বুধবার | ৬ আগস্ট, ২০২৫ | ২২ শ্রাবণ, ১৪৩২

ফ্যাসিস্ট পতনের বর্ষপূর্তির প্রকৃত তাৎপর্য কী?

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
দেখতে দেখতে একটি বছর পার হলো। যে দিনটি দেশের জনগণের কাছে এক অন্ধকার সময়ের অবসান হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। এক ফ্যাসিস্ট শাসনের পতনের দিন এবং আজ সেই দিনের বর্ষপূর্তি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেবল ক্যালেন্ডারের পাতায় একটি দিন টিক দিয়ে পালন করলেই কি এর তাৎপর্য পূর্ণ হবে? নাকি এর গভীরতা খুঁজে নিতে হবে অতীত ও বর্তমানের নিরীক্ষায়, জনআকাঙ্ক্ষা ও রাষ্ট্রীয় বাস্তবতার বিশ্লেষণের মাধ্যমে? জাতির সামনে আজ এ এক জটিল প্রশ্ন।
ফ্যাসিবাদ শুধু একটি শাসনব্যবস্থা নয়। এটি এক ভয়াবহ রাষ্ট্রচিন্তার নাম। যেখানে একক ক্ষমতা, মতপ্রকাশের অবদমন, নাগরিক স্বাধীনতার গলাটিপে ধরা, এবং প্রতিরোধকে রাষ্ট্রদ্রোহের নাম দিয়ে দমন করাই নিয়ম। সেই দমনমূলক ব্যবস্থার পতন নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক জয়। কিন্তু ফ্যাসিস্ট পতনের বর্ষপূর্তির প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে হলে আমাদের মূল্যায়ন করতে হবে—এই এক বছরে কী কী বদলেছে, কী একই রয়ে গেছে, আর কী কী বদলানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।
প্রথমত, রাজনৈতিক পরিসরে কতটা উদারতা এসেছে? আগের শাসনামলে ভিন্নমত দমন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। নতুন সরকার বিরোধীদের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করবে—এই ছিল অঙ্গীকার। কিন্তু বর্ষপূর্তিতে এসে দেখা যাচ্ছে, বিরোধীদের কণ্ঠস্বর এখনও অনেকক্ষেত্রেই কোণঠাসা। মামলা-হামলার সংস্কৃতি পুরোপুরি উঠেনি, বরং অনেক ক্ষেত্রে শুধু রূপ বদলেছে, কৌশল পাল্টেছে।
দ্বিতীয়ত, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনতার এই বিজয় কি বিচার ও জবাবদিহির জায়গায় কোনো উত্তরণ ঘটাতে পেরেছে? আমরা দেখেছি, আগের শাসকদের দুর্নীতির পাহাড়, গুম-খুনের ইতিহাস, এবং ভোট-ছিনতাইয়ের এক অমানবিক সংস্কৃতি। এক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও সেই অপরাধের বিচার হয়নি, গুম হওয়া মানুষদের সন্ধান মেলেনি, এবং রাষ্ট্রের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা অপতৎপরতা নির্মূল হয়নি। তাহলে এই বর্ষপূর্তি কি শুধুই প্রতীকী?
তৃতীয়ত, এই বর্ষপূর্তির তাৎপর্য নির্ধারিত হয় জনগণের আশার পরিপূরণে। ফ্যাসিস্ট পতনের অর্থ ছিল মানুষ মুক্ত হবে, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করবে, রাষ্ট্র হবে জবাবদিহিমূলক, প্রশাসন হবে জনগণের সেবক। কিন্তু এখনো যদি সেই একই দুর্বিনীত আমলাতন্ত্র, দলকানা প্রশাসন, আর সুযোগসন্ধানী মিডিয়াই বিদ্যমান থাকে, তবে মানুষ প্রশ্ন করতেই পারে আমরা কি শুধু শাসক বদলেছি, না কি শাসনের ধরনেও কোনো মৌলিক পরিবর্তন এনেছি?
