রবিবার | ১৭ আগস্ট, ২০২৫ | ২ ভাদ্র, ১৪৩২

নবম বেহেস্ত ও অনিয়ন্ত্রিত অটোদানব

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
কিছুদিন পূর্বে উত্তরের এক উপজেলা সদর থেকে বেশ ভিতরে এক গ্রামের বিনোদন পার্কে গিয়েছিলাম। তবে ঘুরতে নয়। সেখানকার একটি অডিটোরিয়ামে গ্রামের মহিলাদের নিয়ে একটি কর্মশালার আয়োজন ছিল।রাজধানীর কিছু বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন অতিথিও এসছিলেন সেখানে। অডিটোরিয়ামে এসি না থাকায় কেউ কেউ বির বির করছিলেন। সেখানে ফ্যানের স্বল্পতাও বেশ। একসংগে অনেকগুলো মানুষের ভীড়ে হলের পরিবেশ গরম মনে হওয়ায় জানালা খলে দেয়া হলো, পর্দা সরিয়ে দেয়া হলো। আশেপাশে কোন বাড়িঘর, দোকানপাট নেই।বাইরে তাকালে সবুজ ধানক্ষেতের দিকে দৃষ্টি চলে যায়।এজন বড় বক্তা সুপেয় পানির অভাব নিয়ে কথা বলা শুরু করে দক্ষিণ বঙ্গে তার কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা শোনাতে লাগলেন। উঠে এরা বঙ্গপোসাগরের নিকটবর্তী জেলাগুলোর মানুষের সামুদ্রিক জলোচ্ছাস, বাড়িঘর, চিংড়ি ঘের ভেসে যাওয়া ও খাবার পানির সংকটের কথা।তিনি বলতে লাগলেন, আপনার উত্তর বঙ্গের মানুষ্। মাটিতে টিউবওয়েল পুঁতলে খাবার পানে পাচ্ছেন।এদিকে বন্যাও তেমন হয় না। জমিতে সেচের পানি পান।চারদিকে এত গাছপালা, সবুজ প্রকৃতির মাঝে বসবাস করেন।এখন দক্ষিণ ও পূবের তুলনায় উত্তরবঙ্গের মানুষের অভাব অনেকটা কমে গেছে। উত্তরবঙ্গ আমাদের জন্য শন্তি-সুখের হাতছানি, আপনাদের জন্য নবম বেহেস্ত!
তবে একজন বললেন, এই নবম বেহেস্তের মধ্যে এক দানব বাসা বেঁধেছে।উত্তরবঙ্গের ছোট শহর থেকে শুরু করে উপজেলা সদর—সবখানেই আজ এক নতুন শক্তির দাপট। এই শক্তি সড়কের শাসনভার হাতে নিয়েছে, পুলিশ, প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কারও কথাই শোনে না। নাম তার অটোরিকশা, যাকে অনেকে এখন মজা করে বলছেন ‘অটোদানব’। নবম বেহেস্তে থাকা লোকের মতো এই বাহনগুলো চালায় একশ্রেণির চালকেরা। যেন রাস্তাঘাট, মানুষ, নিয়ম-নীতি সবই শুধ তাদের জন্য বরাদ্দ করা। যে দিক ইচ্ছে, যে গতিতে ইচ্ছে, যে জায়গায় ইচ্ছে, থামা-চলা, সবই তাদের মর্জি।
উত্তরবঙ্গের রাস্তায় অটোরিকশা চলাচলের একটি বড় সমস্যা হলো এর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীনতা। অধিকাংশ অটোচালক অপ্রশিক্ষিত, অনেকেরই বৈধ লাইসেন্স নেই। ‘ট্রেনিং কার’লিখে যে সব কিশোর ড্রাইভিং শেখার কথা তারাই যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতায় মেতে থাকে। এদের জন্য রাস্তাঘাটে গতিসীমা, ট্রাফিক সিগন্যাল, একমুখী রাস্তা সবই কাগুজে আইন। গ্রামীণ বা আঞ্চলিক সড়কে এগুলো ৩-চাকার বাইসাইকেল আর ৩-চাকার মোটরযানের মাঝামাঝি এক ধরনের হাইব্রিড ভয়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জনজীবনে এই দাপটের প্রভাব ভয়াবহ। চারদিক থেকে প্রতিদিন দুর্ঘটনার খবর আসছে তাদের কারণে। যাত্রী আহত, পথচারী নিহত, মোটরসাইকেল বা সাইকেল আরোহী পিষ্ট হওয়ার ঘটনা যেন নিত্যদিনের ঘটনা। অনেক সময় চালকরা নিজেরা আহত বা নিহত হন, কারণ অটোরিকশা ধাক্কা সামলানোর মতো কাঠামোগত নিরাপত্তা বহন করে না। যাত্রী পরিবহনের প্রতিযোগিতা, তাড়াহুড়া, অতিরিক্ত বোঝা, সব মিলিয়ে অটোদানবের ছুটে চলা আসলে মৃত্যুর সঙ্গে দৌড় দেবার নতুন প্রতিযোগিতা।
