নাটোর প্রতিনিধি :
নাটোরের লালপুরে প্রাইভেট কারের পাশ থেকে চালকের গলাকাটা মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন যাত্রী তাওহিদুল ইসলাম (২০)।
শনিবার (৯ আগস্ট ২০২৫) নাটোরের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন তিনি।
ওই জবানবন্দির বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার আসামি তাওহিদুল পারিবারিক টানাপোড়েনে মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন এবং উগ্রবাদী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, সমাজ থেকে খারাপ লোক সরিয়ে ফেলার উদ্দেশ্যে তিনি ওই চালককে গলা কেটে হত্যা করেছেন।
গত বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট ২০২৫) দিবাগত রাত ১০টার দিকে লালপুর-বনপাড়া আঞ্চলিক সড়কের উপজেলার গোপালপুর পৌরসভার নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস হাইস্কুলের পাশে তাকে গলা কেটে হত্যা করে। নিহতের সঙ্গে থাকা মোবাইল ও কাগজপত্র থেকে জানা যায়, তিনি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা দক্ষিণ রেলগেট এলাকার বামনপাড়া গ্রামের আলতাফ হোসেনের ছেলে। তিনি একজন পেশাদার ড্রাইভার।
এ ঘটনায় নিহতের ছোট ভাই মো. আলমগীর হোসেন (৩৩) বাদি হয়ে লালপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের বাহেরমালী গ্রামের মহিদুল ইসলামের ছেলে মো. তাওহিদুল ইসলাম (২০) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে শুক্রবার আদালতের মাধ্যমে নাটোর জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা লালপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সেলিম রেজা জানান, তাওহিদুল ইসলাম অবিবাহিত ভবঘুরে। পারিবারিক নানা টানাপোড়েনে তিনি মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামির বশবর্তী হয়ে সমাজের খারাপ লোকদের হত্যার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে দুটি ঘটনায় ব্যর্থ হয়েছিলেন। এরপর অসামাজিক কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগে তিনি চালক সাইদুল ইসলামকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
জবানবন্দিতে তাওহিদুল জানিয়েছেন, কাজের সন্ধানে তিনি একসময় কুমিল্লায় যান। সেখানে এক ব্যক্তি তাঁকে দিয়ে মাদক সরবরাহ করাতেন। এর প্রতিবাদে তিনি মাদকে আগুন ধরিয়ে দেন। কিন্তু কেউ মারা যায়নি। পরে সমাজের অন্য দুষ্ট লোকদের তিনি খুঁজতে থাকেন। তিনি যৌনপল্লির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় চালক সাইদুরকে দেখতে পান। তখন তিনি তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। ৭০ টাকা দিয়ে একটি ছুরি কেনেন এবং বনপাড়ায় যাওয়ার কথা বলে আড়াই হাজার টাকা দিয়ে সাইদুরের গাড়ি ভাড়া করেন। ৭ আগস্ট সন্ধ্যার পর তিনি সাইদুরের গাড়িতে বনপাড়ার দিকে যাচ্ছিলেন। গোপালপুরে সুগার মিলস স্কুলের পাশে পৌঁছালে তিনি চালককে গাড়ি থামাতে বলেন। এ সময় তিনি পেছন থেকে চালকের গলার ডান পাশে টান দেন এবং গলা কেটে ফেলেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়। তাঁর শরীরেও (তাওহিদুল) রক্ত মেখে যায়। চালক বাঁচার জন্য গাড়ি থেকে বের হলেও রাস্তায় পড়ে যান। তখন তিনি রক্তমাখা পাঞ্জাবি খুলে পালানোর চেষ্টা করেন। তবে স্থানীয় লোকজন তাঁকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেন।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস হাইস্কুলসংলগ্ন রাস্তার পাশে থেমে থাকা একটি প্রাইভেট কার থেকে চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পান স্থানীয় বাসিন্দারা। এ সময় দূর থেকে তাঁরা এগিয়ে এসে গাড়ির পাশে রাস্তায় গলা কাটা অবস্থায় এক ব্যক্তির মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। তাঁরা পুলিশে খবর দিলে ঘটনাস্থলে এসে মরদেহ উদ্ধার করে লালপুর থানা পুলিশ। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে একটি সাদা রংয়ের প্রাইভেট কার (খুলনা মেট্রো-ক-০২-০১৮০), মোবাইল ফোন, একটি ধারালো চাকু ও কিছু কাগজপত্রসহ লাশ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত মোবাইল ও কাগজপত্র থেকে নিহতের পরিচয় শনাক্ত করা হয়। এ সময় সেখানে সাদা গেঞ্জি গায়ে অপরিচিত এক ব্যক্তিকে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে দেখে তাকে আটক করেন স্থানীয়রা। পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায়।
নিহত সাইদুর রহমানের স্ত্রী তানিয়া খাতুন (৩৬) বলেন, সাইদুর রহমান খুব ছোট থেকে প্রাইভেটকার চালাতেন। তিনি ২০ বছর ধরে প্রাইভেটকার চালানো ও প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। শুরুর দিকে তিনি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান উপজেলা বিএনপির আহবায়ক অ্যাডভোকেট তহিদুল ইসলামের গাড়ি চালাতেন। তবে দীর্ঘদিন ধরে সে পেশা বাদ দিয়ে তিনি প্রাইভেটকার ড্রাইভিংয়ের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করে আসছিলেন। এজন্য তিনি এলাকায় ড্রাইভার ওস্তাদ নামে পরিচিত ছিলেন। তবে মাঝে মাঝে তিনি ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করতেন। বৃহস্পতিবার রাত ৮ টার দিকে তিনি মুঠোফোনে তাকে জানান, কুষ্টিয়া থেকে বনপাড়ায় এক যাত্রীকে ভাড়ায় নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। পথিমধ্যে ফোনে একবার স্ত্রীকে জানান, রাস্তা ভাঙ্গা থাকায় তিনি লালপুর-গোপালপুর হয়ে যাত্রীকে বনপাড়া নিয়ে যাবেন। পরে জানতে পারেন তাকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি আহাজারি করে বলেন, আমার তিন ছেলে মেয়েকে নিয়ে কিভাবে চলবো? কি করব? কিছুই বুঝতে পারছি না। তিনি এ হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।