বুধবার | ২ জুলাই, ২০২৫ | ১৮ আষাঢ়, ১৪৩২

মহাসড়কের পাশের বসতবাড়ি অনিরাপদ, প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা

নাটোর প্রতিনিধি :
বয়স ৭৮ বছর হলেও মুখমন্ডলের চামড়ায় এখনো সে ছাপ পড়েনি। শারীরিক রোগ-শোকের জটিল কোন সমস্যা দেখা দেয়নি। তবে মাথার চুল ও মুখের দাঁড়ি শুভ্র রঙ ধারণ করেছে। দিব্যি চলাফেরা করতে পারেন। নিয়মিত দুই ছেলে আর নাতি-নাতনীদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। সহধর্মিণী বিয়োগের স্মৃতি নিয়ে কেটেছে গত তিনটি বছর। বাড়ি থেকে ৩ শ মিটার দূরে পাইকপাড়া বাজার জামে মসজিদে নামাজ পড়ে নিয়মিত স্ত্রীর জন্য দোয়া করতেন। হয়তো আরও কিছুদিন সেই স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলেন। বড় নাতি রিপন ও ছোট ভাইদের সঙ্গে দেখা করার জন্য নিজ বাড়ি থেকে প্রতিদিন এক কিলোমিটার হেঁটে যেতেন। ছেলের বাড়িতে খেতেন সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার।
গত মঙ্গলবার (২৪ জুন ২০২৫) ফজরের নামাজ শেষে ছোট ভাই মো. সিদ্দিক আলীর সঙ্গে প্রতিদিনের মতো হাঁটাহাঁটি করে নিজ বাড়ি সংলগ্ন রাস্তার ধারে একটু দাঁড়িছিলেন। এই দাঁড়ানো যে তার শেষ দাঁড়ানো! বানেশ্বর-লালপুর-ঈশ্বরদী আঞ্চলিক মহাসড়কের উধনপাড়া নামক স্থানে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি ট্রাক বাড়ির আঙ্গিনায় ঢুকে পড়ে কেড়ে নিয়েছে মুন্তাজ আলীর (৭৮) প্রাণ।
নাটোরের লালপুর উপজেলার বিলমাড়িয়া ইউনিয়নের উধনপাড়া গ্রামের মৃত সুলতান মন্ডলের বড় ছেলে মুন্তাজ আলী। অনিয়ন্ত্রিত, অদক্ষ ও দায়িত্বজ্ঞানহীন চালকের কারনে মহাসড়কের পাশে বাড়ির আঙিনাও এখন আর নিরাপদ নয়। জীবন দিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন মুন্তাজ আলী।
শুক্রবার (২৭ জুন ২০২৫) সকালে উপজেলার আড়বাব ইউনিয়নের কচুয়া বাজারের পাশে ট্রাক-মোটর সাইকেল সংষর্ষ হয়। মোটর সাইকেল চালক জাহাঙ্গীর আলমকে (২৮) আহত অবস্থায় লালপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ট্রাক ড্রাইভার পালিয়ে গেছেন। আহত ব্যক্তি উপজেলার আড়বাব ইউনিয়নের বড় বিলশলিয়া গ্রামের আলাউদ্দিনের ছেলে।
লালপুর ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, লালপুর থানা, হাসপাতাল ও পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যমতে, গত ৬ মাসে উপজেলার বিভিন্ন সড়কে গভীর রাত থেকে সকাল পর্যন্ত কমপক্ষে ১৪টি শুধু ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিজেই সড়কের উপর কিংবা আশেপাশে উল্টে পড়াসহ মোট ২২ টি যানবাহন দুর্ঘটনায় বেশ কিছু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
দুর্ঘটনা প্রবাহ:
শুক্রবার (২৭ জুন ২০২৫) উপজেলার আড়বাব ইউনিয়নের কচুয়া বাজারের পাশে ট্রাক-মোটর সাইকেল সংষর্ষে আহত মোটর সাইকেল চালক বড় বিলশলিয়া গ্রামের আলাউদ্দিনের ছেলে জাহাঙ্গীর আলমকে (২৮) লালপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ট্রাক চালক পালিয়ে যান।
মঙ্গলবার (২৪ জুন ২০২৫) উপজেলার বিলমাড়িয়া ইউনিয়নের উধনপাড়া গ্রামে সকাল ৬ টায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ট্রাকের চাপায় মুনতাজ আলী (৭৮) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে এবং ঈশ্বরদী ইউনিয়নের পালিদেহা গ্রামে সকাল পৌনে ৭ টায় দুর্ঘটনায় ইপিজেড শ্রমিকদের পরিবহনকারী ইঞ্জিন চালিত দুটি ভ্যানের সংঘর্ষে ১৪ জন আহত হন।
