-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
ক্ষুধার্ত মানুষ সর্বদা দুর্বল এবং অসহায়। তবে কখনো কখনো এই দুর্বলতাকেই রাজনৈতিক, সামরিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গাজার অনাহারী মানুষগুলো সেই ঘৃন্যতার শিকার। সেখানে অভূক্ত দুর্বল শিশু, নারী, বৃদ্ধ সবাই লাইন ধরে দাঁড়াচ্ছেন শুধু কিছু রুটি, চাল বা পানি পেতে। অথচ এই সাধারণ মানবিক চাহিদার জন্য তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হচ্ছে। সেফ দ্য চিলড্রেন ফান্ড উল্লেখ করেছে, গাজার অভূক্ত শিশুরা মরতে চায় যাতে তারা্ দ্রুত বেহেস্তে গিয়ে খাবার পেতে পারে। অনাহারী শিশুদের এই অনুভূতি ও দৃশ্য কেবল ফিলিস্তিনিদের জন্যই নয় পুরো মানবজাতির জন্য লজ্জাজনক।
ক্ষুধা হলো মানুষের সবচেয়ে প্রাথমিক চাহিদা। খাবারের অভাবে মানুষ মরিয়া হয়ে ওঠা কোনো অপরাধ নয় বরং স্বাভাবিক মানবিক প্রতিক্রিয়া। দুর্ভিক্ষে, যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা দুর্যোগে মানুষ যখন ত্রাণের আশায় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ায়, তখন তাদের চোখে আশার ঝিলিক দেখা যায়।সেই ঝিলিক নিভে গেলে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা ধ্বংস হয়। বিশ্ব ইতিহাসে দেখা যায়, দুর্ভিক্ষ বা যুদ্ধকালে বহুবার ত্রাণের জন্য ভিড় করা মানুষকে বলপ্রয়োগে দমন করা হয়েছে। আয়ারল্যান্ডের দুর্ভিক্ষ, বঙ্গীয় দুর্ভিক্ষ কিংবা আফ্রিকার নানা দুর্দশায় আমরা দেখেছি ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার দেওয়ার পরিবর্তে গুলি করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আজও গাজার মতো অঞ্চলে কিংবা পৃথিবীর অন্য সংকটময় এলাকায় ত্রাণ নিতে আসা ক্ষুধার্ত মানুষ হত্যাযজ্ঞের শিকার হচ্ছে। ইতিহাস যেন নির্মমভাবে পুনরাবৃত্ত হচ্ছে।
মানবসভ্যতার হাজার বছরের ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে, ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে ভাতের থালা সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। আর পানির বোতল সবচেয়ে মূল্যবান ধন। মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রথম সোপান হলো আহার। তাই ক্ষুধা নিবারণকে সব রাষ্ট্র, সমাজ ও সভ্যতা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করেছে। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে, যখন অসহায় মানুষ ত্রাণের লাইনে দাঁড়িয়ে কেবল কিছু খাবারের আশায় অপেক্ষা করে, তখনই তাদের দিকে ধেয়ে আসে গুলির ঝাঁঝরা। এই দৃশ্য আমাদের মানবসভ্যতাকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধই করে না, বরং লজ্জায় মাথা নত করে দেয়।
মানব ইতিহাসে এ ধরনের বর্বরতার উদাহরণ নতুন নয়। ১৭৭০ সালের বাংলার মহাদুর্ভিক্ষে কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, কারণ শাসকশ্রেণি ত্রাণে অবহেলা করেছিল। ১৯৪৩ সালের বঙ্গীয় দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষ খাদ্যের জন্য রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছিল, অথচ ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধের প্রয়োজনে চাল রপ্তানি অব্যাহত রেখেছিল। আজও গাজা উপত্যকা কিংবা আফ্রিকার বহু অঞ্চলে আমরা একই দৃশ্য দেখছি—ত্রাণের লাইনে দাঁড়ানো ক্ষুধার্থ মানুষকে সরিয়ে দিতে গুলি চালানো হচ্ছে। ইতিহাস নির্মমভাবে আবারও ফিরে আসছে, যেন মানুষ কিছুই শেখেনি।
