মঙ্গলবার | ৩ জুন, ২০২৫ | ২০ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২

বাজেট হোক ভেতরের ভাবনামুক্ত ও জন-প্রত্যাশাপূরণের

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
আর ক’দিনের মধ্যে জাতীয় বাজেট পেশ করা হবে। এনিয়ে একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেল এবছরও আয়োজন করেছে- কেমন বাজেট চাই অনুষ্ঠান। এবছরের জাতীয় বাজেট নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা ও কৌতুহলের শেষ নেই। বিশেষ করে অন্তবর্তী সরকারের দশমাস সময় না পেরুতেই গণমানুষের প্রত্যাশার প্রেক্ষিতে বহুমুখী দাবীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেয়েছে সরকার। এজন্য ক’দিন পূর্বে সরকারকে পদত্যাগের কথাও প্রকাশ করতে হয়েছিল। টিভি চ্যানেলটি স্টুডিওতে অংশগ্রহণকারী বক্তা, দর্শকগণ নানা মতামত ব্যক্ত করেছেন। সেখানে তত্ত্বীয় কথার পাশাপাশি আইসিইউ থেকে টেনে বের করা অর্থনীতির জন্য যেন ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে না হয় সে বিষয়ে সজাগ থাকার কথা বলা হয়েছে।
ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা বলেছেন অর্থনীতির পাশাপাশি বহু ইন্ডাস্ট্রীও আইসিইউতে থাকার মতো অবস্থা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন শ্রমিক অসন্তোষ, সূতা অবিক্রিত, তৈরী পোশাক, অন্যান্য পণ্য সহজে রপ্তানীর নিশ্চয়তার কথা। এজন্য প্রত্যাশা নীতি সহায়তার মাধ্যমে কর অব্যাহতি, নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত, বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরীর কথা। উপস্থিত বিজ্ঞজনরা বলেছেন বাজে অপরগতা, বাজে সীমাবদ্ধতা, সংকীর্ণতা, সংক্ষিপ্ততা দূর করে এগিয়ে যাবার কথা।
চ্যানেলটির স্টুডিওতে অংশগ্রহণকারী বক্তা, দর্শকদের পাশাপাশি স্টুডিওর বাইরের দর্শকদের মতামত তুলে ধরা হয়েছে। স্টুডিওর ভেতরের অংশগ্রহণকারীরা য বলেছেন তার বাইরের দর্শকদের মতামত আজকের আলোচনায় আমার কাছে দাগ কেটেছে বেশী। এনিয়ে আমি প্রায় একমাস আগে একটি নিবন্ধে লিখেছিলাম- ‘বেকারত্ব জিইয়ে রাখা গতানুগতিক বাজেট চাই না।’ আজ সে কথাটির প্রতিধ্বণি যেন স্টুডিওর বাইরের দর্শকদের মতামত থেকে আবারো শোনা গেল। খুলনা, চট্টগ্রামের দর্শকরা বললেন সামান্য বৃষ্টিতে ঢাকার মতো তাদের শহরও তলিয়ে যাবার কথা। নি¤œআয়ের মানুষ, বস্তিবাসীদের কেউ বললেন -টিসিবি পণ্যের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য বাজেট চাই। বেকার, শিক্ষিত বেকার ছাত্র তরুণদের মুখে শোনা গেল কর্মসংস্থানের জন্য, চাকুরীর জন্য বাজেট চাই।
তাই আজকের আলোচনায় সরকারের মধ্যে ভেতরের ভাবনামুক্ত ও বাইরের গণমানুষের প্রত্যাশাপূরণের বাজেট চাই কথাটি যেন নতুন করে দাবী হিসেবে উঠে এলো।
আমরা জানি প্রতিবছর বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট প্রণয়নের কয়েকমাস আগে থেকে নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে যায়। আগামী ২০২৫-২০২৬ অর্থছরের বাজেট চলতি সালের জুন মাসের কোন একসময় পেশ করা হবে। এটা হবে আমাদের দেশের ৫১ তম জাতীয় বাজেট। এবারের জাতীয় আর্থ-সামাজিক কর্মসূচির মাত্রার চাহিদা ও অর্থযোগানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনেকটা ভিন্ন। এসময় একটি নতুন বাংলাদেশের ধারণায় তরুণদের ভাবনার সাথে প্রান্তিক ও সাধারণ গণমানুষের চিন্তাধারার ব্যাপক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। জুলাই বিপ্লবের সাত মাস গত হবার পরও সেটা বিদ্যমান রয়েছে এবং ক্রমাগত লক্ষ্যণীয় থাকায় ২০২৫ সালের বাজেট একটি সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করতে যাচ্ছে।
এমতাবস্থায় জনগণের নিকট জাতীয় বাজেটের ধারণা ও অন্তবর্তী সরকারের ইপ্সিত সংস্কার কর্মসূচির বাস্তবায়ন এবং জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন- ইত্যাকার সবকিছু মিলে সামনে একটি বড় জটিল অবস্থা আঁচ করা যাচ্ছে। পরিসংখ্যানের দিকে দৃকপাত করলে আমাদের জাতীয় বাজেটের অংক এখন অনেক বড় মাপের। গতবছরের মতো এবারেও বার্ষিক জিডিপি-র প্রবৃদ্ধির হার ৬.৮ শতাংশের উর্দ্ধে বা আরো বেশী ধরা হতে পারে।
২০২৫ সালের দুইমাসের অধিক সময় কেটে গেলেও শিক্ষাঙ্গণে অস্থিরতা কোনভাবে কাটিয়ে উঠতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নাকাল হয়ে পড়ছে এর দায়িত্বরতগণ। দ্রব্যমূল্যে উধ্বগতি ও কোন কোন ক্ষেত্রে ‘দ্রব্যমূল্যসন্ত্রাস’ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ায় নিত্যপণ্যের বাজার সামলানো বড় কঠিন হয়ে পড়েছে। আরো বহুবিধ বিষয় রয়েছে সেগলো এখানে উল্লেখ করা অর্থহীন। তদুপরি আগামী ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট কেমন হওয়া উচিত সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পওয়া কঠিন হলেও কিছু ইতিবাচক চিন্তাভাবনা তো বের করতেই হবে!
