-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে ধর্মের নামে যে রক্তপাত ও নিপীড়নের কাহিনি রচিত হয়েছে, কারবালা তার এক অনন্য প্রতীক। কারবালা শুধু এক প্রান্তরের নাম নয়, এটি হলো ন্যায় ও অন্যায়ের চ‚ড়ান্ত দ্বন্দ্বের ইতিহাস, যা আজও মুসলিম সমাজকে কাঁদায়, জাগায়, এবং আত্মজিজ্ঞাসায় বাধ্য করে। কিন্তু এই শোক ও ক্ষতই আবার ইসলামকে যুগে যুগে নতুন করে প্রাণ দেয়। তাই বলা হয়, ‘প্রতিটি কারবালার পর ইসলাম পুনুরুজ্জীবিত হয়’এই বিখ্যাত উক্তিটি ম‚লত ইমাম জাইনুল আবেদীন (রহঃ)-এর বলে প্রচলিত। তিনি ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর পুত্র এবং কারবালার ঘটনায় বেঁচে যাওয়া অন্যতম ব্যক্তি।
এই উক্তিটি বিভিন্ন দেশের ইসলামী চিন্তাবিদ বিভিন্ন ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন।পাকিস্তানের জাতীয় কবি এবং মুসলিম দুনিয়ার নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা কবি আল্লামা ইকবাল বলেন ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কে বাদ’ তিনি উর্দু ও ফারসি ভাষায় ইসলামী পুনর্জাগরণ, আত্মবোধ, এবং আত্মত্যাগ নিয়ে অসাধারণ সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। এছাড়া মাওলানা মোহাম্দদ আলী জওহারও এই উক্তি পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন।
এটি সরাসরি ডকুমেন্টেড না হলেও আল্লামা ইকবাল বা তাঁর ধারার চিন্তাবিদদের ভাবনার প্রতিফলন হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত ও উদ্ধৃত একটি লাইন। এর মাধ্যমে বোঝানো হয় প্রত্যেক যুগে, যখন ইসলাম অন্যায়ের মুখে পড়ে, তখন হোসাইনী চেতনা দিয়ে তা নতুন করে বেঁচে ওঠে। অতএব, এটি একটি আত্মিক ও বিপ্লবী উক্তি, যার উৎস ইতিহাস ও চেতনার সম্মিলনে গঠিত।
তবে সর্বপ্রথম ইমাম জাইনুল আবেদীন (রহঃ) এই উক্তি করেন। যার পুরো নাম ছিল আলি ইবনে হুসাইন, ছিলেন চতুর্থ শিয়া ইমাম এবং একাধারে সুন্নি ও শিয়া ঐতিহ্যে সম্মানিত একজন আধ্যাত্মিক ও নৈতিক পথপ্রদর্শক। তিনি কারবালার ঘটনার সময় শিশু বা কিশোর বয়সে ছিলেন এবং অসুস্থতার কারণে সক্রিয় যুদ্ধের অংশ হননি। ফলে প্রাণে বেঁচে যান এবং পরবর্তীতে বন্দি অবস্থায় কুফা ও দামেশকে নিয়ে যাওয়া হয়। এই উক্তিটি তিনি কারবালার পরে ইয়াজিদের দরবারে (দামেশকে) বন্দি অবস্থায় বা এরপর কোনো বক্তব্য বা শিক্ষাদানের সময় করেছিলেন বলে মনে করা হয়।
ইতিহাসবিদ ও ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, এই কথার প্রেক্ষাপট ছিল ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা এবং ন্যায়ের চেতনার পুনরুত্থান—যা কারবালার আত্মত্যাগের মাধ্যমে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। যেহেতু ইয়াজিদের শাসনব্যবস্থা ইসলামকে রাজতন্ত্র ও দমননীতির পথে চালিত করছিল, তাই হোসাইন (রাঃ)-এর শাহাদাত সেই বিকৃতিকে প্রতিহত করে এক নৈতিক ও চেতনার জাগরণ ঘটায়।
এমন সময়, যখন মানুষ ভাবছিল ইসলাম হয়তো ইয়াজিদের হাতে পরাজিত হয়েছে, তখনই ইমাম জাইনুল আবেদীন (রহঃ) দৃপ্ত কণ্ঠে বলেন, “إِنَّ لِكُلِّ كَرْبَلَاءَ بَعْدَهَا إِحْيَاءٌ لِلْإِسْلَامِ” অর্থ, ‘প্রতিটি কারবালার পর ইসলাম পুনরুজ্জীবিত হয়।’
