-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
বর্তমান বিশ্ব যখন একের পর এক যুদ্ধ, সংঘাত আর মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি, তখন একটি প্রশ্ন নতুন করে সামনে এসেছে তা হলো জাতিসংঘ আসলে কী করছে? এর কার্যকারিতা, নিরপেক্ষতা, কিংবা শক্তি আদৌ কতটা? ইরান ও গাজায় ইসরায়েলি ও মার্কিন আগ্রাসন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, সুদান কিংবা ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ, সবখানেই জাতিসংঘের ভূমিকা অনেকটা “বাবুরাম সাপুড়ে”র গল্পের মতো। যে সাপুড়ে সাপকে বশ মানানোর নাটক করে, কিন্তু বাস্তবে কিছুই করতে পারে না।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, শান্তি রক্ষার মহান ব্রত নিয়ে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় দেখা যাচ্ছে, এই সংস্থাটি যেন বড় শক্তিগুলোর ছায়ায় পরিচালিত এক নিস্ক্রিয় প্রহসনে পরিণত হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ব্যবস্থা এই ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ। মাত্র পাঁচটি দেশের হাতে এই বিশেষ ক্ষমতা থাকায়, কোনো একটি দেশ যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও জাতিসংঘ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে না। ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণহত্যা বা আগ্রাসনের ঘটনায় জাতিসংঘ শুধু বিবৃতি দেয়, নিন্দা জানায়, কিন্তু বাস্তব কোনো পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়।
গাজার বর্তমান পরিস্থিতিই এর বড় প্রমাণ। ইসরায়েলি হামলায় হাজার হাজার নারী-শিশু নিহত হওয়ার পরও জাতিসংঘের কোনো প্রস্তাব কার্যকরভাবে গৃহীত হয়নি। একেকটি প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার আগেই তা ভেটোর খাঁচায় আটকে যায়।ইরান ও ইউক্রেনেও মার্কিন ও রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একইরকম নিস্ক্রিয়তা দেখা গেছে। অন্যদিকে, আফ্রিকা কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছোট দেশগুলোর বিষয়ে জাতিসংঘ তুলনামূলকভাবে কড়া পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হলেও, বড় শক্তিগুলোর ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান রহস্যজনকভাবে নিরুত্তাপ।
এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক। কি দরকার এমন একটি সংস্থার, যেটি যুদ্ধ থামাতে পারে না, নিপীড়িতের পাশে দাঁড়াতে পারে না, বরং নিপীড়কদের ভাষ্যে মৃদু আপত্তি জানিয়েই দায়িত্ব সারতে চায়? জাতিসংঘ যেন কেবল চিঠি চালাচালি, বৈঠক আর বিবৃতির এক আন্তর্জাতিক কার্যালয়ে পরিণত হয়েছে।
বর্তমান বিশ্বে ক্রমাগত যুদ্ধ বন্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিচারিতা ও মাতব্বরী নিয়ে বৈশ্বিক ক্ষোভ ও ঘৃণার কথা সেদেশের শান্তিকামী মানুষ ও নেতারাও জানেন। কিন্তু তাতে কর্তৃপক্ষের কোন আক্ষেপ নেই। তাদের টার্গেট কিভাবে জাতীয় বাজেটে ঘাটতি মেটানো যায় জন্য মারণাস্ত্র বিক্রির তৎপরতা অব্যাহত রাখা।