ক্ষুধার্ত মানুষের হাতে যদি অস্ত্র না থাকে, তাদের চোখে যদি কেবল বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা থাকে, তাহলে তাদের গুলি করার মানে হলো মানবসভ্যতার মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলা। খাবারের জন্য ছুটে আসা মানুষের লাশ যদি রাস্তায় পড়ে থাকে, তাহলে সভ্যতা শব্দটি শুধু অলঙ্কার মাত্র হয়ে যায়। ইতিহাস প্রমাণ করে যে সভ্যতা ক্ষুধার্তকে রক্ষা করতে পারে না, সেই সভ্যতা টিকেও না।
২০২৫ সালের আগস্ট মাসে গাজার মানবিক পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, নারী ও শিশু—সবাই ত্রাণের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু তাদের এই মানবিক চাহিদার প্রতিদানে তারা পাচ্ছে গুলি, মৃত্যু ও অবহেলা। এই বর্বরতা কেবল ফিলিস্তিনিদের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য লজ্জার।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (UNRWA) জানাচ্ছে, গাজায় শিশুদের অপুষ্টির হার মার্চ মাসের তুলনায় ছয়গুণ বেড়েছে। ফিলিপ লাজারিনি, UNRWA কমিশনার-জেনারেল, সতর্ক করেছেন যে, এই অপুষ্টির শিকার শিশুরা যদি ত্রাণ না পায়, তাহলে তাদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি এটিকে কৃত্রিম ও পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষ হিসেবে অভিহিত করেছেন, যেখানে খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
গাজার পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। ইসরায়েলি বাহিনী গাজা সিটিতে অভিযান শুরু করেছে, যেখানে ৬০,০০০ রিজার্ভ সৈন্যকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এই অভিযানের ফলে গাজার মানবিক সংকট আরও গভীর হচ্ছে। ইউনাইটেড নেশনস এবং রেড ক্রস সতর্ক করেছে যে, খাদ্যাভাব, বাস্তুচ্যুতি এবং চিকিৎসা সেবার অভাব পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করছে।
এছাড়া, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে যে, গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী একটি পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষ বাস্তবায়ন করছে। তারা বলছে, গাজার স্বাস্থ্য, কল্যাণ এবং সামাজিক কাঠামো ধ্বংস করার জন্য খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করলেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি।
সমগ্র মানবজাতির জন্য এটি একটি বড় প্রশ্ন, আমরা কি মানবতার মুখোশ পরে অন্যের দুর্দশা উপভোগ করব, নাকি সক্রিয়ভাবে এর প্রতিকার চাইব? ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালানো, তাদের খাদ্য ও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা এগুলো মানবতার লজ্জা। এই বর্বরতার অবসান ঘটাতে হবে। ফিলিস্তিনিদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। এটি শুধুমাত্র ফিলিস্তিনিদের সমস্যা নয়, এটি সমগ্র মানবতার সমস্যা।
গাজা উপত্যকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল। দীর্ঘ সময় ধরে অবরোধ, যুদ্ধ, এবং রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে এখানে চিকিৎসা, বিদ্যুৎ, পানি ও খাদ্যের অভাব চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি এবং রোগের হার অত্যন্ত উচ্চ। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ত্রাণের জন্য লাইনে দাঁড়ায়, কখনও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খাদ্য পায়, কখনও কিছুই না পেয়ে ভুগে। অথচ দখলদার বাহিনী তাদের জীবনের ওপর লাঠি ও বন্দুক চালিয়ে মৃত্যুর ভয় দেখায়। এটি মানবজাতির জন্য এক নিন্দাজনক পরিস্থিতি।
