শনিবার | ১২ এপ্রিল, ২০২৫ | ২৯ চৈত্র, ১৪৩১

বালকের হাতে বাইক নয়- একা একা পড়ে গেলেও মৃত্যু !

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
ঈদুল ফেতেরের ছুটিতে ফোর লেনের মহাসড়কে ছোট মোটরগাড়িতে চেপে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলাম। নগর পেরিয়ে বাইরের রাস্তায় তেমন জনভীড় নেই। বড় যানজট নেই। যেখানে যেখানে ব্রীজ ও ফ্লাইওভারের কাজ চলছে শুধু সেখানেই বিকল্প পথের দুই মুখে গাড়ির জটলা। অসংখ্য এসব নির্মাণ কাজের সরু রাস্তায় গিয়ে কে আগে সামনে যাবে ও মূল রাস্তায় উঠবে তা নিয়ে পাড়াপাড়ি চলছিল। সেসব নির্মাণাধীন জায়গায় ইট বিছানো পাটাতন ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে লাল ধুলো তৈরী হয়েছে। সংগে রাস্তার পাশে রাখা শুকনো মাটির স্তুপ, বালু-ধুলো উড়িয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। ঈদের ছুটিতে শ্রমিকরা চলে যাওয়ায় ধূলোবালিতে কেউ পানি ছিটায়নি। কোন কোন স্থানে ধূলিময়তায় দৃষ্টিসীমা বিঘ্নকারী রাস্তার দৈর্ঘ্য ২-৩ কি:মি:।
রাস্তায় ট্রাকের সংখ্যা বাসের চেয়ে দ্বিগুণ মনে হলো। কারণটা হলো- রাজধানীর সন্নিকট থেকে পোশাক ও অন্যান্য শ্রমিককরা ছোট-বড় খোলা ট্রাক, পিকআপ ভাড়া করে ঈদুল ফেতেরের ছুটিতে বাড়ি ফিরছেন। তারা রোজা ছিলেন। সেহরী খেয়ে ব্যাগ-বস্তা সাথে নিয়ে ছাদবিহীন ট্রাকে চড়ে বাড়ির পথে নেমেছেন। সকাল হতেই চৈত্রের প্রখর রোদের উত্তাপ তাদেরকে বেশ ভুগিয়ে তোলে। বিশেষ করে নারী শ্রমিক- যাত্রীদেরকে।
রোদের পাশাপাশি ব্রীজ ও ফ্লাইওভারের কাজ চলা জায়গায় গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় যখন লাল ধুলো-বালু উড়িয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছিল তখন কোন গাড়িকে ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। ছাদবিহীন ট্রাকে চড়া যাত্রীদের দেহ, পোশাক সবকিছুই মলিন, রঙ্গীন হয়ে উঠে এক করুণ অবস্থা সৃষ্টি করছিল। গরম ও ধুলাবালির চোটে অনেকে বমি করছিল। পানি পানি করে চিৎকার করে দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। জীবনের চরম নিরাপত্তাহীন এসব যাত্রা দেখে পাশের এসি বাস-গাড়ির যাত্রীদের কিছুই করার ছিল না। কারণ খোলা পিকআপ, ট্রাকের সংখ্যা ও আক্রান্ত যাত্রীদের সংখ্য ছিল বহুগুণ বেশী।
মজার ব্যাপার হলো- রাজধানী ও অন্যান্য শহর থেকে এবারের ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের মধ্যে পরিবার ও মাল-সামানা নিয়ে মোটর বাইকে চড়ে দ্রæতগতিতে বাড়ি ফিরতে চাওয়াদের সংখ্যাও অগণিত! মোটর বাইকের গতি সব ধরণের গাড়ির গতিকে হার মানিয়ে রাস্তার চিত্র বদলিয়ে দিয়েছে এবারের মহাসড়কগুলো।
তারো কাউকেই পরোয়া করছিল না। বার বার ওভারটেক করে পিছনে বসা নারী যাত্রী ও মাঝে বসিয়ে নেয়া কোলের শিশুর নিরাপত্তার দিকটি বিবেচনা না করে উর্ধ্বশ্বাসে গোঁ গোঁ করে ছুটে চলছিল। এসব মোটর বাইক উভয় দিক দিয়ে ওভারটেক করে। একটু ফাঁক পেলে সেদিক দিয়ে ভোঁ দৌড় চালিয়ে দেয়- যা খুবই ভয়ংকর!