বিশ্বে ক্রমাগত যুদ্ধ ও সংঘাতের পেছনে জাতিসংঘের ব্যর্থতার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী ভূমিকাও গভীরভাবে জড়িত। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজেকে মানবাধিকারের রক্ষক ও শান্তির দূত হিসেবে তুলে ধরলেও বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র বারবার তার স্বার্থের পক্ষে যুদ্ধকে উসকে দিয়েছে বা চোখ বন্ধ করে থেকেছে। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া কিংবা সিরিয়ার মতো দেশগুলোতে মার্কিন হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে, অথচ জাতিসংঘ সেই আগ্রাসন রুখতে ব্যর্থ হয়েছে মার্কিন ভেটোর ভয়ে। আর ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি বর্বরতায় যখন বিশ্ববিবেক থমকে দাঁড়ায়, তখন যুক্তরাষ্ট্র নির্লজ্জভাবে তা সমর্থন করে বা নীরব থেকে জাতিসংঘের অবস্থানকেও প্রভাবিত করে। এই দ্বিমুখী নীতির ফলে যুদ্ধ শুধু দীর্ঘস্থায়ী হয় না, বরং ন্যায়বিচার ও আন্তর্জাতিক সংহতির ধারণাকেই দুর্বল করে দেয়। মার্কিন এই মাতব্বরী বন্ধ না হলে জাতিসংঘের কোনো প্রচেষ্টাই সফল হবে না, বরং যুদ্ধ ও দখলদারিতেই বিশ্ব পিষ্ট হতে থাকবে।
জাতিসংঘের বাবুরাম সাপুড়ে ভূমিকার সাথে গাজায় ক্রমাগত যুদ্ধ বন্ধে আরব নেতাদের চরম উদাসীনতা ও দ্বিচারিতা নিয়ে মুসলিম বিশ্বের সবাই উদগ্রীব। কিন্তু ঘুমন্ত আরব নেতাদের তাতে কিছু যায় আসে না। তাদের কেউ কেউ যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে আল-আইয়ালা নামক চুলকোলা নর্তকী দিয়ে চুল দুলিয়ে অভিবাদন জানায়। এত বৈপরীত্যের মাঝে তারা ইসলামের সেবক থাকে কীভাবে?
আল-আইয়ালা নৃত্যে আমিরাতের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিফলন, তবে এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও প্রতিক্রিয়াও বিবেচনায় নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এই নৃত্য দেখিয়ে ইসলামকে হেয় করা হয়েছে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। কারণ, মুসলিম নারীদের পর পুরুষকে খোলা চুল প্রদর্শন করা হারাম- তবুও কেন ট্রাম্পের সৌজন্যে নাচা হলো? অনেকে বলেছেন, ওই নর্তকী নারীরা আদৌ মুসলিম ছিলেন কি না? তারপরেও প্রশ্ন আসে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ট্রাম্পের মতো অমুসলিম পুরুষের সামনে মুসলিম নারীরা কীভাবে চুল দুলিয়ে নাচলেন? এত মনগড়া পরিবর্তন মুসলিম বিশ্বকে আবারো হেয় করে তুলেছে।
গাজায় চলমান যুদ্ধ ও ইসরায়েলি আগ্রাসনের মুখে যখন হাজার হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনি নারী-শিশু প্রাণ হারাচ্ছে, তখন আরব বিশ্বের নেতারা যেন এক নিঃসংগ দর্শক, যারা কেবল বিবৃতি দিয়ে দায় এড়িয়ে চলেছেন। তাদের এই চরম উদাসীনতা ও দ্বিচারিতা একদিকে যেমন মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রশ্ন তোলে, অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। একদিকে তারা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেন, অথচ বাস্তবে অনেক আরব রাষ্ট্রই ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করছে। এই দ্বিচারিতার ফলে ফিলিস্তিন ইস্যু আন্তর্জাতিক মঞ্চে গুরুত্ব হারাচ্ছে, আর ইসরায়েল আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। গাজায় রক্ত ঝরলেও আরব নেতাদের চোখে তা শুধু এক প্রান্তিক সংকট—যা তাদের গদি বা স্বার্থে সরাসরি আঘাত হানে না বলেই তারা নীরব থাকে। জাতিসংঘের নিষ্ক্রিয়তার পাশাপাশি আরব বিশ্বের এই ভন্ডামিই ফিলিস্তিন সংকটকে দিন দিন আরও জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী করে তুলছে।