প্রশাসনের ভূমিকা এখানে সবচেয়ে প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক জায়গায় রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় বা প্রভাবশালী মহলের মদদে এই অটোরিকশা বাহিনী অপ্রতিরোধ্য। রাস্তায় অবৈধভাবে চলাচল, রুট পারমিট ছাড়া বহর গঠন, অবৈধ গ্যারেজ—সবই যেন প্রকাশ্য গোপন সত্য। পুলিশও প্রায়শই তদারকি না করে চোখ বন্ধ রাখে, কারণ রাজনৈতিক চাপ, ঘুষ কিংবা মামা-ভাগ্নে সম্পর্ক।
যাত্রীদেরও সচেতনতার ঘাটতি আছে। মাত্র ১০ টাকার ভাড়ায় বাসস্ট্যান্ড থেকে হাট পর্যন্ত পৌঁছে দেয় যে বাহন, তার কাছে নিরাপত্তা নিয়ে দরকষাকষি করার সুযোগ কম। তাছাড়া গ্রামীণ বা অপ্রতুল গণপরিবহনের এলাকায় অটোরিকশা একপ্রকার বাধ্যতামূলক সমাধান। কিন্তু এই সহজ সমাধানই যখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে, তখন সমাজের চুপ করে থাকা বিপজ্জনক।
এ সমস্যার সমাধানে প্রথমত প্রয়োজন নীতিগত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা জরুরী। বৈধ রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্স ছাড়া কোনো অটোরিকশা যেন রাস্তায় না চলে, তা নিশ্চিত করতে হবে। চালকদের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে, স্কুল-কলেজগামী কিশোরদের হাতে স্টিয়ারিং তুলে দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। প্রতিটি পৌরসভা ও উপজেলা প্রশাসনকে নির্দিষ্ট রুট ও স্টপেজ নির্ধারণ করতে হবে এবং অতিরিক্ত যাত্রী তোলা বা দ্রুতগতির প্রতিযোগিতা বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।
সর্বোপরি, মানুষকে বুঝতে হবে অটোরিকশা কোনো স্বর্গীয় বাহন নয় যে নবম বেহেস্তের নিশ্চিন্ততা নিয়ে যাত্রা করা যায়। বরং শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা না ফিরলে এই অটোদানবই রাস্তাঘাটে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ করবে। উত্তরবঙ্গের সড়ক যদি জীবনের সড়ক হয়ে থাকতে চায়, তবে এই নিয়ন্ত্রণহীন দৌড়ের লাগাম এখনই টেনে ধরা জরুরি।
উত্তরবঙ্গের রাস্তাঘাট আজকাল এক ধরনের দ্বন্দ্বক্ষেত্র। একটি পক্ষ সোজা পথে বেরোতে চায়—অন্যটি রুট, সিগনাল, ফুটপাত, পার্কিং সবকিছুই দখল করে বসে। সেই অটোদানব অবৈধ, অনিয়ন্ত্রিত অটোরিকশা নিশ্চিতভাবে এখন শুধু ঝামিলা নয়; মৃত্যুর সরাসরি কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজশাহী, চাঁপাইনাবগঞ্জ, নওগাঁ, রংপুর, সৈয়দপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, নাটোরের সাম্প্রতিক সংবাদই এ বাস্তবতার আংশিক প্রতিচ্ছবি। রাজশাহী মহানগরে বেপরোয়া রিকশা ও অটোরিকশার অপ্রশিক্ষিত চালকদের কারণে দুর্ঘটনা ও যানজট বেড়েছে। এজন্য নগরবাসীর দৈনন্দিন চলাচলই কঠিন হয়ে পড়েছে।
দেশের সড়কদুর্ঘটনামূলক মৃত্যুর অনুপাত বছরের পর বছর ভয়াবহ মাত্রায় বেড়ে চলেছে। এজন্য দেশজুড়ে প্রতি বছর হাজার হাজার প্রাণ হারাচ্ছে। এই জাতীয় কর্মক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গও পিছিয়ে নেই; রাস্তায় অটোরিকশা-জড়িত বিভিন্ন লঘু-গুরুতর দুর্ঘটনার খবরে বছরভর সংবাদস্থল ভরা থাকে।
যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, কেন অবৈধ অটোরিকশা বিপজ্জনক? কারণ এর নিরাপত্তার শূন্যতা। অধিকাংশ অবৈধ অটো রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস সার্টিফিকেট বা যথাযথ বোঝাই-নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই চলাচল করে; তাতে কোনো ক্র্যাশ-প্রোটেকশন নেই। অনেক শিশু চালক বেপরোয়াভাবে অটো চালায়। তাদের চালক-প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। লাইসেন্সহীন বা অনভিজ্ঞ চালক তৎক্ষণাত সিদ্ধান্ত নেন; ওভারটেকিং, উল্টোদিকে ঢোকার প্রবণতা বেশি।