১৮ জুন পাইকপাড়ায় ও ১৭ জুন শাহাবুদ্দিনের বটতলায় ট্রাক দুর্ঘটনা ঘটে। ২ জুন রহিমপুর বাজারে দোকানের মধ্যে ঢুকে যায় একটি ট্রাক।
১১ মে অমৃতপাড়া সিদ্দীক মেম্বারের বাড়ির সামনে মুখোমুখি সংঘর্ষে দুমড়ে মুচড়ে যায় আঙ্গুর ও পাথর ভর্তি দুইটি ট্রাক। এ ঘটনায় আহত হন ২ জন। ১৯ মে নাটোরের লালপুর উপজেলার দুড়দুড়িয়া ইউনিয়নের জামতলা গ্রামের জাহিদ হাসান শান্ত (২৭), তার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা জেসমিন খাতুন (২৩) ও তাদের একমাত্র সন্তান তুরাইফা (৫) বাবার মোটরসাইকেলে স্কুলে যাওয়ার সময় ঈশ্বরদী-বানেশ্বর আঞ্চলিক মহাসড়কের বানিয়াপাড়ায় ঢাকাগামী দ্রুত গতির সুপার সনি এক্সপ্রেস তাদের চাপা দেয়। এতে বাবা ও মেয়ে উভয়ের ডান পা হাটু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সঙ্গে থাকা অন্তঃসত্ত্বা মা জেসমিনের ডান হাত ভেঙে যায়। সন্ধ্যায় জাহিদ হাসান শান্ত মারা যান।
২১ এপ্রিল অমৃতপাড়া গ্রামে মুখোমুখি দুই ট্রাকের সংঘর্ষে আহত হন ২ জন। ১৮ এপ্রিল মাধবপুর সেন্টারের মোড়ে পাথর বোঝাই ট্রাক উলটে আহত হন ১ জন। ওই দিনই দক্ষিণ লালপুরে উল্টে যায় আরো একটি ট্রাক।
২৮ মার্চ বিকেলে ঈশ্বরদী-বানেশ্বর আঞ্চলিক মহাসড়কের উপজেলার ঈশ্বরদী ইউনিয়নের গৌরীপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে মোটরসাইকেলের সাথে প্রাইভেটকার মুখোমুখি সংঘর্ষে ঢাকার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) কর্মচারি মহিদুল ইসলাম (৩৫) মারা যান। এ ঘটনায় তার চাচাত ভাই মো. মতিউর রহমান সবুজ (৪৩) আহত হন।
২৭ মার্চ সকাল পৌনে ১০ টার দিকে ঈশ্বরদী-বনপাড়া সড়কের উপজেলার কদিমচিলান ইউনিয়নের গোধড়া গ্রামের জাহিদ অটো রাইস মিলের ২০০ গজ উত্তরে প্রাইভেটকারের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সাথে ধাক্কায় দুইজন নিহত ও দুইজন আহত হন। নিহত বগুড়া সদরের কইতলা (কৈপাড়া) এলাকার আবুল কশেম মন্ডলের ছেলে শাহরিয়ার হোসেন শাকিল (৩৫) ও তাঁর ২ বছরের শিশুকন্যা সুমাইরা আক্তার। গুরুতর আহত হন শাকিলের স্ত্রী আয়শা আক্তার রুনী (২৬) ও প্রাইভেটকার চালক।
৩ মার্চ রাত ৮টার দিকে উপজেলার ২নং ঈশ্বরদী ইউনিয়নের কাজীপাড়া গ্রামে মো. পিন্টুর ছেলে ৩ বছরের শিশু মুরসালিন বাবার চালিত ট্রলির নিচে চাপা পড়ে মারা যায়।
২০ ফেব্রুয়ারি গৌরীপুরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি বাড়ির আঙিনায় পড়ে যায় পাথর বোঝাই ট্রাক ও ১২ ফেব্রুয়ারি মুঞ্জিলপুকুর এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার নিচে চলে যায় একটি ট্রাক।
২১ জানুয়ারি উপজেলার কদিমচিলান ইউনিয়নের সেকচিলান নামক স্থানে মোটরসাইকেল ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে তিন যুবক উপজেলার ধলা হিন্দুপাড়া গ্রামের শিবেন মজুমদারের ছেলে শ্রাবণ মজুমদার (১৮), রতন সরকারের ছেলে স্বপন (১৯) এবং সিংড়া উপজেলার সোনাইডাঙ্গা গ্রামের বিষ্ণু সরকারের ছেলে বিধান সরকার (১৮) নিহত হন।
১৬ জানুয়ারি রহিমপুর বাজারের পাশে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তা থেকে নেমে যাই একটি ড্রাম ট্রাক।
