নাটোর প্রতিনিধি :
নাটোরের লালপুরে রাজনৈতিক ও প্রশাসনের ছত্রছায়ায় ইমো হ্যাকার চক্রের দৌরাত্ম অব্যাহত রয়েছে। ‘ইমো হ্যাকার’ ও ব্যাংক রিসিট প্রতারক চক্রের সদস্য লালপুর উপজেলা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ওয়াহিদুজ্জামান সরকারের ছেলে ও নাটোর জেলা ছাত্রদলের সহ আইন বিষয়ক সম্পাদক এস এম শাহরিয়ার পারভেজ পল্লবসহ তিনজনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে সেনাবাহিনী। রোববার আদালতের মাধ্যমে তাদেরকে নাটোর জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
শনিবার (২৪ মে ২০২৫) দিবাগত রাত ৮ টার দিকে উপজেলার বিলমাড়িয়া ইউনিয়নের মোহরকয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদেরকে আটক করা হয়।
আটককৃতরা হলেন, উপজেলার লালপুর ইউনিয়নের মমিনপুর গ্রামের ফিরোজ আলীর ছেলে মুশফিকুর রহিম প্রান্ত (১৮), লালপুর উপজেলা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ওয়াহিদুজ্জামান সরকারের ছেলে ও নাটোর জেলা ছাত্রদলের সহ-আইন বিষয়ক সম্পাদক এস এম শাহরিয়ার পারভেজ পল্লব (৩১) এবং জিয়া সরকারের ছেলে জাহিদ হাসান জীবন (১৯)।
জানা যায়, অভিযানকালে তাদের নিকট থেকে মোবাইল ফোন, সিম কার্ড, একটি ল্যাপটপ ও একটি মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়েছে। প্রথমিক জিজ্ঞাসা শেষে তাদেরকে লালপুর থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-তদন্ত) মো. মমিনুজ্জামান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, আটককৃতদের থেকে কয়েকটি মোবাইল ফোন, সিম কার্ড, একটি ল্যাপটপ ও একটি মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা করা হয়েছে। রোববার আদালতের মাধ্যমে তাদেরকে নাটোর জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ছত্রছায়া, মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের সহায়তা ও প্রশাসনের নিরবতায় নাটোরের লালপুরে ২০১৪ সাল থেকে নির্ভয়ে হ্যাকিং কার্যক্রম চলে আসছে। ফলে হ্যাকিংয়ের সদর দপ্তর খ্যাত উপজেলার বিলমাড়িয়া ইউনিয়ন থেকে এখন পাশ্ববর্তী ইউনিয়ন ও উপজেলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে হ্যাকিং কার্যক্রম। আতঙ্কের বিষয় হল এ চক্রের অধিকাংশ সদস্য অল্প বয়সী কিশোর ও যুবক। গ্রামের উঠতি বয়সী এ সকল কিশোর, যুবক ও ঝরে পড়া স্কুল শিক্ষার্থীরা ইমো হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে টাকা উপার্জন করছে। হ্যাকিংয়ের টাকা দিয়ে তারা কিনছে উচ্চমূল্যে জমি, নামি ব্র্যান্ডের দামি গাড়ি, তৈরি করছে বিলাসবহুল বাড়ি ও আসবাবপত্র। অভিভাবকরাও অর্থের প্রলোভনে এই অবৈধ কাজকে সমর্থন করছেন। অনেকে এখন এই অবৈধ হ্যাকিংকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করছে।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, হ্যাকিংয়ে জড়িতরা সাধারণত দিনে ঘুমায়। বিকেলে তারা মাদক সেবনের উদ্দেশ্যে মোটরসাইকেলে করে বাঘা উপজেলার আলাইপুর ও মিরগঞ্জের বিভিন্ন মাদক বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে যায়। মাদক সেবন শেষে তারা নির্দিষ্ট চা স্টলে যাত্রা বিরতি করে। তাদের সুবিধার্থে সেখানে রয়েছে গোপনীয় (বিশেষ) চেম্বার।