এরা সিগনাল, ওয়াকওয়ে, একমুখী নির্দেশ—এসব কাগজে থাকলেও বাস্তবে মানা হয় না; ফলে পথচারী ও আরোহীরা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গ্রাম থেকে অটোচালকরা একবার ব্যাটারী চার্জ্জ করে গাড়ি নিয়ে সকালে শহরগুলোতে আসে। সারাদিন গাড়ি চালিয়ে ব্যাটারীর চার্জ্জ কমে গলে রাতে লাইট জ্বালায় না।সিগন্যাল লাইটও জ্বলে না। সে অবস্থায় লাইটবিহীন তারা অনেক রাত অবধি ভাড়ায় খাটে। এটা পথচারী ও অন্যান্য গাড়ির জন্য মারাত্মক।
উত্তরবঙ্গের রাস্তায় অটোদানব দমন করতে নীচের ব্যবস্থা জরুরি। এদের নিবন্ধন ও ফিটনেস বাধ্যতামূলক করা উচিত। এজন্য অবৈধ অটোরিকশা দ্রুত চিহ্নিত করে জব্দ-অপারেশন বাড়াতে হবে; নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফিটনেস পেতে না পারলে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। চালক-লাইসেন্স ও প্রশিক্ষণ বাধ্যতামক করা দরকার। জেলা স্তরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নিয়মিত ড্রাইভিং-সেফটি ও রোড-এথিক্স কোর্স পারফরম্যান্স ভিত্তিক লাইসেন্স রি-ইস্যু করা দরকার। অর্থায়নে ন্যানো লোন বা ভর্তুকি করে বস্তা চালকদের উৎসাহিত করা যেতে পারে।
এদের জন্য নির্দিষ্ট রুট, স্টপেজ ও সময়সূচি নির্ধারণ করে দিতে হবে। বাজার, স্কুল, হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকায় অটোরিকশা স্ট্যান্ডের নির্দিষ্ট জোন করে রাতের কোনো নির্দিষ্ট ঘন্টায় মহাসড়ক পারাপারে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। স্থানীয় পৌরসভা-উপজেলা সমন্বয়ে পুর্ন-রুট ম্যাপ তৈরি করে বাস্তবায়ন করতে হবে। পুলিশি তদারকি এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা জোরদার করে জরিমানা, আর্থিক দন্ড নীতি, পুনরাবৃত্ত অপরাধে গাড়ি বাজেয়াপ্ত ও পরবর্তী কোর্ট কার্যক্রম দ্রুততর করা উচিত। এজন্য মাঠ প্রশাসনকে দণ্ডবিধি প্রয়োগে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হতে হবে।
এই সংকট মোকাবেলায় রাষ্ট্রীয় নীতিই শেষ কথা নয়। স্থানীয় রাজনীতিক, জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী শ্রেণীরও দায় আছে। রুট-আইনি লঙ্ঘনে চলমান ছায়া অর্থাৎ কোনো রাতারাতি অভিযান না বরং ধারাবাহিক মনিটরিং ও স্বচ্ছ রিপোর্টিং ব্যবস্থা রাখতে হবে। রাজশাহী, রংপুর, বগুড়া, নাটোরের সীমান্তহীন উদাহরণ দেখিয়ে দেয়, অ্যাকশন না নিলে ক্ষতি সারা উত্তরবঙ্গ জুড়ে ছড়াবে। ঢাকার মতো পঙ্গু করে দেবে দেশের জাতীয় সড়কপথসহ সকল অলিগলি!
নবম বেহেশ্ত নয়, জীবন-অধিকার রক্ষা করাই প্রথম ।অটোরিকশা যদি এলাকায় দ্রুততা ও অর্থনৈতিক সুযোগ এনে দেয় তা আমরা সবাই মানি। কিন্তু সেই সুবিধা যদি প্রতিদিনের রুটিনকে মৃত্যুবোঝায়, তাহলে সহজ সমাধানই বড় বিপদ। উত্তরবঙ্গের সব রাস্তায় নিয়ন্ত্রণহীন অবৈধ অটোরিকশার দাপট প্রথাগত ভাবে সামলানো সম্ভব নয়; প্রয়োজন সুসংবদ্ধ, স্থায়ী ও সুশাসনমুখী উদ্যোগ যেখানে আইন, প্রযুক্তি, স্থানীয় অংশগ্রহণ ও জনসচেতনতা একসঙ্গে কাজ করবে। না হলে শহর-গ্রাম মিলিয়ে আমরা কেবল নবম বেহেস্ত’র গল্প শুনবনা, বহু কবর খোঁড়ার সংবাদও শুনতে হবে। এখনই সময় অটোরিকশাকে মানুষের সেবক করে তুলতে, একদিকে স্বল্পখরচে চলাফেরা নিশ্চিত রেখে, অন্যদিকে জীবন ও মর্যাদাকে রোধ করতে কার্যকর পরিকল্পনা নিতে হবে।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.