শুক্রবার | ১১ জুলাই, ২০২৫ | ২৭ আষাঢ়, ১৪৩২

সামাজিক ব্যবসা ভাবনার বীজ বপণকারী ড. ইউনূস

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
একসময় ড. মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনায় যুক্ত ছিলেন। যেখানে তিনি কেবল পাঠ্যসূচির গন্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে চিন্তার স্বাধীনতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও মানবিক অর্থনীতির বোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করতেন। পরবর্তীতে যেসব ধারণা থেকে গ্রামীণ ব্যাংক ও সামাজিক ব্যবসার মতো বিপ্লবী ধারণার জন্ম হয়, তার বীজগুলো এই শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই গড়ে ওঠে। অর্থাৎ, ইউনূস কেবল একজন শিক্ষকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সামাজিক ব্যবসা ভাবনার বীজ বপনকারী।
তিনি সামাজিক ব্যবসাকে এমন এক ধারায় রূপান্তর করেছেন যেখানে ব্যবসার লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের সমস্যা সমাধান, মুনাফা নয়। যা উল্লেখযোগ্যভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে। সামাজিক ব্যবসা আয় বৈষম্য রোধ করে সামাজিক প্রভাব তৈরি করতে পারে, সামজিক ভাঙ্গন রোধ করে এভাবে মানবিক অর্থনীতির বিকল্প মডেল হিসেবে বেকারত্বের দুষ্টবিকাশ চক্র একদিন ভেঙ্গে দিতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টা হবার আগে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের আগের দিনগুলোতে আদালতে হাজিরা দিতে যাওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছিলেন একরকম নীরব, দৃঢ় কিন্তু অবদমিত প্রতীক। তিনি মাথা নত না করে নিয়মতান্ত্রিক পথে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন, যদিও চোখেমুখে ক্লান্তি ও অবিচারের ভার স্পষ্ট ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলো অনেকের কাছে ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, এবং ইউনূস যেন সেই নীরব প্রতিরোধের ভাষ্য হয়ে উঠেছিলেন। বিপ্লবের পর তাঁর সেই একই আদালতযাত্রা যেন পেল নতুন ব্যাখ্যা। এখন তিনি কেবল একজন সরল ব্যক্তি নন, বরং এক প্রজন্মের অনুপ্রেরণা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিকী প্রতিবাদ।
জুলাই ২০২৪ এর ছাত্রবিক্ষোভের পর অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তিনি ১১টি পুনর্গঠন কমিশন গঠন করেন যা সাংবিধানিক, নির্বাচন, পুলিশ, বিচার ও দুর্নীতি দমন সংক্রান্ত সংস্কার নিয়ে কাজ করছে। পাশাপাশি গ্রামীণ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও ডিজিটাল সেবার অনুমোদন এসব উদ্যোগগুলো তাঁর সরকারের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ। ২০২৫ সালে তিনি টাইম ম্যাগাজিনের বিশ্বের ‘হানড্রেড মোস্ট ইনফ্লুয়েনশিয়াল পিপল’তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন, যেখানে হিলারি ক্লিনটন তাঁকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সময়ের নেতৃত্ব হিসাবে উল্লেখ করেন ।
একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং জলবায়ু বিপর্যয় একইসঙ্গে বৈশ্বিক উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব সমস্যা যেন তৃতীয় বিশ্বের নিয়তি হয়ে উঠেছে, আর উন্নত বিশ্বের নীতিনির্ধারকদের কাছে কেবল সংখ্যাতাত্ত্বিক ‘ডেটা পয়েন্ট’। এই বাস্তবতায় তাঁর ‘থ্রি জিরো’স থিউরি’যার তিনটি স্তম্ভ হলো জিরো পোভার্টি, জিরো আনএমপ্লয়মেন্ট এবং জিরো নেট কার্বন এমিশন (পরিবেশ দূষণের শূন্যতা)। এই তত্ত্ব আজ শুধুমাত্র বাংলাদেশের নয়, বরং গোটা বিশ্বের জন্য এক সাহসী রূপরেখা। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশ এখন উন্নয়ন ও মানবাধিকার, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সামাজিক ন্যায়বিচার, এই দ্বৈত দ্বন্দ্বে পড়ে পথ হারাচ্ছে। ড. ইউনূসের তত্ত্ব সেই বিভ্রান্তির কুয়াশা কাটানোর আলোকবর্তিকা হতে পারে। এটি একাধারে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত উন্নয়নের সমন্বিত ছক।
