-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
আমাদের রাজনীতিতে এবং জনজীবনে এক ভয়ানক প্রবণতা ক্রমেই স্বাভাবিক হয়ে উঠছে।একে নির্দ্বিধায় বলা চলে মবক্রেসি। অর্থাৎ জনতার আবেগকে উস্কে দিয়ে আইন-নৈতিকতা-মনুষ্যত্বকে উপেক্ষা করে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির মোড়কে চালানো এক অসভ্য ক্ষমতা দেখানোর প্রবণতা হচ্ছে মবক্রেসি।বিগত দশ বছরে মব ভায়োলেন্সের শিকার হয়ে ৭৯২ জন প্রাণ হারালেও চলতি বছরের প্রথম দুইমাসেই ১১৯ জন নিহত হয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে এখন একটি ছায়াময় ও প্যারালাল রাজনীতি চলছে।একদিকে সরকারী রাজনীতি, অন্যদিকে রাজপথ ও সামাজিক মাধ্যমে পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ। এই দ্বৈত প্রবাহে মব ভায়োলেন্সের প্রবণতা বেড়েছে এবং পেছনের উসকানিদাতারা আড়ালে থেকে যাচ্ছে। ফলে জনতাকে সামনে রেখে লাশের রাজনীতি হচ্ছে, মব কর্তৃক অনৈতিক চাপ এবং সরকার বিরোধীতা ও রাজনীতি একাকার হয়ে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ঘটে যাওয়া এক বিভৎস ঘটনা আমাদের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ এই ঘটনা বড় দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সমাজের অবনত বিবেক, রূঢ় গণসচেতনতা এবং ভেঙে পড়া নৈতিক কাঠামোর নির্মম প্রতিফলন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন নিহত ব্যক্তির নিথর দেহ যখন হাসপাতালের সামনের রাস্তায় পড়ে থাকে, মব যখন উদ্দেশ্যমূলকভাবে সেই লাশের উপর বড় পাথর নিক্ষেপ করে থেতলিয়ে দেয় এবং জুতো পায়ে কোন পাষাণ তার উপর বার বার লাফিয়ে নৃত্য করে তখন আমাদের অসভ্যতা প্রদর্শণের ষোলকলা পূর্ণ হয়ে যায়নি? ঘটনার কাছেই বা আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা জনতা, পথচারী কিংবা সংশ্লিষ্ট কেউ যখন অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় বা অনেক ক্ষেত্রে উদাসীন থাকে তখন প্রশ্ন উঠে আসে আমরা কি মানুষ রয়েছি, না পশুত্বে পর্যবসিত হয়ে গেছি?
ঘটনাটি ছিল বেদনাদায়ক এবং লজ্জাজনক। টেনে-হিঁচড়ে, অমানবিকভাবে ফেলে রেখে রাস্তায় শো ডাউন করে মৃত্যু নিশ্চিত করতে লাখি মেরে নিষ্পেষণ করার দৃশ্য কার সহ্য হয়েছে? মিটফোর্ড হাসপাতালের মতো একটি চিকিৎসাকেন্দ্রের প্রবেশপথের সামনেই যদি এভাবে একজন আহত বা মৃত মানুষ অবহেলিত হন, তাহলে দেশের অন্য প্রান্তের চিত্র কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
শুধু রাজনীতি নয়, মিডিয়ার ভূমিকাও এখানে প্রশ্নবিদ্ধ। কোনো ব্যক্তি মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুত ভিডিও, ছবি ছড়িয়ে পড়ছে। পরিবার জানার আগেই পুরো দেশ ‘দেখে’ ফেলছে লাশটি। একটি রাষ্ট্রে, একটি সমাজে বা একটি সামজিক অথবা ধর্মীয় ম‚ল্যবোধভিত্তিক সভ্যতায় লাশের প্রতি সম্মান থাকা উচিত একেবারে মৌলিক স্তরে। ইসলাম বলুক, হিন্দু ধর্ম বলুক, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান ধর্ম, সবখানেই মৃতদেহকে পবিত্র ও শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাহলে মিটফোর্ডের মতো এক ব্যস্ত এলাকায় যদি কেউ একজন মরে পড়ে থাকে, আর একজন লাশের বুকে লাথি দেয়, অন্যরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছবিতোলে তাহলে আমাদের আর কী বলার থাকে?