লালপুরের একজন ইলেকট্রিসিয়ান বলেন, উপজেলার ঝরে পড়া অনেক শিক্ষার্থী, ইজিবাইক ও পাওয়ার টিলার চালকরা ইমো হ্যাকিং করে এখন কোটিপতি। অথচ কিছুদিন আগেও তারা কিংবা তাদের অভিভাবকরা দিন মজুর ও ভ্যান চালাতো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক হ্যাকার বলেন, তারা সাধারণত প্রবাসী ও ধনী ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে প্রথমে সামাজিক মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপন করেন। পরে কৌশলে তাদের ইমু কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হ্যাক করে অর্থ হাতিয়ে নেন। এক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বর ব্যবহার করে থাকেন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্টরা ২০-৩০% কমিশনে হ্যাকারদের টাকা উত্তোলনে সাহায্য করে থাকেন।
আরেক হ্যাকার বলেন, হ্যাকিংয়ের সাথে স্থানীয় ইউপি সদস্য ও গ্রাম পুলিশরাও জড়িত। প্রতি মাসে তাদের চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেওয়া হয়। তবে টাকা দিয়ে সবাইকে ম্যানেজ করা হয়। এজন্য হ্যাকারদের একাধিক গোপন সংগঠন রয়েছে। কেউ আটক হলে কিংবা আইনি ঝামেলায় পড়লে অন্যরা তাকে মুক্ত করে আনে। তাদের কাছে টাকা কোন ফ্যাক্ট নয়।
মাদক সেবনের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, রাত জেগে কাজ করার জন্য গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য হ্যাকিংয়ের একটি অনুসঙ্গ হিসেবে সেবন করা হয়। এক্ষেত্রে হ্যাকারদের দুইভাগে ভাগ করা হয়। যারা শিক্ষানবিশ হ্যাকার, তারা সাধারণত গাঁজা সেবন করে। আর যারা হ্যাকিংয়ে দক্ষতা অর্জন করে, তারা ফেনসিডিল ও ইয়াবা সেবন করে। হ্যাকিংয়ে প্রতি মাসে গড়ে কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা হ্যাক করতে পারলে তাকে দক্ষ হ্যাকার ধরা হয়।
এ বিষয়ে বিলমাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহবায়ক ছিদ্দিক আলী মিষ্টু বলেন, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিন্টু হ্যাকারদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বর্তমানে পুলিশের নিরবতায় নির্ভয়ে হ্যাকিং কার্যক্রম চলছে।
সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান মিন্টু অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, লালপুরের বিলমাড়িয়াতে ২০১৪-১৫ সাল থেকে ইমু হ্যাকিং শুরু হয়। আমি কঠোর হাতে ইমু হ্যাকারদের দমন করার চেষ্টা করলে সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদ আমাকে হত্যার হুমকি দেন। তারপরও আমি হ্যাকারদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিলাম।
আত্মগোপনে থাকায় এ বিষয়ে সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
থানা সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালে হ্যাকিংয়ে জড়িত থাকার অভিযোগে থানায় ৪টি মামলা হয়। এরপর আর কোন মামলা হয়নি। উল্লেখ্য, ২০২২ ও ২০২৩ সালে গণমাধ্যমে ইমু হ্যাকিং নিয়ে ব্যাপক সংবাদ প্রচার হলে প্রশাসনের তৎপরতায় হ্যাকিং কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু ২০২৪ সাল থেকে প্রশাসনের রহস্যময় নিরবতায় আবার হ্যাকার চক্রগুলোর দৌরাত্ম বাড়ে।
এ বিষয়ে লালপুর থানার (ওসি-তদন্ত) মো. মমিনুজ্জামান বলেন, লালপুর উপজেলায় যে সমস্ত হ্যাকার রয়েছে তারা সাধারণত অন্য জেলার মানুষ ও প্রবাসীদের আইডি হ্যাক করে টাকা আত্মসাৎ করে থাকে। ভুক্তভোগীরা অনেক সময় মামলা করে না কিংবা করলেও তাদের নিজস্ব থানায় মামলা করে থাকেন। এতে লালপুর থানা থেকে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। এ বিষয়ে সকলকে সচেতন হওয়ার আহবান জানান তিনি।