রবিবার | ৪ মে, ২০২৫ | ২১ বৈশাখ, ১৪৩২

গাজা হত্যার বিরুদ্ধে আমাদের গর্জন কতদূর পৌঁছল?

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
এই লেখকের শৈশবে যখন বই পড়া, পত্রিকার পাতার ছবি দেখা ও রেডিওতে সংবাদ শোনার জ্ঞান হয়েছিল তখন থেকে ফিলিস্তিনী বালকদেরকে ইসরাইলী সেনাদের বুলেটের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে ঢিল ছুঁড়ে প্রতিবাদ করার দৃশ্য মনে দাগ কেটেছিল। লেখকের কৈশোরে-যৌবনে প্যালেষ্টাইন ইস্যু ও ইয়াসির আরাফাতের কালো বর্ডার আঁকা গলার স্কার্ফ পরিহিত এক অবিসংবাদিত আরব নেতার দৃঢ় ভূমিকা হৃদয় জুড়ে স্থান করে নিয়েছিল। এরপর ফিলিস্তিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত ও স্বাধীন বাংলাদেশের সখ্য একটি ইতিবাচক মুসলিম ভ্রাতৃত্বের জাগরণ তৈরী করেছে। যেটা আমাদের ‘জেন-জি’-রা চোখে না দেখলেও ইতিহাস থেকে শিখে অদ্যাবধি সঠিকই মনে রেখেছে। যার এতবড় পুনর্জাগরণ হয়ে গেল ২০২৫-এর গত পাঁচ এপ্রিলের অব্যবহিত পর বেশ কদিন ধরে। গত ১২ এপ্রিলে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ফিলিস্তিনীদের উপর গণহত্যার প্রতিবাদে ‘মার্চ ফর গাজা’ ছিল এ যাবতকালের সর্ব বৃহৎ গণজমায়েত ও প্রতিবাদ সভা।
ইসরাইলীদের নির্মম অত্যাচারের মাত্রা ২০২৩ সালে নতুন করে শুরু হয়ে ২০২৫ এর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে যখন ৫১ হাজার ৭০০ ফিলিস্তিনবাসী নারী-শিশুদের প্রাণ কেড়ে নেয়া সাঙ্গ করেছে তখন তাদের খায়েশ আরো অন্যকিছু। মার্কিন প্রেসিডেন্টের জঘন্য ইচ্ছে জেগেছে গাজার শিশুদের কবরস্থানের উপর বিলাসবহুল রিসোর্ট তৈরীর পরিকল্পনা। সেখান হতে আরবদের কতিপয় লোভী নেতাদের যোগসাজসে তেলের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও ফিলিস্তিনীদের নির্মূল করে নতুন করে ইহুদী বসতি সম্প্রসারণের চিন্তা। এই কাজে উৎসাহী হয়েছে নরঘাতক নেতানিয়াহু ও তার দোসররা। কিন্তু সারা বিশ্বের মুসলমানরা এখন সরব হয়েছে, গর্জে উঠেছে একসাথে। মুসলমানরা জানেন যে, গাজা থেকে ফিলিস্তিনীদের একবারে নির্মূল করার পরিকল্পনার কাজ শুরু করলে সেটাই হবে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের জন্য বড় বিপর্যয়ের সূত্রপাত। মুসলমানদের স্বমস্বরে গর্জে উঠার আজকের ধরণ আপাতত: সেই ভবিষ্যৎবাণী স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
ফিলিস্তিনীদের উপর ইসরাইলীদের নির্মম অত্যাচার নতুন কোন ঘটনা নয়। এই নির্মমতার পিছনে মার্কিনী ও ইউরোপীয় ও ভারত সরকারের ন্যাক্কারজনক সমর্থন, অর্থ ও মারণাস্ত্রের রসদ যোগানোও নতুন কোন ব্যাপার নয়। এমনকি নিরীহ ফিলিস্তিনীদের উপর ইসরাইলীদের বর্বরতার সময় সারা বিশ্ব যখন প্রতিবাদে উত্তাল তখন আরবরা নীরব কার স্বার্থে? বিশেষ করে সৌদি ও মিশরীয়রা নিশ্চুপ থেকে কোন বার্তা দিচ্ছেন? আবার ইসরাইলের ভেতরে ফিলিস্তিনিদের জন্য সহানভূতি দেখিয়ে কসাই নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে তেলআবিবের রাস্তায় ইসরাইলীদের মিছিল তাকে শিশু হত্যাকান্ড থেকে বিরত হতে বিন্দুমাত্র টলাতে পারছে না!
