বৃহস্পতিবার | ২১ আগস্ট, ২০২৫ | ৬ ভাদ্র, ১৪৩২

এরা বলে এটা ওরা ওটা: সঠিক ইতিহাসের দায়ভার কার?

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
বাংলাদেশে এখন একটি সাধারণ কথোপকথনের প্রেক্ষাপট নিজের মনগড়া ইতিহাসকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়। কেউ বলে, এই ঘটনাই ইতিহাস, আরেক দল পাল্টা জবাব দেয় না, ওইটিই আসল ইতিহাস। ফলে ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়েছে মতাদর্শিক দ্বন্দ্বের জালে আটকে থাকা এক বিতর্কিত আখ্যান। অথচ ইতিহাস তো আসলে কোনো দলের সম্পত্তি নয়। এটি একটি জাতির সম্মিলিত স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, সংগ্রাম ও অর্জনের প্রতিফলন। কিন্তু যখন সেই ইতিহাসকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়, তখন সত্য চাপা পড়ে যায়, আর বিভ্রান্তি হয়ে ওঠে জনগণের চরম শত্রু। কিন্ত আমাদের ইতিহাসের সঠিক চিত্র উপস্থাপনের দায়িত্ব ও দায়ভার কার?
রাজনীতিবিদেরা তো তাঁদের দলীয় অবস্থান থেকেই ব্যাখ্যা দেবেন, সেটি স্বাভাবিক। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা কেন্দ্র, আর্কাইভ ও জাতীয় জাদুঘরের কাজ হওয়া উচিত তথ্য-প্রমাণভিত্তিক নিরপেক্ষ ইতিহাস সংরক্ষণ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করেছে রাজনৈতিক মতাদর্শ। গবেষণা অনুদান দেওয়া হয় দলভিত্তিক পছন্দে, গবেষণা প্রতিবেদনও অনেক সময় সাজানো হয় উর্ধ্বতন মহলের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। ফলে নিরপেক্ষ ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্র ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে।
শিক্ষা ব্যবস্থায় ইতিহাসের বিকৃতি ও দ্বন্দ্ব রয়েই গেছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো এ দ্বন্দ্ব কেবল রাজনৈতিক বক্তৃতা বা টকশোতেই সীমাবদ্ধ নেই। শিক্ষা ব্যবস্থাতেও এর ছাপ স্পষ্ট। এক সময়ে যে পাঠ্যবইয়ে একটি বিশেষ ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়া হতো, কয়েক বছর পর সরকার বদলালে দেখা যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে সেই ঘটনার উপস্থাপনা। নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত হয়; তারা ভাবে, ইতিহাস বোধহয় সত্য নয়, বরং ক্ষমতার পালাবদলের মতোই পরিবর্তনশীল। অথচ ইতিহাসকে এভাবে রঙ বদলানো একটি জাতির জন্য ভয়াবহ ক্ষতির কারণ। এতে তরুণরা আর নির্ভরযোগ্য উৎস খুঁজে পায় না। তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার বদলে ইতিহাসকে সন্দেহ করতে শুরু করে।
বিশ্ব ইতিহাসেও একই প্রবণতা রয়েছে।শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব ইতিহাসেও এ সমস্যা নতুন নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস ইউরোপে যেমনভাবে লেখা হয়েছে, জাপানে তার ভিন্ন রূপ পাওয়া যায়। উপনিবেশের ইতিহাস ভারতীয় দৃষ্টিতে এক রকম, আবার ব্রিটিশ দৃষ্টিতে ভিন্ন। ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের ইতিহাস নিয়েও একপক্ষের দাবি অপরপক্ষ মানতে নারাজ। অর্থাৎ ইতিহাস হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতাশালী পক্ষের বয়ান, আর দুর্বল পক্ষের স্মৃতি পড়ে থাকে প্রান্তিক আখ্যান হিসেবে। কিন্তু আজকের বৈশ্বিক যুগে গবেষণা, মুক্ত তথ্যপ্রবাহ ও ডিজিটাল আর্কাইভ ইতিহাসকে ক্রমশ বহুমাত্রিক করে তুলছে। বাংলাদেশেও এই প্রবণতা বাড়ানো দরকার।
ইতিহাসের বিকৃতির সামাজিক প্রভাব প্রবল।যখন ইতিহাসকে নিয়ে দ্বন্দ্ব বাড়ে, তখন তা সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি করে। প্রজন্ম বিভক্ত হয়, পরিবার বিভক্ত হয়, এমনকি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোও বিভ্রান্তির শিকার হয়। এক পক্ষকে অন্য পক্ষ সন্দেহ করে, কেউ কাউকে মানতে চায় না। ফলে ইতিহাস একটি ঐক্যের বদলে বিভেদের উপাদানে পরিণত হয়। তরুণ প্রজন্ম তখন ইতিহাসকে জটিল ও ঝামেলাপূর্ণ মনে করে, এবং ইতিহাসচর্চা থেকে বিমুখ হয়।