১৩ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে চারঘাট-বাঘা মহাসড়কের মনিগ্রামের মীরগঞ্জ সাজির বটতলা নামক স্থানে ট্রাক ও মোটরসাইকেল মুখোমুখি সংঘর্ষে উপজেলার মোমিনপুর বাগনা গ্রামের বাবর আলীর ছেলে ফয়সাল হোসেন (১৫) ও মানিক হোসেনের ছেলে নাসির উদ্দিন (২০) মারা যান।
১১ জানুয়ারি সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে লালপুর-বনপাড়া সড়কের গোপালপুর স্বপ্নীল জেনারেল হাসপাতালের সামনে দ্রুতগামী অজ্ঞাত ট্রাক তাকে ধাক্কায় উপজেলার ঈশ্বরদী ইউনিয়নের গৌরীপুর গ্রামের গফুর মৃধার ছেলে সাবেক ইউপি সদস্য জহুরুল ইসলাম গোপ্পী (৫৫) নিহত হন।
৯ জানুয়ারি মাধবপুর মোড়ে উল্টে যায় একটি ট্রাক। ৫ জানুয়ারি উধনপাড়া গ্রামের ইছার উদ্দিনের বাড়ির আঙিনায় ঢুকে যায় একটি ড্রাম ট্রাক। ২ জানুয়ারি উধনপাড়া গ্রামে (পাইকপাড়া ব্রিজের পাশে) ড্রাম ট্রাক ও ইঞ্জিন চালিত ভুটভুটি গাড়ির সংঘর্ষে ২১ জন আহত হন।
উপজেলা ফায়ার স্টেশন কর্মকর্তা এ কে এম লতিফুল বারী জানান, গত ১০ দিনে এই সড়কটিতে উপজেলার সাহাবুদ্দিনের বটতলা, পাইকপাড়া ও উধনপাড়ায় ৩টি এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। যার মূল কারণ একটানা দীর্ঘক্ষণ ড্রাইভিং, অপর্যাপ্ত বিশ্রাম, অতিরিক্ত গতি ও তন্দ্রাভাব বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা হচ্ছে। তবে সৌভাগ্যক্রমে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ছিল বসতহীন ফাঁকা জায়গায়।
প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে স্থানীয়রা জানান, এখন থেকে পাঁচ বছর আগে উপজেলার ঈশ্বরদী-বানেশ্বর সড়ক এতটা প্রসারিত ছিল না। বাড়িগুলো রাস্তা থেকে ছিল অনেকটা দূরে। সম্প্রতি রাস্তাটি প্রসস্ত হয়ে দুই লেন আঞ্চলিক মহাসড়কে উন্নীত হয়েছে। দ্রুতগতি সম্পন্ন গাড়ির চাপ বেড়েছে। অনেক বাড়ি ও দোকানপাট এখন একেবারে রাস্তা ঘেঁষে আছে। এমন অবস্থায় অদক্ষ কিংবা দক্ষ কোন চালক যদি ঘুম ঘুম চোখে কোন বাড়িতে গাড়ি চালিয়ে দেন! কি হবে ভাবতেই গাঁ শিউরে উঠে! ইতিমধ্যে মূল সড়ক থেকে রাস্তার পাশে উল্টে পড়া স্বাভাবিক দুর্ঘটনা হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) নাটোর সার্কেলের ভারপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি.) মো. আলতাব হোসেন বলেন, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে বিষয়টি জেলা আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির (আরটিসি) সভায় উত্থাপন করা হবে। রাস্তা ঘেঁষে থাকা বাড়ি, দোকান ও স্থাপনাগুলোর বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণে সওজ এর সাথে যোগাযোগ করা হবে। বিপদজনক বাঁক ও দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও ব্যবস্থা গ্রহণ করে দুর্ঘটনা হ্রাসে কাজ করবেন।
নাটোর জেলা সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কামরুল হাসান সরকার বলেন, বিষয়টি জটিল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে করণীয় ঠিক করতে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে পদক্ষেপ নিবেন।
লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-তদন্ত) মো. মমিনুজ্জামান বলেন, উপজেলায় দুর্ঘটনা সমুহে সড়ক আইনে থানায় মামলা হয়েছে। এসব ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.