বাংলাদেশে ২০২৫ ঈদুল ফেতেরের ছুটিতে ফিলিস্তিনীদের উপর ইসরাইলীদের নির্মমতার বিরুদ্ধে এত বড় প্রতিবাদের পক্ষে মানুষ রাস্তায় নেমেছে তা বিশ্বের কাছে বিস্ময়কর। আসলে বিশ্বমুসলিম উম্মাহ্র সন্দেজনক নীরবতা এতদিন লাই দিয়েছে ইসরাইলীদেরকে আরো বেশী আগ্রাসী হতে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম ভোটারগণ সেখানকার চরম মুসলিম বিদ্বেষী, মানবতাবিরোধী কসাই, হটকারী, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সাম্প্রতিক নির্বাচনে ভোট দিয়ে জিতিয়ে এনে এখন চরম খেসারত গুনছে।
মুসলিমরা আজ মুসলমানের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। আরবরা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। মার্চে গাজা হত্যাকান্ডের নৃশংসতায় ইসরাইলীদের নির্মমতার বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের মানুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যখন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে উত্তাল তখনও সৌদিআরবের মানুষ নীরব-নিশ্চুপ। মিশরীয়রাসহ আরবের ধনাঢ্য বহু দেশ ঈদ আনন্দে মাতোয়ারা। আশ্চর্য্যজনক ভাবে আরবের শক্তিশালী দেশগুলো ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এবং দিচ্ছে তাদের প্রতিবেশী মুসলিম ভাইদের প্রাণরক্ষায়।
এ যেন বাকরুদ্ধ মানবতা! আরবদের নিশ্চুপ থাকলে হবে কি? আরবদের সন্দেহজনক নিরবতা সারা বিশ্বের মুসলমানকে তাদের উপর ঘৃণার বাণী ছুঁড়ে দিয়েছে। তারা আজ হেয় হয়ে গেছে বিশ্বের কাছে। কেউ কেউ তাদেরকে দাজ্জালের সহচর বলে উপহাস করছে। যদিও দাজ্জাল শব্দটি নামক প্রশ্নটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে গভীরভাবে আবেগপ্রবণ এবং প্রতীকী। এখানে “দাজ্জাল” শব্দটি কোরআন ও হাদীসে এসেছে ভবিষ্যতের এক প্রতারক ও ধ্বংসকারী চরিত্র হিসেবে, যাকে অনেক মুসলিম কেয়ামতের আগে আসবে বলে বিশ্বাস করেন। তবে আধুনিক রাজনৈতিক প্রসঙ্গে অনেকেই দাজ্জাল শব্দটি ব্যবহার করেন প্রতীক হিসেবে অন্যায়কারী, মিথ্যাবাদী ও ধ্বংসকারী শক্তিগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে।
তবে সবাই কি দাজ্জালের সহচর? ইতিহাস কি বলে? পবিত্র কুরআন কি প্রমাণ করে? সেটার ব্যাখ্যাও মনে রাখতে হবে বিশ্বাসীদেরকে।
১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বহু সংখ্যক প্যালেস্টিনিয়ান তাদের ভূমি ও ঘরবাড়ি থেকে উৎখাত হন। আরব দেশগুলো প্যালেস্টাইনিদের পক্ষ নিয়ে ইসরাইলের এই ভূমি দখলকে অবৈধ ও অন্যায় বলে মনে করে। ১৯৬৭ সালের ছয়দিনের যুদ্ধে ইসরাইল পশ্চিম তীর, গাজা, গোলান মালভূমি ও সিনাই উপদ্বীপ দখল করে নেয়। এই আগ্রাসন আরব দেশগুলোর মধ্যে