তবে এবার কেন আগের মতো কোন গতানুগতিক বাজেট চাই না তা একটু বিশ্লেষণ করা যাক। প্রথমত: দেশে বড় পরিবর্তন সূচিত করেছে ঝলসে ওঠা বিরাট তরুণ জনগোষ্ঠী। তারা আমাদের সচেতন জনসমাজ। জুলাই ২০২৪ আন্দোলনের মূল কারণ ছিল তাদের চাকুরীতে ঠাঁই না পাবার বড় বেদনার আহাজারি। তারা মনে করেছে উচ্চশিক্ষিত হয়েও বেকার জীবন কার সহ্য হয়? তাই তো চাকুরী নিয়ে সরকারী কোটার অব্যবস্থাপনা অবলোকন করে তারা প্রতিবাদ করার এক পর্যায়ে সরকারের তাচ্ছিল্যপনা শুনে দ্রæত ক্ষেপে উঠে এবং অতি সহজেই জোটবদ্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে।
কারণ বেকারত্বের এই দূরাবস্থা বহুবছর ধরে অবলোকন করার পরও বিগত সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় শতাধিক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দিয়ে শিক্ষিত বেকারদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে। যেখানে পাঁচকোটি টাকার বিনিময়ে ভিসি নিয়োগর সংবাদও হয়তো কারো অজানা নয়। অপরদিকে সরকারী ও বেসরকারী কিছু নিয়োগ ক্ষেত্র তৈরী করা হরেও তাদের বিরাট অংশ সেখানে ঘুসবাণিজ্যের নিকট পরাজিত হতে হতে নিজেদেরকে অসহায় মনে করে এবং জীবনের প্রতি তাদের চরম ঘৃণা তৈরী হয়ে যায়।
অনেক উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী শিক্ষার্থীরা বার বার বিসিএস, মেডিকেল, ব্যাংকবীমা, নৌপরিবহন, স্কুল-কলেজ ইত্যাদির নিয়োগের ক্ষেত্রেও ঘৃণ্য দলীয় রাজনীতির নিষ্পেষণে চাকুরী থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। সেসব লোভনীয় চাকুরীতে পদের সংখ্যাও কম। তার উপর নানা শর্তের বেড়াজাল ও বৈষম্য তৈরী হয়ে যাওয়ায় বিষয়টি খুব কালো হয়ে ঘণীভূত হয়ে পড়ে। তিন-চার লক্ষ চাকুরী প্রার্থী বিসিএস চাকুরীতে আবেদন করে দুই থেকে তিনবছর অপেক্ষা করার পর শেষমেশ বিফল হলে তাকে শুধু নিয়তির পরিহাস বলা বড়ই নির্মমতা। কারণ, এই নাজুক অবস্থার পিছনে আমাদের দেশে সরকারীভাবে চাকুরী ক্ষেত্র সম্প্রসারণ না করে অহেতুক রাজধানীকেন্দ্রিক শতাধিক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় তৈরীর ব্যবসায়িক অনুমোদন দান ও মেগা নির্মাণ কাজে অর্থ ও সময় ব্যয় করা।
যার প্রভাব জুলাই বিপ্লবের পরেও আরো ভয়ংকর হিসেবে দৃশ্যমান হতে চলেছে। অর্থ্যাৎ, উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী শিক্ষার্থীরা বেকার বসে দিনগুজরান করে চলেছে যারা সংখ্যায় মোট উচ্চশিক্ষিতদের শতকরা ৪২ ভাগেরও উপরে। বেকারত্মের সুযোগে তারা যে কোন ঠুনকো বিষয় অবলোকন করে রাজপথে নেমে জটলা সৃষ্টি করে চলেছে প্রতিনিয়ত। মজার ব্যাপার হলেও সত্যি যে, অন্তবর্তী সরকারের একজন তরুণ উপদেষ্টা মন্তব্য করেছিলেন- ‘তিনি উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন শেষ হলে আবারো আগের মতো বেকার হয়ে যাবেন’!