গণতন্ত্র মানে জনতার শাসন, কিন্তু তা যেন জনতার হাতে পাথর তুলে দেওয়ার শাসন না হয়। জনতার অধিকার আছে প্রতিবাদের, কিন্তু সেই প্রতিবাদ যদি অন্যের মৃত্যু বা দুঃখকে ব্যবহার করে, তাহলে সেটা আর প্রতিবাদ নয়, তা হয়ে দাঁড়ায় নিষ্ঠুর উল্লাস।
মানবিক রাষ্ট্র গড়তে হলে মৃত্যু এবং শোকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। মনে রাখতে হবে লাশ কখনো দলীয় নয়, সে কারো বাবা-মা, ভাই-বোন, সন্তান। মৃতের প্রতি ন্য‚নতম সম্মান দেখানোও যদি আমরা না শিখি, তাহলে আমরা কীভাবে একটি সভ্য, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার দাবি করতে পারি?
যখন বাংলাদেশে শান্তি ফেরার কথা তখন মবক্রেসি কেন চলমান হচ্ছে? বাংলাদেশ এখন একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সদ্যসমাপ্ত নির্বাচন, রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ও বর্জনের নাটক, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আনার তাগিদ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রত্যাশা। সব মিলিয়ে দেশটিকে এখন হওয়া উচিত ছিল সংলাপ, সহনশীলতা ও স্থিতিশীলতার পথে অগ্রসর। কিন্তু বাস্তবচিত্র ভিন্ন। হঠাৎ হঠাৎ জনতা উত্তাল হচ্ছে, রাস্তায় নামছে, বিভিন্ন দাবিকে কেন্দ্র করে সহিংসতা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদে অগ্নিসংযোগ হচ্ছে, আর সামাজিক মাধ্যমে চলছে গণউৎসাহে লাশের লাফ। এই যে ‘জনতার শাসন’ নামে ‘মবক্রেসি’র আগ্রাসন, তা কাদের উপকারে আসছে?
আমরা জানি মবক্রেসি মানে জনতার শাসন নয়, বরং জনতার অন্ধ-উগ্র আবেগের আধিপত্য। এটি কোনো গণতান্ত্রিক চর্চা নয়, বরং গণতন্ত্রকে ফাঁদে ফেলার একটি বিপজ্জনক প্রবণতা। প্রশ্ন হচ্ছে,যখন রাজপথে সহিংসতার চেয়ে সংলাপ, সুশাসন ও শান্তির প্রয়োজন, তখন জনতাকে উত্তেজিত করে তোলার এই প্রবণতা কে বা কারা চালাচ্ছে? আর জনতাই বা এত সহজে উস্কে উঠছে কেন?
এর কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয় সামনে আনা যায়। প্রথমত, সুশাসনের দুর্বলতা হেতু যখন দেশের রাজনৈতিক দলগুলো প্রাতিষ্ঠানিক ও গণতান্ত্রিক পথে নিজেদের বিরোধ মেটাতে ব্যর্থ হয়, তখন জনতা হয়ে পড়ে বিভ্রান্ত ও অসহায়। এর সুযোগে কিছু উগ্র গোষ্ঠী জনতাকে রাস্তায় নামিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির খেলায় মেতে ওঠে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, ডিজিটাল উস্কানি। আজকের যুগে একটি মিথ্যা বা আংশিক সত্য ভাইরাল হতে সময় লাগে না। কোনো ঘটনার ভিডিও ক্লিপ, কাটা-কাটা বক্তব্য বা ছবি নিয়ে তৈরি হয় উত্তেজনার বুদবুদ। ফেসবুক, টিকটক-ইউটিউবের গেটকিপার বিহীন অ্যালগরিদম সেই বুদবুদকে রীতিমতো বিস্ফোরণ বানিয়ে দেয়।
তৃতীয়ত, আমাদের দেশে যেটা অতি ভয়ংকর বাস্তবতা তা হচ্ছে, উচ্চশিক্ষিত তরুনদের চাকরি ও জীবিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা। দেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে। দ্রব্যম‚ল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব, আয়-ব্যয়ের ভারসাম্যহীনতা, অভাব, হতামা ও প্রতিহিংসাবশত: এসব মানুষের ভেতরে জমিয়ে রাখে ক্ষোভ ও হতাশা। ফলে অল্প উসকানিতেই তারা যখন তখন রাজপথে নেমে আসে ‘প্রতিশোধ’ নিতে।