বিশ্বের শান্তিকামী জনমনে প্রম্ন হলো, এর সমাধান কি কিছুই নেই? যদি কোন সমাধান থাকে তাহলে সেটা হতে পারে? গাজায় চলমান যুদ্ধ ও ফিলিস্তিন সংকটের প্রকৃত সমাধান নির্ভর করে আন্তর্জাতিক সদিচ্ছা, ন্যায়বিচারভিত্তিক কূটনীতি, এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নেতৃত্বের আন্তরিক পদক্ষেপের ওপর। প্রথমত, জাতিসংঘকে নিরপেক্ষ ও কার্যকর সংস্থায় রূপান্তরের জন্য কাঠামোগত সংস্কার জরুরি, বিশেষ করে ভেটো ক্ষমতা ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে মানবাধিকার ও যুদ্ধবিরোধী প্রস্তাবগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আরব দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা তৈরি করতে হবে, যাতে তারা শুধুই কূটনৈতিক বিবৃতি না দিয়ে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করে যেমন অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি, কূটনৈতিক সম্পর্ক পর্যালোচনা, এবং আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলার উদ্যোগ নেওয়া। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে, যাতে বিশ্ব জনমত গঠন করে যুদ্ধবিরোধী চাপে পরিণত হয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ফিলিস্তিনিদের নিজেদের মধ্যেও রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলা প্রয়োজন, যাতে তারা একক ও শক্তিশালী কণ্ঠে নিজেদের অধিকারের দাবি তুলতে পারে। এ ছাড়া, আন্তর্জাতিক আদালত ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিশ্চিত করা হলে ইসরায়েলের মতো রাষ্ট্রগুলো আগ্রাসনের আগে দশবার ভাববে। বাস্তব ও টেকসই শান্তির জন্য প্রয়োজন ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা ও মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, তা না হলে গাজা, সিরিয়া, ইয়েমেন কোথাও এমন সংকট কখনোই শেষ হবে না, শুধু স্থান ও সময় বদলাবে।
আজকের বিশ্বে যখন একের পর এক যুদ্ধ ও সংঘাতে সাধারণ মানুষ বিপর্যস্ত, তখন জাতিসংঘের নীরবতা আর নিষ্ক্রিয়তা এক ভয়াবহ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। যে সংস্থার জন্মই হয়েছিল বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, সে সংস্থাই আজ শক্তিধর দেশের স্বার্থরক্ষায় বদ্ধপরিকর এক নিরুপায় দর্শকে পরিণত হয়েছে। ‘বাবুরাম সাপুড়ে’র মতো জাতিসংঘও যেন কেবল খেল দেখায়, বক্তৃতা দেয়, প্রস্তাব পাস করে, অথচ যুদ্ধ থামানোর মতো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয় না। এই নীরবতা শুধু বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি নয়, বরং জাতিসংঘের বিশ্বাসযোগ্যতা ও অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। এখন প্রয়োজন, জাতিসংঘকে নতুনভাবে পুনর্গঠন করে একে নিরপেক্ষ, কার্যকর ও মানবতার পক্ষে সোচ্চার করে তোলা, না হলে এই প্রতিষ্ঠান ইতিহাসে ব্যর্থতার প্রতীক হিসেবেই চিহ্নিত হবে।
এখন সময় এসেছে জাতিসংঘের কাঠামোগত সংস্কার নিয়ে নতুন করে ভাবার। ভেটো পদ্ধতির সংস্কার, ছোট দেশগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ এবং মানবাধিকার ইস্যুতে কার্যকর হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করা জরুরি। না হলে, জাতিসংঘ সত্যিই ‘বাবুরাম সাপুড়ে’ হয়েই থাকবে, যার বাজনায় সাপ নাচলেও সে নিজের খেলা দেখিয়ে দর্শকদের বিভোর রাখে।
বিশ্ববাসীকে আর এই প্রহসনের দর্শক না হয়ে, একটি কার্যকর ও নিরপেক্ষ জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জোরালো চাপ তৈরি করতে হবে, যাতে সত্যিকার অর্থে মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো সম্ভব হয়। যুদ্ধের বিপরীতে শান্তির যে আদর্শ জাতিসংঘ একসময় ধারণ করত, তা আজ পুনরুদ্ধার করাই সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]