-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
পীরগঞ্জের বাবনপুর গ্রাম। যে জায়গাটিকে হয়তো অনেকেই চেনেন না, সেটি এখন হয়ে উঠেছে দ্রোহের প্রতীক। তৎকালীণ শাসক দলের আস্কারায় রং ট্রিগারে আঙুল চালানো গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মৃত্যু কেবল একটি প্রাণহানির ঘটনা নয়, বরং তা ছিল রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের নগ্ন প্রকাশ এবং ছাত্ররাজনীতির নতুন পর্বের স‚চনাবিন্দু। তাই জুলাই বিপ্লব নামটি এখন সবার মুখে মুখে ফিরে আসছে বার বার।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি বরাবরই এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের মেরুণ প্রাসাদ। আর ২০২৪ সালের সেই উত্তাল জুলাইয়ের স‚চনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামক এক শিক্ষার্থীর রক্তে। আর নিহত হবার এক বছর পরেও সেখানকার পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নি:শব্দে। তিনিই জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ।
রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ-বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবম‚ল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে। যখন সারাদেশে শিক্ষার্থীরা চাকুরীতে কোটা সংস্কার ও নিজেদের ভবিষ্যত সুরক্ষার দাবিতে শান্তিপ‚র্ণ আন্দোলন শুরু করে তখন এখানেও জুলাই ২০২৪-এর বিস্ফোরণ ঘটে যায় । কিন্তু শান্তিপূর্ণ সেই কর্মস‚চির জবাব এসেছিলি উগ্র পুলিশের রাইফেলের নির্মম গুলিতে।
এই শহীদ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পরে সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিদ্রোহের জোয়ার উঠেছিল, তা কেবল চাকুরীতে কোটা সংস্কার, উপাচার্য নিয়োগ বা বেরোবি সংশ্লিষ্ট কোনো সংকট নয়, বরং বৃহৎ অর্থে শিক্ষাব্যবস্থার সংকট, অভিভাবকহীন রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দেউলিয়াপনাকে নগ্ন করে তুলেছিল। যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নির্বাচন রাজনৈতিক লয়ালটি, নিয়োগে দুর্নীতি, এবং ক্ষমতাসীন দলের ছায়াতলে বন্দী হয়ে পড়ে, তখন তার পরিণতি যে এমনই হবে, তা কি কারো অজানা ছিল?
জুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়। এটি এখন সার্বজনীন এক ছাত্র-আন্দোলনের রূপরেখা। শাহবাগ থেকে রাজশাহী, চট্টগ্রাম থেকে খুলনা, প্রতিটি প্রাঙ্গণে যে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছিল, তার কেন্দ্রে রয়েছে বাবনপুরে শহীদ হওয়া সেই অজানা নামটি, যে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জাগিয়ে তুলেছে একটি জাতিকে।
এই শহীদ যেন আরেক বার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের স‚চনা করে। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম, কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আজও তাই, তারা নিরুত্তাপ নয়। রাষ্ট্র যদি এই বিক্ষোভের ভাষা না বোঝে, তবে ইতিহাস তাকে ক্ষমা করবে না।
আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক। আমরা চাই, বাবনপুর হোক সতর্কবার্তা, রাষ্ট্র যেন আর কখনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গুলির ট্রিগারে আঙুল না তোলে।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে? নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীল নকশা? যদি তাই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে। আর তার স‚চনা যে অনেক আগেই বাবনপুরের মাটিতে সমাহিত হয়েও ভবিষ্যতের দিশারী হিসেবে ইতিহাসে লেখা হয়ে গেছে!
‘যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’এই চেতনা দেরীতে এলো কেন? জুলাই যেন আমাদের জাতীয় জীবনে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও পুনর্জাগরণের এক প্রতীক হয়ে ওঠেছে এক বছর আগে থেকে। সেটা হয়েছে সরাসরি রক্তের বিনিময়ে, আর বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। আর ২০২৫ সালের এই জুলাই আমাদের উপহার দিয়েছে নতুন এক প্রথম শহীদ, যিনি শুধু একটি গুলিতে লুটিয়ে পড়েননি, বরং পুরো রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। তাই এখন প্রশ্ন যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে ।
কারণ এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিনদিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাশ করার পর চাকুরীর জন্য ঘুরে বেড়ায়, তাদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে।এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মতপ্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।
বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়। বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহ‚র্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।
এখন, বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয় তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণ নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।
তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে যখন অন্যায় সামনে দাঁড়াবে, তখনই জুলাইকে সামনে আনতে হবে। রাষ্ট্র যদি কখনও ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো এক একটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।
এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্ঠি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।
বাংলাদেশে এখনও কেন যেখানে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো মানে রাষ্ট্রের রোষানলে পড়া, সেখানে প্রতিবাদ করা মানে যেন আত্মহননের ঝুঁকি নেওয়া? এক সময়ের সাহসী ছাত্র-আন্দোলনের দেশ এখন ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে নিঃশব্দতা আর নিষ্ক্রিয়তার তটরেখা। যা কখনও কাম্য হতে পারে না।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদ‚রে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহিতা মনে করা হয়েছিল।
সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যখন চাকুরীর কোটা ও শিক্ষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে শান্তিপ‚র্ণভাবে দাঁড়িয়েছিল, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে কেন প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের নিকট তার উত্তর অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন; সবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠরোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? অথবা নিদারুণ কোন ভয় কি নয়? আগামীতে আমরা এই ধরণের আর কোন রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরও অনেক শহীদ আসতে পারে, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কি করতাম আমরা তা কি কেউ ভেবেছিলেন? জুলাই ০১ ২০২৫ তারিখে নিকটাত্মীয়দেরকে সাথে নিয়ে কেউ তার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে চোখের পানিতে বুক ভাসাচ্ছেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, নিহত হবার এক বছর পর বাবনপুরের বাঁশের বেড়া দেয়া মাটির নিচের ঘরে তিনি কেমন আছেন?
জনম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যে কোন প্রয়োজনে যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক হয়ে থাকার সময় শেষ নয় বরং সেটা সবসময়।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]