জেনেভা কনভেনশন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইন স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে—যুদ্ধ বা সংঘাতের সময় সাধারণ মানুষকে মানবিক সহায়তা পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে। শিশু, নারী, বৃদ্ধ ও অসহায় মানুষদের নিরাপদ রাখা অপরিহার্য। অথচ গাজায় দেখা যাচ্ছে, ত্রাণবাহী যানবাহনকে বাধা দেওয়া হচ্ছে, লাইনে দাঁড়ানো মানুষকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হচ্ছে। এটি আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের উপর এই বর্বরতা মানবতার জন্য লজ্জাজনক।
ফিলিস্তিনের অনাহারী শিশুদের চোখে শুধু হতাশা। এরা প্রতিদিন ক্ষুধা ও আতঙ্কে লালিত। অনেক শিশু লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার পাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে। নারীও আক্রান্ত হচ্ছে। পরিবারে মা-বাবা, ভাইবোনরা প্রাণ হারাচ্ছে। আগষ্ট ২৩, ২০২৫ পর্যন্ত ইসরাইলি সেনাদের হাতে মোট ৬২,১০০ ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন। এজন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের নীরবতা খুব পীড়াদায়ক।যখন ফিলিস্তিনিদের ওপর এই বর্বরতা চালানো হয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শুধু উদ্বেগ প্রকাশ করে। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো মানবাধিকারের কথা বললেও বাস্তবে দখলদার শক্তিকে সমর্থন দিয়ে মানবিক সহায়তার পথ বন্ধ রাখে। ফলে ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিরা বারবার নৃশংসতার শিকার হয়। এ দ্বৈত নীতি মানবজাতির সামগ্রিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করছে।
ফিলিস্তিনের অনাহারী মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। তাদের ওপর গুলি চালানো কেবল ফিলিস্তিনের নয়, সমগ্র মানবজাতির বিরুদ্ধে অপরাধ। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, রাষ্ট্র এবং সচেতন নাগরিকদের দায়িত্ব হচ্ছে অনাহারী ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালানোকে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যা হিসেবে বিচার করতে হবে। গাজার ত্রাণপথ অবাধ করতে হবে এবং মানবিক করিডর নিশ্চিত করতে হবে। শক্তিধর রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থা যারা নীরবে সমর্থন করে, তাদের দায়ী করতে হবে। ক্ষুধার্ত মানুষদের নিরাপত্তা ও খাদ্য পৌঁছানোকে মার্কিন-ইসরাইল দুষ্ট সামরিক নীতি বলয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
ফিলিস্তিনের অনাহারী মানুষদের লাইনে দাঁড়ানো মানেই আজ মৃত্যুর ঝুঁকি। তাদের ওপর গুলি চালানো হলো মানবতার সর্বোচ্চ লজ্জা। সভ্যতা যদি সত্যিই বাঁচতে চায়, তবে আজই এই বর্বরতার অবসান ঘটাতে হবে। একজন শিশু বা নারী ক্ষুধার্ত হওয়ার অপরাধী নয়। অথচ তাদের জীবনের ওপর হামলাকে রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে ট্রাম্পের দোসর নেতানিয়াহু গংরা। এ দৃশ্য বিশ্বের সবার চোখে মানবতার কলঙ্ক। তারপরও কোনমুখে ট্রাম্প ছয়টি যুদ্ধ বন্ধ করেছেন বলে বাগাড়ম্বর করেন? হঠকারী ও যুদ্ধবাজ ট্রাম্পের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পাওয়াটা বিশ্বমানবতার জন্য আরেক কালিমা লেপনের অধ্যায় শুরু করতে পারে।
ফিলিস্তিনিদের হাতে পৌঁছাতে হবে রুটি, গুলি নয়। গাজায় মানবতার জয় নিশ্চিত করতে না পারলে, মানবসভ্যতা নামের কোনো অর্থ থাকবে না। এই পৃথিবীতে ক্ষুধার্তদের উপর অসভ্যতা ও বর্বরতার এই ধারাবাহিকতা যদি থামে না, তবে মানবসভ্যতার উপর স্থায়ী কলঙ্ক চেপে বসে সর্বশেষ নৈতিক দিকও বিলীন হয়ে যাবে।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]