যমুনা সেতু থেকে শুরু করে বগুড়া-রংপুর মহাসড়কে অনেকগুলো নির্মাণাধীন ব্রীজ, ফ্লাইওভারের জায়গায় গাড়ির সারি দীর্ঘসময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো। এসময় আমাদের সামনের এট বাসের পিছনে লেখা একটি লম্বা বাক্যের দিকে বার বার চোখ যেতে থাকায় আমার মনোযোগ বিশেষভাবে আকৃষ্ট হলে আমি আমাদের ড্রাইভারকে লাইনটি পড়ে শোনালাম। এবং মোবাইল ফোন লেখাটার দিয়ে ছবি তুলে নিলাম।
তা হলো-‘ছেলেকে জীবন দাও বাইক নয়, মেয়েকে শিক্ষা দাও মোবাইল নয়’। বাসটির নাম কি তা দেখা যাচ্ছিল না। লেখাটিই বা কে কার পছন্দের আদেশে লিখেছেন তা জানা যায়নি। তবে আমাদের ছোট্ট গাড়ির ভেতরে থাকা সদস্যদের মধ্যে সেটি বেশ আলোচনার খোরাক যুগিয়েছিল।
ড্রাইভার সাহেব বসে থাকতে থাকতে নিজের বিরক্তি কাটাতে আমাদের আলোচনা শুনে শরিক হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, বালককে কোন বাইক নয়। কারণ, ‘একা একা পড়ে গেলেও মৃত্যু অবধারিত।’
আজকাল অল্প বয়সের শিশু-কিশোরদেরকে রাস্তায় মোটর বাইক চালাতে দেখা যায়। তারা দামী মোটর বাইকের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আজকাল বড়রাই মোটর বাইক নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খান। এসব বাইক উচ্চগতিতে চালানোর সময় নিজেকে হিরো ভাবতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কুপোকাৎ হয়ে যান। কোন কারণে রাস্তায় একা একা উল্টে পড়লেও মৃত্যু!
আসলেও তাই। ক’দিন আগে গৌরনদীর রাস্তায় অটোরিক্সাকে সাইড দিতে গিয়ে তিনভাই উল্টে পড়ে গিয়ে একসংগে মারা গিয়েছিল। গাছের সংগে ধাক্কা খেয়ে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও বাইকারদের মৃত্যুর কথা শোনা যায়। কিশোর-তরুণ বাইকারদের ক্ষেত্রে এসব করুণ দশা ঘটতে দেখা যায়।
আজকাল তরুণ বাইকাররা বাইক নিয়ে মজা করে। নিত্যনতুন মডেলের উচ্চগতির মোটর বাইক তাদের নিকট খুব প্রিয়। শুধু শহরাঞ্চল নয়- গ্রামগঞ্জের বিত্তশালী পরিবারের ছেলেরা নানা অজুহাতে অভিভাবকদেরকে পটিয়ে দামী বাইক কিনে ফেলে। তাদের অনেকে ঠিকমতো পড়াশুনা করে না। অনেক্ েঅনলাইনে ফ্রিফায়ার গেম খেলে সময় নষ্ট করে। অনেকে কোন চাকুরি করেনা, ব্যবসাও করেনা! বাপের কৃষিকাজ দেখাশোনা বা বাড়ির জন্য বাজার করার কাজও করেনা। তারা বাপের হোটেলে বসে বসে খায় আর বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে।
তাহলে জনমনে প্রশ্ন হলো- এতো স্পিডে বাইক চালিয়ে ইমারজেন্সীভাবে কোথায় যায় ? কেউ কেউ বলেন, ওরা অনেকে প্রেম করে। আবার কেউ বলেন, বাই নিয়ে তারা মাদকদ্রব্য কিনতে যায়, মাদক ব্যবসা করে, মাদক সেবন করে। কারা কারো ধারণা তারা বাই চালিয়ে পথচারী বা রাস্তার রিক্সা, অটোযাত্রীদের হাতব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে দ্রæতগতিতে সটকে পড়ে।
সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার একটি অভিজাত এলাকায় রিক্সাআরোহী একজন জনপ্রিয় ছাত্র-সমন্বয়কের হাতব্যাগ ছিনিয়ে নিয়েছে বাইকাররা। তারা একটি বাইকে দু’জন ছিলো। পিছনে বসাজন রিক্সার মধ্যে বসা ছাত্র-সমন্বয়কের হাতব্যাগটি ছিনিয়ে নিয়ে বাইকের স্পিড বাড়িয়ে সবার সামনে দিয়ে দ্রæত পালিয়ে যায়। অনেক চেষ্টা তদ্বির করে এখনও তার ব্যাগে রক্ষিত ল্যাপটপ, গবেষণার কাগজপত্র কিছুই উদ্ধার করা যায়নি।
বাইকাররা ছিনতাইকারী হলে অনেক সময় জনতার ধাওয়া খেয়ে দ্রুত পালাতে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। তারা নিজেরাও মারা যায়, পথচারীকেও মেরে যায়। এধরণের ঘটনায় একজন আক্ষেপ করে বলেছেন,
‘অনুরোধ করে বলি: উঠতি বয়সি প্রিয় কিশোর এবং যুবকভাইয়েরা আমার..! নিজে গতি নিয়ন্ত্রণ করে গাড়ি চালান, অপরকেও চালাতে বলেন। নইলে জীবন গেলে আপনার যাবে, আপনাকে দেখে অন্যরা ছবি তুলতে ব্যস্ত থাকবে। … এবার পবিত্র ঈদুল ফিতর-২০২৫ এর ৯দিনের ছুটির মধ্যে ৩৪০টি দূর্ঘটনায় ৩৫২ জন মারা গেছেন। যার মধ্যে ১৩৫টি মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় ১৩৮ জনই নিহত হয়েছেন।’