এ থেকে মুক্তির পথ হচ্ছে নিরপেক্ষ ইতিহাসচর্চা করা।এজন্য ইতিহাসচর্চাকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করা জরুরি। গবেষণা অনুদান থেকে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন—সব ক্ষেত্রেই স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। মৌলিক তথ্য-প্রমাণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দলিল, নথি, সাক্ষাৎকার, সংবাদপত্রের আর্কাইভ, আন্তর্জাতিক গবেষণা—এসবের ওপর ভিত্তি করে ইতিহাস লিখতে হবে। ভিন্নমতকেও গুরুত্ব দিতে হবে। ইতিহাসে একাধিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে, কিন্তু তা যেন তথ্যভিত্তিক হয়। কোনো দৃষ্টিভঙ্গিকে একচেটিয়া সত্য হিসেবে চাপিয়ে দিলে বিতর্ক বাড়ে, সত্য নয়। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ইতিহাসচর্চায় উৎসাহিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন গবেষণা পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ইতিহাস লিখতে শেখে।
প্রশ্ন হচ্ছে এই জটিলতার সমাধানের পথ কোথায়? আমাদের নিরপেক্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নেই। তাই সেটা তৈরি করতে হবে, যেখানে দলীয় প্রভাবমুক্ত ইতিহাস সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় আনা জরুরি। বারবার পাঠ্যবই পাল্টানো নয়, বরং তথ্য-প্রমাণভিত্তিক পাঠ্যক্রম তৈরি করতে হবে। ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা আরো বাড়াতে হবে। ইতিহাসে একাধিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে, কিন্তু তথ্য-ভিত্তিক আলোচনা ছাড়া তা জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয় না। ডিজিটাল আর্কাইভ ও উন্মুক্ত তথ্যভান্ডার গড়ে তুলতে হবে, যাতে নতুন প্রজন্ম নিজেই তথ্য খুঁজে বের করতে পারে এবং আর কারও কথায় অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে না হয়। এ.আই. প্রযুক্তি যেন মুহূর্তেই এসব আর্কাইভকে আরো বিকৃত করতে না পারে সেজন্য নথির ম্যানুয়েল সংরক্ষণকে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে।
আমাদের দেশে এটা-ওটা বিকর্কের বেড়াজালে পড়ে নিত্যনতুন ব্যাখ্যা শুনতে গিয়ে নতুন প্রজন্ম খুবই হতাশ। হতাশা থেকে চরম বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে এদেশের কিশোর-তরুণ সমাজ। যুব সমাজ সব সময়ই ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে এগোয়। কিন্তু যখন তারা দেখে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার ঘোষণা, শহীদের সংখ্যা কিংবা কোনো ঐতিহাসিক নেতার ভূমিকা নিয়ে বারবার পাল্টা-পাল্টি দাবি করা হয়, তখন তারা বিভ্রান্ত হয়। এক প্রজন্মকে এক রকম পাঠ্যবই পড়ানো হয়, পরবর্তী প্রজন্মকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পাঠ্য দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করে, কোনটা আসল? শিক্ষকরা নীরব থাকে, অভিভাবকরাও দ্বিধায় পড়ে। এই অস্থিরতা নতুন প্রজন্মের মধ্যে এক ধরনের মানসিক দূরত্ব তৈরি করছে ইতিহাসচর্চা থেকে।
সঠিক ইতিহাসের রাজনীতি না পেয়ে তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা দিন দিন ফিকে হয়ে উঠছে।রাজনীতির স্বার্থে ইতিহাস নিয়ে টানাহেঁচড়া নতুন কিছু নয়। ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ভূমিকাকে বড় করে দেখাতে চায়, আর বিরোধীরা চায় অন্য দৃষ্টিকোণকে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু নতুন প্রজন্ম রাজনীতির ভাষণ নয়, সত্যিকারের তথ্য চায়। তারা ইন্টারনেট, ডিজিটাল আর্কাইভ, আন্তর্জাতিক গবেষণা—সবখানেই খুঁজে বেড়ায় নিরপেক্ষ ব্যাখ্যা। অথচ দেশের ভেতরে যখন তারা দেখে দলীয় প্রভাবিত ইতিহাস, তখন তাদের বিশ্বাসে ফাটল ধরে। তারা মনে করে, আমাদের অতীত নিয়েও যদি এভাবে বিভ্রান্তি থাকে, তবে আমরা কাকে অনুসরণ করব?