ক্ষোভ বাড়ায়। এরপরও অনেক আরব দেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে (যেমন: সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো)। ফলে তারা গাজার মানুষের জন্য কার্যকর কোনো অবস্থান নেয় না। এটি অনেকের চোখে এক ধরনের ‘দাজ্জালীয় ভন্ডামি’। অনেক মুসলিম নেতৃত্ব কেবল বিবৃতি দেয়, বাস্তবে কিছুই করে না। ইসরাইলকে অস্ত্র, প্রযুক্তি ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে আসছে বছরের পর বছর। জাতিসংঘে প্রস্তাব ঠেকানো, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে চুপ থাকা ইত্যাদি কারণে তাদের অনেকেই এই সহিংসতার ‘নীরব সমর্থক’ হিসেবে বিবেচিত।
অনেকে বলেন, ‘গাজার বাস্তবতা আড়াল করে প্রোপাগান্ডা চালানো, ইসরাইলের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’কে প্রাধান্য দিয়ে নিরস্ত্র শিশুদের মৃত্যু আড়াল করাও এক ধরনের ‘প্রতারণা’, যা দাজ্জালের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়।’
তবে জেরুজালেম শহরটি ইহুদি, মুসলিম ও খ্রিস্টান তিনটি ধর্মের জন্যই পবিত্র স্থান। ইসরাইল পুরো জেরুজালেমকে নিজেদের রাজধানী হিসেবে দাবি করে, যেখানে পূর্ব জেরুজালেমকে ভবিষ্যৎ প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে দেখতে চায় মুসলিম বিশ্ব। কিন্তু গাজার ওপর বিমান হামলা, অবরোধ, নির্বিচারে বোমা বর্ষণ, অসংখ্য বেসামরিক মানুষের মৃত্যু ও মানবিক সংকট সৃষ্টির জন্য সরাসরি দায়ী ইসরাইলের সামরিক অভিযান।
জাতিসংঘ এখানে চরম শিথীলতা দেখাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার কর্তা-কর্মীরা কোন ‘রা’ করছেন না গাজায় নির্বিচার হত্যার বিরুদ্ধে। তবে তারা সবাই কি মার্কিনীদের ভয়ে তটস্থ? নাকি কথিত দাজ্জালের সহচর তারাও? এই প্রশ্নগুলো নতুন করে দেখা দিয়েছে ২০২৫-এর পাঁচ এপ্রিলের পর থেকে!
এত নির্মম হত্যাকান্ড সহ্য করা যায় না। একটি দেশ দখল করে কেউ বিলাসবহুল রিসোর্ট বানাবে তা কোনভাবেই মেনে নেয়ার মতো নয়। মাৎস্যন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা কথা বলে গণতন্ত্র কে তাদের বাহুতলে বার বার অন্যায়ভাবে পিষ্ট হতে দেখে বাংলাদেশের মানুষ দলমত নির্বিশেষে ফুঁসে উঠেছে ইসরাইলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। নিপাত চাচ্ছে মার্কিন সরকারের।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে বিশ্বের সকল কর্ণারে এই প্রতিবাদের ভাষা বার্তা হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে সার্বক্ষণিকভাবে। তবে সেটা কি এ পর্যন্ত আসল জায়গায় আঘাত করতে পেরেছে? অথবা না পারলে কবে সেই সঠিক জায়গায় পৌঁছুবে বলে মনে হয়?