ড. ইউনূস বিশ্বাস করেন, দারিদ্র্য কোনো প্রাকৃতিক অবস্থা নয়, এটি সমাজসৃষ্ট এবং তাই এটি সমাজ থেকেই দূর করা সম্ভব। তাঁর ক্ষুদ্রঋণভিত্তিক ‘গ্রামীণ ব্যাংক’মডেল ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য নিরসনের এক কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে স্বীকৃত। তিনি যেমন বলেন, ‘একদিন দারিদ্র্যকে জাদুঘরে স্থানান্তর করা হবে’। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির মাধ্যমে একটি বাস্তব লক্ষ্যে রূপান্তর সম্ভব।
বাংলাদেশের মতো দেশ, যেখানে এখনও লক্ষ লক্ষ মানুষ খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত, সেখানে ‘জিরো পভার্টি’ধারণাটি কল্পনার মতো শোনালেও, এটি কৌশলগতভাবে অর্জনযোগ্য। রাষ্ট্রীয়ভাবে যদি সামাজিক ব্যবসাকে উৎসাহ দেওয়া হয়, যদি দরিদ্র মানুষের মাঝে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়, তাহলে আত্মনির্ভরশীলতা বাড়বে এবং দারিদ্র্য হ্রাস পাবে।
ড. ইউনূস বিশ্বাস করেন, বেকারত্বের শূন্যতা তরুণদের হাতেই উত্তরণ। বিশ্বের প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশও এক ‘তরুণ নির্ভর দেশ’। ৩৫ বছরের নিচে জনগোষ্ঠীর অনুপাত ৬০ শতাংশের বেশি। কিন্তু এই বিপুল তরুণ জনশক্তির একটি বড় অংশ বেকার বা কর্মসংস্থানহীন। তিনি এই সমস্যার সমাধান খুঁজেছেন চাকরির পেছনে ছুটে বেড়ানোর বদলে নিজে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণায়। তাঁর ভাষায়, আমরা জন্মাইনি কারও চাকরি করার জন্য; বরং আমরা জন্মেছি উদ্যোক্তা হবার জন্য।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশে যেখানে শিক্ষিত তরুণরা চাকরির অভাবে হতাশ, সেখানে সামাজিক ব্যবসা ও স্টার্টআপ সংস্কৃতির বিকাশ এই চক্র ভাঙতে পারে। অনেকে বলছেন, প্রধান উপদেষ্টা হবার পর তাঁর সময়ে আঞ্চলিকতার প্রভাবে শুধু চট্টগ্রামের মানুষকে উচ্চপদগুলোতে বেশী সুবিধা পেতে দেখা যাচ্ছে। তার কারণ, সেখানকার মানুষ তাবে বেশী ইর্ষা করে আবার তাঁর কাছে সুবিধে নেবার জন্য বেশী ভীড় করছে বলে এমনটি মনে হচ্ছে।তবে গোট দেশের মানুষের সাম্যের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে এই সমস্যা থাকবে না।
এ ছাড়া থ্রি জিরো তত্ত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ‘জিরো নেট কার্বন এমিশন’। এটি কেবল প্রযুক্তির মাধ্যমে নয়, বরং চিন্তা ও জীবনযাত্রার সংস্কারে সম্ভব। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সবুজ কৃষি, প্লাস্টিক বর্জন, গ্রীন টেকনোলজি এসবই হতে পারে এই তত্ত্বের বাস্তব রূপ। বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন বৈষম্য, অস্থিরতা ও একরৈখিক ‘ট্রিকল-ডাউন’উন্নয়নের ফাঁদে আটকে গেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো তথাকথিত উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণনির্ভরতা থেকে বেরোতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে ‘থ্রি জিরো’স থিউরি’হচ্ছে এক বিকল্প উন্নয়ন দর্শন, যা নিচ থেকে উপরে পরিবর্তন আনে, যা রাষ্ট্র নয় বরং সাধারণ মানুষকে ক্ষমতায়িত করে। এজন্য গতানুগতিক উন্নয়নের সংজ্ঞা পাল্টানো হোক।
আগামী দিনে বাংলাদেশ সরকার, উন্নয়নকর্মী, উদ্যোক্তা, শিক্ষাবিদ এবং তরুণ সমাজ, সবাই মিলে যদি এই দর্শনকে আত্মস্থ করে, তাহলে ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসা আমাদের দেশের বেকারত্বের দুষ্টবিকাশ চক্র একদিন ভেঙ্গে দিতে পারে। এজন্য আমাদের তরুণরা নিজেদের ছক নিজে তৈরি করুক এবং ড. ইউনূসের দর্শন সেই ছকের কেন্দ্রে থাকুক।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.