং। এক বড় ভাইয়ের রেফারেন্সে শাহ পরান হলের ২৩২ নাম্বার রুমে উঠলাম। নাস্তা খেয়ে আমাদের ঘুমানোর জন্য বললে, না ঘুমিয়ে আমরা দুজন চলে যাই হলের পাশের টিলা দেখতে। পরদিন পরীক্ষা দিয়ে দল বেধে বেরিয়ে পড়ি মালনিছরা চা বাগান দেখতে। হলে ফিরে রাত ১১ টার পর ১০-১২ জনের গ্রুপ হলের পাশের টিলায় চাঁদনী রাত উপভোগ করি। পরদিন জাফলং যাই। তখনই সিলেটের প্রেমে পড়ে যাই এবং শাবিতে পড়ার সিদ্ধান্ত নিই।


ক্লাস শুরুর ২ সপ্তাহ পরে আসি। ক্লাশে গিয়ে দেখি অনেক কিছু পড়ানো শেষ হয়ে গেছে। একটু চঞ্চল প্রকৃতির ছিলাম। তাই ক্লাসে সমগোত্রীয়দের খুঁজে বের করলাম। ২/১ দিনের মধ্যে সমগোত্রীয় কয়েকজনের সাথে ভাব জমে গেল। বেশীর ভাগই জিন্স ও টি-শার্ট পরে আসতাম। ২/১ জন শার্টের মধ্যে প্যান্ট গুঁজে আসত। পরে এর কারন নিশ্চিত হলাম। তাদের ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’ শুরু হয়ে গেছে। আমাদের ক্লাশ হতো ‘বি’ বিল্ডিংয়ের ৩য় তলা ও নীচ তলার দক্ষিন পাশের রুমগুলোতে। আমরা ৩য় তলা দিয়ে এক্সটেনসনের ছাদে (উত্তর পাশে) চলে যেতাম। মনির ( ইউএসএ প্রবাসী) ব্যাগে করে কার্ড নিয়ে এসেছিল। ২ ক্লাশের গ্যাপে শুরু হয়ে গেল ২৯ খেলা। পরদিন দেখি এক্সটেনসনে যাওয়ার গেটে তালা। আমরা বীর বিক্রমে নতুন জায়গা খুজতে শুরু করলাম। এপ্রিলের গরম। বিল্ডিং ছাড়া কোথায় ও ছায়া নেই যে যেখানে বসে আড্ডা মারতে পারি। তাই আমরা দল বেঁধে চলে যেতাম পাশের টিলায়। আমাদের নবীন-বরন অনুষ্ঠানে পারফর্ম করে পরিচিতি পেয়ে গেলাম। অন্য ডিপার্টমেন্টের সমবয়সী অনেকের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আস্তে আস্তে সিনিয়রদের সাথে বন্ধুত্ব হওয়া শুরু হল। সোনালী ব্যাংক ও পোস্ট অফিসের মাঝখানে একটি মাত্র ক্যাফেটরিয়া ছিল। ক্লাশের ফাঁকে দল বেধে চলত বেসুরা গলায় গানের প্রতিযোগীতা। অডিটোরিয়ামে কোন অনুষ্ঠান থাকলে দল বেঁধে হাজির হতাম। অনুষ্ঠানের দেরি হলে আমরাই গান শুরু করে দিতাম। ‘ক্লাশ হবে না’ সুখবরটা কেউ দিলে- দল বেঁধে শহরগামী বাসে উঠে গান শুরু করে দিতাম। ৩য় বর্ষের পর আমাদের মাঝে ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে আড্ডা মারার প্রবনতা শুরু হয়ে গেল। পালা করে দল বেঁধে এক এক গ্রুপ ওয়াশরুমে আড্ডায় মেতে উঠতাম। আমাদের গ্রুপ ক্লাসে আসার পর অপর গ্রুপ যাওয়ার জন্য বের হতে গেলে, স্যারের নজর কাড়ার জন্য আমি চেয়ার টেবিল নাড়ানি দিতাম । আর যায় কই! স্যারের মৃদু ধমকানি আর আমারা যারা এ কাজটি করেছি, মজা নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে বিজয়ের হাসিতে মেতে উঠতাম।
নিজ বিভাগের নবীন-বরনে কিছু একটা করে জুনিয়রদের নজর কাড়া আমার একটা অভ্যাস ছিল। পরিচয় পর্বে আমি আমার নাম বলতাম ‘দুলা’। কেননা, বিশ্বাস ছিল ছোটরা শুধু নাম ধরে ডাকবে না। সাথে ভাই যোগ করবে।
সিলেটের বর্ষাকাল মানেই বর্ষা ঋতু প্রেমিদের পাগল করা একটা সময়। সারা রাত মুশলধারায় বৃষ্টির পরদিন সকালে ক্যাম্পাসকে মনে হতো এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ।