তাই যত দিন যাচ্ছে এই প্রতিবাদ এখন ততই প্রতিরোধের দিকে গড়াচ্ছে। আমাদের দেশে এই আন্দোলন তুমুল হয়ে উঠছে দিন দিন। ছাত্র-জনতার সাথে রাজনৈতিক দলগুলো নেমে পড়েছে রাস্তায়। বিএনপি, বাংলাদেশ জামাতে ইসলামী, এনসিপি, ছাত্রদল, ছাত্র শিবির, আহলে হাদীস আন্দোলন, ইসলামী যুব আন্দোলন, একুশে চেতনা ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, মোর্চা আলাদা আলাদাভাবে ইসরাইলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমে পড়েছে। তারা ফিলিস্তিনী স্বাধীনরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা চায়, ইসরাইলী পণ্য বয়কট চায়, ইসরাইলকে হেদায়েত দিতে গায়েবী সাহায্য চেয়ে মহান আল্লাহ্র দরবারে মোনাজাত করে অথবা হেদায়েতপ্রাপ্ত না হলে ইসরাইলকে ধ্বংস করে দেবার আঁকুতি জানায়। এভাবে বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের একতা, সহমর্মিতা ও প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে গেছে বলে অনেকের যে ধারণা ছিল যা আজ মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে।
প্রতিদিন-রাত নিরীহ ইসরাইলীদের নির্মমতার বলি ফিলিস্তিনী নারী-শিশুদের নতন নতুন মৃত্যুসংখ্যা শোনায় পশ্চিমা মিডিয়া। আমরা সেটা শুনতে শুনতে কার ঝালাপালা করে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে গেছি। কিন্তু আরব বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে ওদের নির্যাতিত প্রতিবেশী ভাইদের প্রতি ভূমিকা কি? তারা কি প্রতিক্রিয়া দেখালো? তারা কে কি দায়িত্ব পালন করছে বা করলো তা নিয়ে বিলাসী শেখদের বিরুদ্ধে সমালোচনা দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে।
আরব নেতাদের সবার উচিত বাংলাদেশসহ গোটা মুসলিম বিশ্বের আহবানে সাড়া দিয়ে দ্রুত জেগে ওঠা। অবশিষ্ট ফিলিস্তিনী নারী-শিশুদের প্রাণ রক্ষা ও স্বাধীন ফিলিস্তিন ভূখন্ডের জন্য আমাদের গর্জন ও আহবানের সাথে নির্লিপ্ত অথচ শক্তিশালী আরব দেশগুলো একটু হুংকার ছাড়লেই মার্কিন প্রশাসন সুর পাল্টাতে বাধ্য হবে বলে বিশ্লেষকগণ আশা প্রকাশ করেন। মার্কিন সমর্থন জিরো হলে গাজা থেকে নেতানিয়াহু লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাবেন সহসাই।
এজন্য আমাদের সবার সেন্টিমেন্টের সংগে একাত্মতা ঘোষণা করে অন্তবর্তী সরকারকে আর লুকোচুরি না করে প্রতিবাদ করতে হবে জোর গলায়। শুধু বর্তমান ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরব নেতাদের নিয়ে ড. ইউনুস খুব দ্রুত একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের আয়োজন করতে পারেন, ঢাকায়-এই নতুন বাংলাদেশে। যা বাংলাদেশকে আরো একধাপ সামনে এগিয়ে নিতে পারে। এভাবে আমাদের নবজাগরিত উত্তাল জনতার গর্জে ওঠা বলিষ্ঠ কন্ঠস্বরের গর্জন আসল জায়গায় পৌঁছে গিয়ে আঘাত করুক, ফিলিস্তিন সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সবার গর্জন ও হুঙ্কার সরব থাকুক। সকল নির্যাতন সহ্য করে প্রিয় ফিলিস্তিন তুমি দ্রুত স্বাধীনতা লাভ করবে- এই প্রত্যাশা।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.