এই উক্তি ইসলামের ইতিহাসে এক গভীর অন্তর্দৃষ্টি বহন করে। এর মাধ্যমে ইমাম জাইনুল আবেদীন বোঝাতে চেয়েছেন, কারবালার ট্র্যাজেডি কেবল শোক নয়, বরং ন্যায়ের শিক্ষা। শাহাদাতই হলো ইসলামের নৈতিক শক্তির পুনর্জাগরণের উৎস এবং প্রতিটি সময় যখন ইসলাম অবক্ষয়ের দিকে যায়, তখন নতুন কোনো ‘কারবালা’ আবার সেটিকে শুদ্ধ করে তোলে।
তাই, এটি শুধু একটি কথন নয়, বরং একটি দার্শনিক অবস্থান, যা ইমাম জাইনুল আবেদীন (রহঃ) এমন এক সময় ব্যক্ত করেছিলেন, যখন মুসলিম উম্মাহ নিপীড়নের মুখে হতাশ ছিল, এবং ইসলামকে আবার হৃদয়ে ধারণ করতে এই কথাটি চেতনার মশাল হয়ে উঠেছিল।
কারবালার প্রান্তরে ৬১ হিজরিতে যা ঘটেছিল, তা কেবল এক রাজনৈতিক সংকট ছিল না; বরং তা ছিল এক নৈতিক অবস্থানের লড়াই। একদিকে ছিল রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা জুলুমের প্রতীক ইয়াজিদের রাজতন্ত্র, অন্যদিকে ছিল মহানবী (স.)-এর প্রিয় নাতি ইমাম হোসাইন (র.)-এর নেতৃত্বে একটি ক্ষুদ্র কিন্তু ন্যায়ের পথে অবিচল কাফেলা। এই অসম যুদ্ধের পরিণতি ছিল ভয়াবহ; হোসাইন (র.) শহীদ হলেন, তাঁর পরিবার-পরিজন বন্দি হলেন। তবুও এই পরাজয়ই এক মহান বিজয়ের ভিত্তিপ্রস্তর হয়ে উঠল। কারবালা দেখিয়ে দিল, ইসলামকে কেবল বাহ্যিক জৌলুসে নয়, নৈতিক সাহসে ধারণ করতে হয়।
ইতিহাসে দেখা যায়, কারবালার মতো ট্র্যাজেডি মুসলিম সমাজে বারবার ফিরে এসেছে, আকারে, প্রেক্ষাপটে, চরিত্রে। কখনো তা হয়েছে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মাধ্যমে, কখনো সমাজের ভেতরের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে। প্রতিবারই নতুন কারবালা ঘটেছে, যেখানে ন্যায়ের কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছে অন্যায়। কিন্তু ঠিক সেখান থেকেই ইসলামের একটি নৈতিক জাগরণ শুরু হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামে মুসলিমদের যে আত্মত্যাগ আমরা দেখেছি, তা অনেকাংশেই কারবালার আত্মা ধারণ করেছিল। আলজেরিয়ার ফরাসি দমননীতি, ব্রিটিশ ভারতের মুসলিম জাগরণ, এমনকি ফিলিস্তিনে গাজার সন্তানদের নির্ভীক প্রতিরোধ, এসব সবই একেকটি আধুনিক ‘কারবালা’যেখানে সংখ্যায় কম, অস্ত্রে দুর্বল মানুষরা সত্য ও আত্মমর্যাদার পক্ষে দাঁড়িয়েছে।
এইসব কারবালাগুলো নিছক কাহিনি নয়; এগুলো হলো আত্ম-সমালোচনার দর্পণ। প্রতিবার যেকোনো বিপর্যয়ের পর মুসলিম সমাজকে মুখোমুখি হতে হয়েছে এক প্রশ্নের, আমরা কোথায় ভুল করলাম? কোথায় থেকে ন্যায়ের পথ থেকে সরে এসেছি? এই প্রশ্নই আবার নতুন করে কোরআনের দিকে ফিরে যেতে বাধ্য করেছে, নবীর জীবনকে নতুনভাবে বুঝতে উৎসাহ দিয়েছে, এবং ইসলামকে শুধুই আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং জীবনের নৈতিক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণের দিকে নিয়ে গেছে।
আজকের পৃথিবীতে যখন একদিকে ইসলামোফোবিয়া মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, অন্যদিকে মুসলিম সমাজের ভেতরেই দেখা দিচ্ছে নানা বিভাজন, ক্ষমতার লোভ, ধর্মের নামে জঙ্গিবাদ তখন কারবালা আবার নতুন অর্থে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। হোসাইন (র.) দেখিয়ে গেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা বাহ্যিক বিজয়ই শেষ কথা নয়; বরং চূড়ান্ত সত্য হলো নৈতিক অবস্থান ও আত্মত্যাগ। যিনি পরাজিত হয়েও জয়ী হয়েছেন ইতিহাসের আদালতে।
