বুধবার | ২৩ জুলাই, ২০২৫ | ৮ শ্রাবণ, ১৪৩২

জনতা ব্যাংকের প্রমোশন নীতিমালা নিয়ে ক্ষোভ

প্রাপ্তি প্রসঙ্গ ডেস্ক :
রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের নতুন পদোন্নতি নীতিমালা সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেওয়ায় হাজার হাজার যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তার মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
তারা বলছেন, এটি একটি বৈষম্যমূলক নীতিমালা। এতে যোগ্যতার পরিবর্তে জ্যেষ্ঠতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ যেখানে সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের জন্য সমন্বিত পদোন্নতি নীতিমালা করছে, সেখানে জনতা ব্যাংক তড়িঘড়ি করে আলাদাভাবে এই নীতিমালা তৈরি করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে একটি বিশেষ গোষ্ঠী পদোন্নতি পেলেও অধিকাংশ সৎ ও মেধাবী কর্মকর্তা-কর্মচারী বঞ্চিত হবেন।
নতুন এই নীতিমালায় এমন কিছু মূল্যায়ন সূচক অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা দেশের ব্যাংকিং খাতে এর আগে কখনোই অনুসরণ করা হয়নি। পুরোনো প্রমোশন নীতিমালার গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানদণ্ড যেমন- ম্যানেজারি অভিজ্ঞতা, দুর্গম এলাকায় কাজের অভিজ্ঞতা, নিজ নিজ পদে চাকরিকাল- এসব বাদ দিয়ে শুধু যোগদানের তারিখ থেকে মোট চাকরিকালকে মূল্যায়নের ভিত্তি হিসেবে রাখা হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকটির বিভিন্ন সময়ে সরাসরি নবম গ্রেডে নিয়োগপ্রাপ্ত ‘সিনিয়র অফিসার’ ব্যাচের চেয়ে দশম গ্রেডে ‘অফিসার’ পদে যোগদান করা কেউ পরে প্রমোশন পেয়েও কয়েক নম্বরে এগিয়ে থাকছেন। বাস্তবে যা একটি গ্রেডের গড় মান ও মূল্যায়ন কাঠামোকে অস্বীকার করে।
নীতিমালা অনুযায়ী, ‘অফিসার’ (দশম গ্রেড) এবং ‘সিনিয়র অফিসার’ (নবম গ্রেড) আলাদা পদ, যেখানে একটি নির্দিষ্ট প্রমোশন না হওয়া পর্যন্ত একে অপরের সমমান হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এখন এমনভাবে নম্বর বরাদ্দ করা হচ্ছে যে, আগে নিয়োগ পাওয়ায় দশম গ্রেডের একজন অফিসার, সিনিয়র অফিসারের চেয়েও সহজে প্রমোশন পেতে যাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এমন সিদ্ধান্ত ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কাঠামোয় অসন্তোষ সৃষ্টি করবে এবং দীর্ঘমেয়াদে জনতা ব্যাংকের দক্ষতা, নৈতিকতা ও স্থিতিশীলতা ক্ষুন্ন করবে। তাদের মতে, অতীতে জনতা ব্যাংকের বিভিন্ন অনিয়ম ও পক্ষপাতদুষ্ট নিয়োগই ছিল এর অবনতির মূল কারণ। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে মেধাভিত্তিক নিয়োগ চালু হলে ব্যাংকটির ভাবমূর্তি ও কর্মপরিবেশে উন্নতির ইঙ্গিত দেখা দেয়। কিন্তু এখন আবার সেই পুরোনো, বিতর্কিতভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সুবিধা দিতে গিয়ে প্রমোশন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলে এর প্রভাব ব্যাংকের সামগ্রিক পরিবেশ ও কর্মীদের মনোবলে মারাত্মকভাবে প্রতিফলিত হতে পারে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল আবুল বারকাতকে। তার সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত অফিসার (দশম গ্রেড) ব্যাচসহ বিভিন্ন সময়ে ওই গ্রেডে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সুবিধা দিতে বর্তমানে ব্যাংকটির ম্যানেজমেন্ট ও পরিচালনা পর্ষদ এ নীতিগত পরিবর্তন করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, আবুল বারকাতের হাত ধরে জনতা ব্যাংকে অনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে যারা বিধিবহির্ভূতভাবে প্রমোশন পেয়েছেন, এই নীতিমালা কার্যকর হলে তারা পুনরায় সুবিধা পাবেন। এর ফলে বর্তমানে নবম গ্রেডে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রায় ৫,০০০ কর্মকর্তা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। একদিকে শ্রেণিকৃত ঋণ ও মূলধন ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে যখন নতুন কর্মকর্তারা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন এমন একটি অনৈতিক ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রমোশন নীতিমালা ব্যাংকের এই অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এই বিষয়ে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মজিবুর রহমান বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে একটি খসড়া নীতিমালা করা হয়েছে। এটা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। আমরা সব দিক বিবেচনায় নিয়েই নীতিমালাটি চূড়ান্ত করব। সরকার যেভাবে সমন্বিত নীতিমালা করছে, সেখানে জনতা ব্যাংক কেন আলাদাভাবে এই নীতিমালা করার বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার যে নীতিমালা করছে সেটি ২০২৫ সাল থেকে বাস্তবায়ন হবে। আর আমরা ২০২৪ সালের পদোন্নতির জন্য আলাদা নীতিমালা করছি। পর্ষদও এই পদোন্নতির বিষয়ে একমত।
এদিকে গত ১৫ জুলাই ২০২৫ বিষয়টির সমাধানে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বরাবর চিঠি দিয়েছেন। ২০১৯ সাল ও পরবর্তী সময়ে সিনিয়র অফিসার পদে যোগ দেওয়া কর্মকর্তাদের পক্ষে দেওয়া ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ফ্যাসিবাদ ও বৈষম্যমুক্ত নতুন বাংলাদেশে জনতা ব্যাংকের গৌরব ফিরিয়ে আনতে আমরা উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি, সদ্য প্রস্তাবিত পদোন্নতি নীতিমালা পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে সিনিয়র অফিসার পদের প্রত্যেক কর্মকর্তা বৈষম্যের শিকার হবেন এবং কর্মস্পৃহা হারাবেন। প্রস্তাবিত নীতিমালায় সমগ্র চাকরির দৈর্ঘ্যতে ৭ নম্বরের বিভাজন হিসেবে অফিসার বা সিনিয়র অফিসার পদে যোগদানের সময় থেকে প্রতিবছর ০ দশমিক ২৮ করে ২৫ বছরে মোট ৭ নম্বর প্রাপ্ত হবে বলে উল্লেখ আছে। এ ক্ষেত্রে একজন অফিসার গ্রেডে যোগদানকারী কর্মকর্তা তার অফিসার গ্রেডের কর্মকাল এর নম্বর দিয়ে সিনিয়র অফিসার গ্রেডে যোগদানকারী কর্মকর্তার নম্বরকে পেছনে ফেলে দিতে পারবে। অর্থাৎ সিনিয়র অফিসার পদে যোগ দেওয়া একজন কর্মকর্তার সিনিয়রিটি অনুযায়ী প্রাপ্ত নম্বর হবে ১.৪০ এবং অফিসার হতে সিনিয়র অফিসার গ্রেডে সুপারনিউমারারি প্রমোশন প্রাপ্ত কর্মকর্তার প্রাপ্ত নম্বর হবে ৩.৬৪। এ ক্ষেত্রে তিনি তার ওপরের প্রায় ৩০০০ জনকে টপকে পদোন্নতি পেয়ে যাবেন। যা সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেন, একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতেই জনতা ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রমোশন নীতিমালায় এক ধরনের পরিকল্পিত বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে। যার সঙ্গে অন্য কোনো ব্যাংকের নীতিমালার মিল নেই। এতে হাজার হাজার সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা বঞ্চিত হবেন।

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.