এই হতাশার গভীর প্রভাব সব জায়গায় লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠছে। কারণ এই হতাশা কেবল মানসিক দিকেই নয়, সামাজিক দিকেও ক্ষতিকর। ইতিহাসের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হলে তরুণদের মধ্যে জাতীয় পরিচয় নিয়ে সংকট দেখা দেয়। তারা ইতিহাস থেকে অনুপ্রেরণা না নিয়ে বরং দূরে সরে যায়। মুক্তিযুদ্ধ বা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মতো সংগ্রাম তাদের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস না হয়ে বরং রাজনৈতিক বিভেদের গল্প হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তাদের মধ্যে নাগরিক দায়িত্ববোধ কমে যায়, দেশপ্রেম দুর্বল হয়। দীর্ঘমেয়াদে এটি রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ।
বাংলাদেশে ইতিহাস এখন যেন এক অদ্ভুত টানাপোড়েনের নাম। একদল জোর দিয়ে বলে, এটাই ইতিহাস, অন্যদল সমান শক্তিতে পাল্টা দেয়, না, ওটাই আসল ইতিহাস। এই দ্বন্দ্ব শুধু রাজনীতির মঞ্চে সীমাবদ্ধ নেই, বরং পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে টেলিভিশনের টকশো, এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলাফল হিসেবে নতুন প্রজন্ম ভীষণভাবে হতাশ হচ্ছে। তারা ভাবছে, ইতিহাস কি তবে আসলেই সত্য নয়? ইতিহাস কি কেবল ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দলের ব্যাখ্যা মাত্র?
ইতিহাস নিয়ে এই দ্বন্দ্বে আটকে থেকে একটি জাতি কখনোই এগোতে পারে না। ইতিহাসকে যখন দলীয় রাজনীতির হাত থেকে মুক্ত করা যাবে, তখনই তা হয়ে উঠবে জাতির শক্তির উৎস। ইতিহাস মানে শুধু অতীত নয়; এটি বর্তমানের পরিচয় ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা। সত্যকে আড়াল করে কেউ দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হয় না। তাই প্রয়োজন সত্যনিষ্ঠ, দলমুক্ত, নিরপেক্ষ গবেষণাভিত্তিক ইতিহাসচর্চা করা। যাতে আগামী প্রজন্ম গর্বভরে বলতে পারে হ্যাঁ, এটাই আমাদের ইতিহাস।
আমাদের নিজস্ব ইতিহাস নিয়ে পারস্পরিক ক্রমাগত দ্বন্দ্বে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নতুন প্রজন্ম। তারা হতাশ, বিভ্রান্ত, কখনও কখনও বিমুখ। অথচ ইতিহাস কোনো দলের নয়, এটি পুরো জাতির। ইতিহাসকে যদি দলীয় রঙে ঢেকে রাখা হয়, তবে তা তরুণ সমাজকে আগ্রহী করবে না, বরং দূরে সরিয়ে দেবে। তাই সময় এসেছে ইতিহাসকে সত্যিকার অর্থে মুক্ত করার। নিরপেক্ষ ইতিহাসচর্চাই পারে নতুন প্রজন্মকে হতাশা থেকে মুক্তি দিতে এবং তাদের মধ্যে ভবিষ্যতের জন্য দৃঢ় আশা জাগাতে।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

 

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.