এর পরেরটা হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতি। যখন জনগণ বারবার দেখে, অপরাধীরা ধরা পড়ে না, মামলা চলে না, অথবা ক্ষমতার বলয়ে থেকে পার পেয়ে যায় তখন আইন-আদালতের প্রতি তাদের আস্থা কমে যায়। তখন তারা নিজেরাই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নামে ‘মব জাস্টিস’ করতে উদ্যত হয়। এটা ভয়ানক, কারণ এটা বিচার নয়, বরং নৈরাজ্যের উদযাপন।
এভাবে প্রতিটি সামাজিক বা রাজনৈতিক সংকট যেন একেকটি জন-উল্লাসের কুশপুত্তলিকায় পরিণত হচ্ছে। আগেই বলেছি, বাংলাদেশে এখন একটি ছায়াময় ও প্যারালাল রাজনীতি চলছে।একদিকে অনির্বাচিত সরকার অন্যদিকে রাজপথ ও সামাজিক মাধ্যমে পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ ও কুৎসা রটনার মহরৎ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এই দ্বৈত প্রবাহে সততা ও নৈতিকতা হারিয়ে যাচ্ছে, এবং গুজবের উসকানিদাতারা আড়ালে থেকে যাচ্ছে।
এই বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যেখানে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে হত্যা করা হয়েছে। ২০১৯ সালে ঢাকার উত্তরায় ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয় রেনু নামের এক নারীকে। পরে প্রমাণিত হয়, তিনি ছিলেন এক অসুস্থ সন্তানের মা, বিদ্যালয়ের খোঁজে বেরিয়েছিলেন।
এছাড়া বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় দুইটি হত্যাকান্ড ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল যা বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ এবং গাজীপুরের গার্মেন্ট শ্রমিক সোহাগ শেখের নির্মম মৃত্যু। আবারো ২০২৫ সালের ১০ জুলাই সেটার পুনরাবৃত্তি ঘটলো মিটফোর্ডের সামনে ভাঙ্গারী ব্যবসায়ী লালচান ওরফে সোহাগের নির্মম হত্যাকান্ডের মাধ্যমে। ঘটনাস্থল, পরিচয় ও প্রেক্ষাপট পৃথক হলেও এই দুই হত্যাকান্ডের প্রক্রিয়া, নৃশংসতা এবং বিচারহীনতার ঝুঁকির দিক থেকে তাদের মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। বরং এই তিন তরুণের মৃত্যু আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও শাসনব্যবস্থার একটি গভীর ব্যর্থতাকে নগ্নভাবে উন্মোচন করে দিয়েছে। এই অবস্থার অবসান দরকার, এখনই।
শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য শুধু উন্নয়ন বা অর্থনীতি নয়, দরকার একটি বিশ্বাসযোগ্য, ইনক্লুসিভ, ন্যায়ভিত্তিক রাজনৈতিক কাঠামো। অন্তবর্তী সরকারকে বুঝতে হবে মবক্রেসি দমন করতে কেবল লাঠিচার্জ বা মামলা নয়, প্রয়োজন বিশ্বাস তৈরির। রাজনৈতিক দলগুলোকেও বোঝাতে হবে জনতার কাঁধে ভর দিয়ে রাজনীতি করলে সেই কাঁধ এক সময় অবিশ্বাসে নুইয়ে পড়ে।
সবচেয়ে বড় কথা, সাধারণ জনগণকেও সাবধান হতে হবে। কেউ নিজেকে যেন কেউ কোনো ‘স্ক্রিপ্টেড সহিংসতার’ অংশ বানিয়ে না ফেলে। আন্দোলন মানে সবসময় আগুন নয়, প্রতিরোধ মানে সবসময় ভাঙচুর নয়। এটা আমাদের দেশের জন্য দুভার্গ্য বয়ে আনছে।বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র। শান্তিপূর্ণ সংলাপ ও সহনশীলতা ছাড়া এই সম্ভাবনা বাস্তবায়ন অসম্ভব। তাই অতি দ্রুত এই মবক্রেসির যুগ শেষ হোক।আমরা চাই আইনের শাসন, ন্যায়ের সংস্কৃতি, আর একটি মানবিক বাংলাদেশ।
এখন সময় এসেছে স্পষ্ট উচ্চারণের, লালচান ওরফে সোহাগের নিথর দেহ নয়, যে কোন লাশের উপর নৃশংসতা ও অমর্যাদা করা বন্ধ হোক। আমরা যেন মৃতকে আর ব্যবহার না করি জীবিতদের হাতিয়ার হিসেবে। মবক্রেসির নামে আবেগ দিয়ে আইন ভাঙা, সহিংসতা ছড়ানো এবং শোককে ব্যবসায় পরিণত করা এখনই থামাতে হবে।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]