আধুনিক মুসলিম বিশ্বের সংকটগুলোও একেকটি কারবালা। যেখানে ধর্মের আড়ালে রাজনীতি, ক্ষমতার লোভ, মৌলবাদ ও দমননীতি একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে। কিন্তু ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয়, প্রতিটি নিপীড়নের পর ইসলামের একটি অন্তর্জাগরণ হয়। যেখানে মানুষ আবার ফিরে যায় মূল শিক্ষায় যা ইনসাফ, সহমর্মিতা, আত্মসংযম এবং সত্য খুঁজে পেতে চেষ্টা করে।।
কারবালার মূল পাঠ হলো, ইসলাম কোনো শাসকগোষ্ঠীর প্রজেক্ট নয়; এটি নিপীড়িতের স্বপ্ন, আত্মত্যাগীর আখ্যান এবং ন্যায়ের অন্তর্নিহিত ভাষা। হোসাইন (র.) তাঁর রক্ত দিয়ে যে বাতি জ্বালিয়েছেন, তা কখনো নেভে না। বরং প্রতিবারই কোনো অন্যায়ের অন্ধকারে তা যেন নতুন করে দীপ্তি ছড়ায়।
আর তাই, আজ যখন মুসলিম বিশ্বে নানা বিভ্রান্তি, আত্মবিস্মৃতি ও রাজনৈতিক ব্যবচ্ছেদ দেখা যায়, তখন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আমাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় নতুন প্রশ্ন: আমরা কি আবার একটি নতুন কারবালার পথে যাচ্ছি? কিংবা, আমরা কি ইমাম হোসাইনের আদর্শকে কেবল শোক আর মাতমে বন্দি করে রেখেছি, নাকি তা থেকে শিক্ষা নিচ্ছি?
এই আত্মজিজ্ঞাসাই ইসলামের পুনুরুজ্জীবনের প্রধান চাবিকাঠি। শোকের মধ্যে আত্মসমালোচনা, দুঃখের মধ্যে প্রত্যয়, এবং হোসাইনের পরাজয়ের মধ্যে বিজয়ের অনুপ্রেরণা খুঁজে পাওয়াই হলো প্রকৃত ‘কারবালার উত্তরস‚রি’ হওয়া।
কারবালার ইতিহাসকে যদি কেবল ধর্মীয় রীতি বা আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে দেখলে চলবে না। একে দেখা উচিত নৈতিক বিপ্লবের অনুকরণীয় মডেল হিসেবে। হোসাইনের আত্মত্যাগ আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে জীবন দিয়ে হলেও সত্যকে আঁকড়ে ধরা যায়। তাঁর মৃত্যু আমাদের শিখিয়েছে যে, একজন মানুষ যদি নিজের অস্তিত্বকে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে উৎসর্গ করেন, তাহলে তিনি ইতিহাসের সবচেয়ে জীবিত চরিত্র হয়ে উঠতে পারেন।
তাই আজকের কারবালারমতো ঘটনাগুলোর মধ্যেও আমাদের খুঁজতে হবে পুনুরুজ্জীবনের বীজ। তেহরান, গাজা, কাশ্মীর, রোহিঙ্গা, আফগানিস্তান, অথবা আমাদের নিজস্ব সমাজে শিক্ষার অবক্ষয়, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা, সবই একেকটি যুদ্ধক্ষেত্র। এসবেই খুঁজে নিতে হবে আমাদের যুগের হোসাইনদের, যারা সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে প্রস্তুত।
শেষ কথায় বলা যায়, ইসলাম কেবল একটি অতীত-নির্ভর ধর্ম নয়; এটি একটি চিরচলমান চেতনার নাম, যা প্রতিবার কারবালার মতো ঘটনার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ হয়, পুনরুজ্জীবিত হয়, এবং নতুন প্রজন্মকে জাগিয়ে তোলে। কারবালা সেই চিরন্তন আলোকবর্তিকা, যা শুধুমাত্র শোক নয়, বরং সাহস, ন্যায়বোধ এবং চেতনার পথপ্রদর্শক।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]