শনিবার | ১০ মে, ২০২৫ | ২৭ বৈশাখ, ১৪৩২

না ফেরার দেশে সাংবাদিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা পিপলু

নাটোর প্রতিনিধি :
নাটোরের প্রবীণ সাংবাদিক ও একুশে টেলিভিশনের প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার নবীউর রহমান পিপলু ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি দীর্ঘদিন ব্লাড ক্যান্সার ও বোনম্যারো রোগে ভুগছিলেন।
মঙ্গলবার (৬ মে ২০২৫) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকার এএমজেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। তিনি স্ত্রীসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তবে তার কোনো সন্তান ছিল না।
নবীউর রহমান পিপলু ১৯৫৭ সালের ১০ জানুয়ারি বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতার চাকুরির সুবাদে তিনি সপরিবারে নাটোরে আসেন। তিনি নাটোরের আলাইপুর এলাকার বাসিন্দা এবং তৎকালীন নাটোর হাসপাতালের কর্মচারী রশিদুর রহমান ও নূরুননেছা বেগমের দ্বিতীয় সন্তান। ১৯৮১ সালে সাংবাদিকতা শুরু করে একুশে টেলিভিশনের শুরু থেকে নাটোর প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
নাটোরের সিনিয়র সাংবাদিক এবং একমাত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক নবীউর রহমান পিপলু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম। তিনি শুধু একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধাই নন, বরং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সাংবাদিকতা ও সমাজসেবার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
তাঁর মৃত্যুতে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিকসহ নানা ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে গভীর শোক এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও বীরত্ব:
১৯৭১ সালে নবীউর রহমান পিপলু মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নাটোরের ট্রেজারি থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কলেজের ছাত্রাবাসে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরে ভারতের বালুরঘাট, রায়গঞ্জ ও শিলিগুড়ির বিভিন্ন ক্যাম্পে গেরিলা ও অ্যাডভান্স প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। তিনি ৭ নম্বর সেক্টরের তুফানি ব্যাটালিয়নের সদস্য হিসেবে হিলি, পাঁচবিবি, জয়পুরহাট, গোবিন্দগঞ্জ ও নওগাঁ এলাকায় গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য অভিযানে নওগাঁ সীমান্তের ফার্সিপাড়া সেতু ধ্বংস করতে গিয়ে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হন এবং সফলভাবে শত্রুদের পিছু হটাতে সক্ষম হন।
সাংবাদিকতা ও সমাজসেবা:
মুক্তিযুদ্ধের পর নবীউর রহমান পিপলু সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন। নাটোরের সিংড়া প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, দৈনিক সমকাল ও একুশে টেলিভিশনের নাটোর প্রতিনিধি এবং নাটোর থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনাটোর ২৪ ডটকমের প্রকাশক ছিলেন। এছাড়াও তিনি রাজশাহী থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল পদ্মাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেছেন। তিনি নাটোর টিভি রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার সাংবাদিকতা জীবনে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস তুলে ধরতে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। ক্যামেরা হাতে নাটোরের পথে-প্রান্তরে ছুঁটে বেড়িয়েছেন সংবাদের খোঁজে।
পারিবারিক জীবন:
নবীউর রহমান পিপলুর পরিবারে ১১ ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় তিনি। তার আরও ৯ ভাইবোন জীবিত রয়েছেন। তার বাবা রশিদুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়েছেন। তবে দুঃখজনকভাবে তার নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সহযোদ্ধা ও শহীদদের স্মৃতি বহন করেন এবং তাদের অবদানকে স্মরণ করে গেছেন।
সম্মাননা ও স্বীকৃতি:
নবীউর রহমান পিপলু তার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য বিভিন্ন সময়ে সম্মাননা পেয়েছেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক কমান্ডের আয়োজনে ৩৫ বীর মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিকদের মধ্যে সংবর্ধিত হন। এছাড়া, তিনি নাটোরে গঠিত সংবাদপত্র রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের কার্যক্রমেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন।
তাঁর সহকর্মীরা জানান, তিনি আমাদের জাতির গর্ব। তার সাহস, ত্যাগ ও নিষ্ঠা আমাদের প্রেরণা জোগায়। তরুণ প্রজন্মের উচিত তার মতো বীরদের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশপ্রেম ও মানবসেবায় নিজেদের নিয়োজিত করা।

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.