তাই বেকারদের চাকুরী ও কর্মসংস্থানের জন্য বড় বাজেট চাই। শিক্ষিত বেকারদের মুখের দিকে তাকানো যায় না। তারা নিজেদের জন্য, পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য বোঝা হয়ে না থেকে গঠণমূলক কাজে অংশ নেবার দ্রæত সুযোগ লাভ করাক এজন্য সর্বাগ্রে তাদের কর্মসংস্থানের সুস্পষ্ট নীতিমালা হাতে নিতে হবে। এজন্য আগামী ২০২৫-২০২৬ জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রেখে এবারের বাজেট প্রণয়ন করা জরুরী।
সুতরাং, বাজেটের সংস্কার হওয়া উচিত সাধারণ বেকার ও উচ্চশিক্ষিত বেকারদের দ্রæত চাকুরী বা কর্মসংস্থান নিয়ে। এ নিয়ে আমরা আর কোন ক্রমাগত কুটতর্ক চাই না। বেকারদের তরুণদের চাকুরী হলে পথে ব্যারিকেড দিয়ে আন্দোলন ও দাবী করার সময় পাবে না, জনদুর্ভোগ অনেক কমে যাবে।
এছাড়া অতিদরিদ্র ও নি¤œআয়ের মানুষের জন্য তৃণমূল পর্যায়ে সেবা বাড়ানোর বাজেট রাখা প্রয়োজন। পোশাক শ্রমিক ও উৎপাদনমুখী কলকারখানা এলাকায় সুস্থ্য পরিবেশ বজায় রাখার জন্য বাজেটে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। স্বল্পদামে পণ্যকেনার জন্য ট্রাকের পিছনে প্রতিদিন হড়োহুড়ি ও হাতাহাতি দেখতে কার ভাল লাগে? সারা দেশে টিসিবির পণ্য সেবা বাড়ানোর বাজেট চাই। বিধবা ও বয়স্কভাতা দ্বিগুণ করার বাজেট থাকা উচিত।
সরকারী কিছু কর্মকর্তার বেতনের বাইরে বাড়তি আয় খুবই বৈষম্যের ইঙ্গিত বহন করে। যেমন, সরকারী উচ্চপদের এমনকি জেলা পর্যায়ে একজন সরকারী কর্মকর্তা সিটিং এলাউন্সের নামে বৈষম্যমূলকভাবে অর্থ গ্রহণ করে থাকেন। কেউ একাই শতাধিক কমিটির সভাপতি বা সদস্য হিসেবে প্রতিটি সভায় আপ্যায়ন ভাতা ও সিটিং এলাউন্স গ্রহণ করে মাসিক লক্ষ টাকা আয় করে থাকেন। একজন সভাপতি মাসে কয়টি সিটিং এলাউন্স গ্রহণ করতে পারবেন এবং একই দিনে চার-পাঁচটি মিটিং থাকলে কয়বার আপ্যায়ণ ভাতা গ্রহণ করবেন তার বাজেট কে যোগান দেয়? এর নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করে দেয়া দরকার।
জুলাই বিপ্লবের মাত্র দশ মাসের ব্যবধানে সারা দেশে চুরি, ছিনতাই, বাসডাকাতি, ধর্ষণ, খুন ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। পরিবার ও সমাজের নিয়ন্ত্রণহীন কিশোরদের পাশাপাশি অনেক বৈষম্য প্রপীড়িত বেকার তরুণ, যুবা বাধ্য হয়ে ভয়ংকর অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। অপরাধীরা বাড়তে থাকলে দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে ভয়ংকর সামাজিক ভাঙ্গন সৃষ্টি হতে থাকবে। যা ইতোমধ্যে কুৎসিতভাবে মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে।
ছোট পদের সরকারী চাকুরীজীবিদের মধ্যে আয়-ব্যয়ের হিসেব মেলাতে না পেরে হতাশা বেড়ে গেছে। সকল সেক্টরে সব কর্মকর্তা-কর্মচারী পর্যায়ে চিকিৎসাকে সহজ করা ও বাজারের নিত্যপণ্য ক্রয়ক্ষমতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বেতনভাতা বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকা অত্যাবশ্যক।
এসব বিষয় চুলচেরা বিশ্লেষণ করার পর আর্থিক খাতে গতানুগতিকতা সংস্কার করার জন্য আগে একটি গণতান্ত্রিক সরকার ও শক্ত কমিটমেন্ট প্রয়োজন। এজন্য অনবরত হঠকারীতামূলক তর্ক না করে বেকারত্ব কমানোর ঐক্য গড়ে তোলা দরকার। এজন্য সরকারের ভেতরের ভাবনামুক্তি করে এমন ও বাইরে গণমানুষের যৌক্তিক দাবী ও প্রত্যাশাপূরণে পারঙ্গম তেমন জনকল্যণমূলক বাজেট বরাদ্দ বেশী থাকা দরকার। অতএব দেশের সবার কথা মাথায় রেখে একটি জনকল্যাণমূলক জাতীয় বাজেট প্রণয়ণ ও পেশের দৃঢ় অঙ্গীকার থাকা জরুরী।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.