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুসারে, গত দুই সপ্তাহে দেশব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে, যার মূল কারণ ঈদ ভ্রমণ। সড়ক দুর্ঘটনার ৪৩.২৭ শতাংশই ঘটে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কারণে।
বিআরটিএর তথ্যেও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির চিত্র উঠে এসেছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে মোট সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৪০৪ জন, যার মধ্যে ১৩৭ জন বা ৩৩.৯ শতাংশ মারা যায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা অনেকটাই বেড়ে ৪৩.৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
আধুনিক মোটর বাইক নিয়ে রাস্তায় উঠলেই অনেকের মনে হিরোইজম জাগে। তারা গতি বাড়িয়ে সবাইকে পাশ কাটিয়ে সামনে যেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে নিয়ন্ত্রণহীনতা তৈরী হয় ও দুর্ঘটনা ঘটে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, বেপরোয়া গতিতে বাইক চালানোই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর অন্যতম কারণ। ফাউন্ডেশনটি আরো বলেছে, ‘দেশে বাইক অ্যাক্সিডেন্টের ৫৮ শতাংশই ঘটে বেপরোয়া গতির কারণে। এক্ষেত্রে মোটরসাইকেল কোম্পানিগুলোরও দায় রয়েছে। কারণ তারা বিজ্ঞাপনের জন্য তৈরি করা ভিডিওগুলোতে বেপোরোয়া গতিতে চালাতে উৎসাহ দেয়।’
এ বিষয়ে জানা গেছে, ‘বাংলাদেশের মোট যানবাহনের প্রায় ৭১ শতাংশই মোটরসাইকেল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব বাইক চালায় কিশোররা। অনেকেরই লাইসেন্স নাই। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে হেলমেট ব্যবহার না করার প্রবণতা দেখা যায়। শহরাঞ্চলে হেলমেট ব্যবহার করা হলেও এগুলো খুবই নিম্নমানের। পুলিশের সামনে দিয়ে কিশোর বয়সের ছেলেরা এসব হেলমেট নিয়ে যাতায়াত করছে। তারা কিছু করে না।’
কিছুদিন আগে নবম শ্রেণি পড়–য়া দুই বন্ধু ঢাকার কালশীতে বাইক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিল। অনলাইন গেম ফ্রি ফায়ারের মাধ্যমে দুই তরুণের বন্ধুত্ব হয়েছিল। ‘তাদের একজন রিয়াদ ঈদের ছুটিতে বন্ধু তোফাজ্জলের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকায় এসেছিল। পুলিশ ও সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ বেপরোয়াভাবে মোটরবাইক চালানো ও অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো।’
মোট বাইক নিয়ে চলাচলের ক্ষেত্রে শিশু-কিশোর-যুবক সবার জন্য অতিরিক্ত গতি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ সাবধানতা প্রয়োজন। এজন্য বেশী সাবধান হতে হবে তাদের অভিভাবকদেরকে। ঘটনা ঘটে গেলে ‘পুলিশের একার পক্ষে এই সমস্যার সমাধান করা কঠিন। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ ও ব্যক্তিপর্যায়ে এগুলো নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।’
সচেতনতা বৃদ্ধির চেতনা লালনের সাথে চর্চ্চা ও সুচিন্তা দিয়ে একটি শক্তিশালী আধুনিক প্রজন্ম গড়ে তোলা জরুরী। আজকাল তরুণদের আকর্ষণ আধুনিক মোটর বাইক, মরণঘাতী মাদক, দামী মোবাইল ফোন ও রাস্তার মোড়ে মোড়ে অহেতুক আড্ডা দিয়ে মূল্যবান সময় নষ্ট করে আমাদের মূল্যবান তরুণ ও ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টকে তাচ্ছিল্য করা। এই হীন মোবাইল সংস্কৃতির যুগে তরুণদেরকে আত্মকল্যাণ সাধন শেষে পরবর্তীতে মানব কল্যাণের দিকে অগ্রসর হতে প্রভূত সাহায্য করবে কে বা কারা? শিশুকে দামী মোবাইল নয়, তরুণ, কিশোর বা বালকরা বাবার কাছে বায়না ধরলেই কোন বাইক নয়। কারণ, বাইক নিয়ে বের হয়ে রাস্তায় কোথাও ‘একা একা পড়ে গেলেও মৃত্যু অবধারিত।’

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.