তবে আশার কিছু আলোকরেখাও রয়েছে। জনগণের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে, তরুণ প্রজন্ম আগের চেয়ে বেশি রাজনৈতিক ও নৈতিক প্রশ্নে সোচ্চার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাহসী মতামত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনীতির নতুন ভাষা, মাঠপর্যায়ে কর্মীদের আন্দোলন এসবই বোঝায় যে, ফ্যাসিবাদ শুধু পতনেই শেষ নয়, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধও চলমান।
ফ্যাসিস্ট পতনের বর্ষপূর্তির প্রকৃত তাৎপর্য তাই একটিমাত্র দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা যায় না। এটি একদিকে যেমন আনন্দ ও আশার দিন, অন্যদিকে তেমনি আত্মসমালোচনা ও প্রতিশ্রুতি পুনর্বিবেচনার সময়। আমরা কেবল ফ্যাসিস্ট শাসকের পতন দেখিনি; আমরা এক মনস্তাত্ত্বিক দাসত্ব ভেঙে বেরিয়ে আসার সাহস দেখিয়েছি। কিন্তু সেই সাহসের পূর্ণতা তখনই আসবে, যখন প্রতিষ্ঠানগত সংস্কার, বিচারিক স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক নৈতিকতা একসাথে মিলিত হবে।
এই বর্ষপূর্তির দিনে আমাদের নতুন করে ভাবা দরকার ফ্যাসিবাদের পতনের অর্থ শুধু অতীতের অন্ধকার ঘুচানো নয়, বরং ভবিষ্যতের পথ আলোকিত করা। যাতে আগামী প্রজন্ম একথা বলতে পারে, এক সময় আমরা ফ্যাসিবাদ পরাজিত করেছিলাম, আর তারপর আমরা আমাদের গণতন্ত্র রক্ষা করেছিলাম।
এক বছর আগের এই দিনে রাষ্ট্রের অন্ধকারতম অধ্যায়টি আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছিল—একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে। অনেকেই সেই সময়টিকে নতুন সূর্যোদয়ের দিন, নতুন বাংলাদেশ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। মনে হয়েছিল জনগণের দীর্ঘশ্বাস যেন প্রথমবারের মতো বাতাসে জোরে উচ্চারিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু এক বছর পর দাঁড়িয়ে আমরা যদি প্রশ্ন করি, ফ্যাসিস্ট পতনের বর্ষপূর্তিতে কী পেলাম? উত্তরটা খুব একটা সরল নয়।
প্রথমত, ফ্যাসিবাদের পতন মানেই কি গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম? অনেকে ভেবেছিলেন, ফ্যাসিস্ট শাসকের বিদায়ের সাথে সাথেই দেশে বাকস্বাধীনতা, সুশাসন ও মানবাধিকারের চর্চা ফিরে আসবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, পুরনো দানবকে সরিয়ে আমরা হয়তো কিছুটা নিঃশ্বাস নিতে পেরেছি, তবে যে কাঠামোটি তাকে জন্ম দিয়েছিল, তা আজও বহাল তবিয়তে রয়েছে। যেমন—অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইন এখনও স্বাধীন মতপ্রকাশের পথ রুদ্ধ করে রেখেছে, বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ, প্রশাসন ও গণমাধ্যমের বড় অংশ এখনো প্রভাবশালীদের পকেটে।
দ্বিতীয়ত, ফ্যাসিস্ট শাসনের সময় যেসব বিরোধী কণ্ঠ দমন হয়েছিল, সেই কণ্ঠগুলো আজ কতটা মুক্ত? বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে ফিরে দেখা যায়, অনেক তরুণ সমাজকর্মী কিংবা নিখোঁজ হওয়া সাংবাদিক, গুম হওয়া ব্যাক্তি এখনও অন্ধকারে। তাদের অনুপস্থিতির দায় কেউ নিচ্ছে না, বিচারের আশা কেউ দেখাচ্ছে না।
তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটেও কি আমূল কোনো পরিবর্তন ঘটেছে? ফ্যাসিস্ট আমলে রাষ্ট্রীয় লুটপাট, ব্যাংক কেলেঙ্কারি, মেগা প্রকল্পে দুর্নীতি—এসব ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পরও যখন দেখা যায় আগের খেলোয়াড়েরা শুধু দল বদলে খেলা চালিয়ে যাচ্ছে। যানজট, জলজট ও চাঁদাবাজি বেড়েছে বহুগুণ । তাই নাগরিক সমাজ এখনও অনেকটা হতাশ।
তবে কি কিছুই অর্জিত হয়নি? এমনটা বলা যাবে না। অন্তত ভয়-ভীতির সংস্কৃতির কিছুটা চাকা থেমেছে। মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছুটা বেশি খোলামেলা আলোচনা করছে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি নতুনভাবে চিন্তা করার সুযোগ পেয়েছে। মাঠে-ময়দানে প্রতিবাদের ভাষা ফিরেছে, যদিও তা এখনও খুব দুর্বল ও এলোমেলো।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এই বর্ষপূর্তির প্রকৃত তাৎপর্য কী দাঁড়ায়? এটি কি শুধুই ক্ষমতার হাতবদল, নাকি একটি কাঠামোগত পরিবর্তনের ডাক ছিল? দুর্ভাগ্যজনক হলেও বলতে হয়, অনেক জায়গায় পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি কেবল রাজনৈতিক পোস্টারে আটকে আছে। সাধারণ মানুষের জীবনে এর বাস্তব প্রতিফলন খুবই ক্ষীণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তরুণদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ফ্যাসিস্ট পতনের বার্ষিকী পালনের চেয়ে বরং শোকাবার্ষিকী বলেই ব্যঙ্গ করছে। তবে অনেকেরে কাছে এটি নিছক হতাশা নয়, বরং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার নতুন ভাষা। সুতরাং, বর্ষপূর্তির এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা হওয়া উচিত ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছিল শুধুই একজন শাসকের বিরুদ্ধে, নাকি একটি দমনমূলক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে? যদি উত্তর হয় দ্বিতীয়টি, তবে আমাদের গণতন্ত্রের জন্য লড়াই এখনও শেষ হয়নি।
বর্ষপূর্তির এই দিনে, শুধুই উৎসব নয়, প্রয়োজন আরো বড় এক আত্মসমালোচনার। কারণ ফ্যাসিবাদ শুধু একটি নাম নয়, এটি একটি পদ্ধতি, একটি মানসিকতা। একে সত্যিকারভাবে পরাজিত করতে হলে নাগরিকদের দায়িত্ব নিতে হবে, প্রতিটি ক্ষেত্রে—গণমাধ্যমে, শিক্ষায়, রাজনীতিতে এবং ন্যায়বিচারে। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই, হয়তো আমরা আগামী বর্ষপূর্তিতে সত্যিকারের বিজয়ের গল্প লিখতে পারবো। অন্যথায় এক বছরের মাথায় আবার যদি সেই পুরনো শাসনের ছায়া ফিরে আসে ভিন্নমুখে তাহলে ফ্যাসিস্ট পতনের এই দিন কেবল ইতিহাসের আরেকটি ব্যর্থ প্রতীক হয়ে থাকবে।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.