‘বি’ বিল্ডিংয়ের দক্ষিন-পশ্চিম পাশের গাছগুলো আমাদের বিভাগের লাগান (১৯৯৫ এর শেষের দিকে)। পরের বছর বৃক্ষ রোপণ সপ্তাহে আমাদের বিভাগের দায়িত্ব ছিল সোনালী ব্যাংকের পূর্ব পাশ থেকে শুরু করে ‘এ’ বিল্ডিং পর্যন্ত গাছ লাগানো। বৃষ্টিতে ভিজে আমরা গাছ লাগিয়ে ছিলাম। সকালে ক্যাম্পাসে হাটতে বের হতাম কাঁঠালি চাপার ঘ্রান নিতে। ২০০৭ এ ক্যাম্পাসে গিয়ে গাছগুলো দেখে নিজেকে গর্বিত মনে হলো। ক্যাম্পাস থেকে বের হবার পর স্মৃতিকাতর হলেও এতটা অনুভব করিনি। প্রবাসে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্যাম্পাসের ছবি দেখে অনেক কিছুই মনে পড়ে যায়। ‘দল বেধে ক্যানটিনে খেয়ে কারও ঘাড়ে বিল চাপিয়ে দেওয়া, গোল চত্তর বা পাশের টিলায় মধ্যরাত অবধি জমিয়ে আড্ডা। সেমিনার রুমে দল বেঁধে ল্যাবশিট কপি করা। হলে বা খালিদের ম্যাচে বা স্বপনের বাসায় মুভি দেখে রাত ফুটা করা। খেলার মাঠে দল বেঁধে নিজ দলের সমর্থনে প্যারডি গান গেয়ে সবাইকে চাঙ্গা রাখা। সন্ধ্যায় হলে পানি নিক্ষেপ করে ‘ওয়াটারেল’ খেলা (কেউ সেজেগুজে ক্যাম্পাশে যাওয়ার সময় উপর থেকে পলিথিন ভর্তি পানি নিক্ষেপ)’। সবই স্মৃতি। মনে হয় এই তো সে দিনকার কথা। ১৬ বছর আগে পাশ করে এসেছি। অনেকের বর্তমান সামাজিক অবস্থান ও ছবি দেখে অবাক হই। মনে পড়ে সেই তারুন্যের সময়কার কথা। এসব তরুনের পদচারনায় এক সময় মুখরিত ছিল প্রিয় ক্যাম্পাস। আমাদের ফেলে আসা সেই জায়গাগুলো হয়ত আর একদল তরুন দখল করে আছে। কোন এক তরুনের দল হয়ত মুখরিত করে রাখে খেলার মাঠ, পাশের টিলা, গোলচত্তর, শহরমুখী বাস, অডিটোরিয়াম ও জমান গান দিয়ে মাতিয়ে রাখে পিকনিকের আয়োজন। হাজার বছর ধরে এ প্রক্রিয়া চলবে। কারন ক্যাম্পাস মানেই একদল তরুনের পদচারনা।
জন্মদিনে অনেক অনেক শুভকামনা, প্রিয় শাবি।

* নুরুজ্জামান বিশ্বাস, টরেন্টো, কানাডা।

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.