-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতির ইতিহাসে ডাকসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) এক অতি গুরুত্বপূর্ণ নাম। এই সংসদ শুধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জায়গা নয় বরং জাতীয় রাজনীতিতেও একসময় নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু দীর্ঘদিনের স্থবিরতা, নির্বাচনবিহীন অবস্থা, আর ছাত্র-রাজনীতির নামে দলীয় কোন্দল ডাকসুর ভাবমূর্তিকে ম্লান করে দিয়েছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে ২০২৫ সালে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন করে আলোচনার ঝড় উঠেছে। নানা রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠন এবার একাত্ম হয়ে দাবি তুলছে ডাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের জন্য একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে।
ডাকসু নির্বাচন শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়। এটি শিক্ষার্থীদের মতামত, চাহিদা, উদ্বেগ এবং স্বপ্নের প্রতিফলন। আজকের শিক্ষার্থীরা শুধু ক্যাম্পাস-ভিত্তিক সমস্যা নয় বরং জাতীয় জীবনের সংকট, বেকারত্ব, দুর্নীতি, শিক্ষার মানহীনতা, গবেষণার অপ্রতুলতা ও ছাত্র-নিরাপত্তার মতো বিষয় নিয়েও সরব।
কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে ডাকসু অনেক সময় জাতীয় রাজনৈতিক দলের শাখা অফিসে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের স্বার্থ উপেক্ষিত থেকে দলীয় স্বার্থই প্রাধান্য পেয়েছে। এর ফলে প্রকৃত শিক্ষার্থীদের আস্থা কমেছে, অংশগ্রহণও সীমিত হয়েছে। তাই ২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে একটি মৌলিক পরিবর্তন জরুরি।
এজন্য সবদলের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান এখানে গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন, যারা ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী, তারা যদি শিক্ষার্থীদের মৌলিক স্বার্থে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে তবে ডাকসু আবার তার হারানো গৌরব ফিরে পেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ক্যাম্পাসে সহিংসতা রোধ, শিক্ষার মান উন্নয়ন, গবেষণা খাতে বাজেট বৃদ্ধি, লাইব্রেরি ও ল্যাবের আধুনিকীকরণ, নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি—এসব বিষয় নিয়ে যৌথ দাবিনামা তৈরি করা যেতে পারে।
ডাকসুর নেতৃত্ব যদি এবার প্রকৃতই শিক্ষার্থীদের হাতে যায় তাহলে তাদের কণ্ঠস্বর জাতীয় সংসদ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সব সময়ই বাংলাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতির পথপ্রদর্শক। সুতরাং ডাকসু নির্বাচনে সকলে যদি শিক্ষার্থীদের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে আওয়াজ তোলে তবে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীও তার ইতিবাচক প্রভাব অনুভব করবে।
তবে এ ঐক্য কেবল স্লোগান বা নির্বাচনী কৌশলে সীমাবদ্ধ থাকলে কোনো সুফল মিলবে না। কার্যকর পরিবর্তন আনতে হলে সৎ নেতৃত্ব, স্বচ্ছ ভোটপ্রক্রিয়া, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, নির্বাচিত নেতাদের জবাবদিহি থাকতে হবে। ছাত্রসংসদ নির্বাচিত হয়ে যদি আবার দলীয় পদ-পদবীর সিঁড়ি হয়ে যায়, তবে শিক্ষার্থীদের আস্থা ফেরানো সম্ভব হবে না।
ডাকসু নির্বাচন ২০২৫ তাই একটি নতুন সূচনার সুযোগ। এ নির্বাচনের মাধ্যমে যদি ছাত্ররাজনীতিতে ইতিবাচক ধারা তৈরি হয় তবে তা বাংলাদেশের সামগ্রিক গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে।
আজ যখন দেশ একদিকে অর্থনৈতিক সংকট, অন্যদিকে বেকারত্ব ও সামাজিক বৈষম্যের চাপে ক্লান্ত, তখন শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বরই হতে পারে আশার আলো। ডাকসু নির্বাচন সেই আলো জ্বালানোর এক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। একাত্ম হয়ে সবদল যদি সত্যিই শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কাজ করে তবে ২০২৫-এর ডাকসু নির্বাচন প্রমাণ করবে—শিক্ষার্থীরা শুধু রাজনীতির পেছনের শক্তি নয়, তারা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার মূল চালিকাশক্তি।
একসময় জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়ে উঠত এই ডাকসুর প্ল্যাটফর্মে। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় তিন দশক নির্বাচনবিহীন থাকার কারণে এর ভূমিকা প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। অবশেষে ২০১৯ সালে নির্বাচন হলেও নানা অনিয়ম, সহিংসতা ও প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতায় সেই ডাকসু শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। এই প্রেক্ষাপটে ২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা অনেক বেশি।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ ছিল নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দু। ডাকসুর নেতারা তখন শুধু ছাত্ররাজনীতির গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তাঁরা জাতীয় ইস্যুতে উচ্চকণ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন—সবক্ষেত্রেই ডাকসুর নেতাদের ভূমিকা ছিল গৌরবময়। এই ইতিহাসই প্রমাণ করে, ডাকসু নির্বাচন কোনো সাধারণ ক্যাম্পাস-ইভেন্ট নয়। এটি দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের ভিত্তি রচনা করতে পারে।
১৯৯০ সালের পর দীর্ঘ প্রায় ২৮ বছর ডাকসুতে নির্বাচন হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের নেতৃত্ব বাছাই করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। এ সময় ডাকসু ভবন নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে, কেবল স্মৃতিচিহ্ন হিসেবেই দাঁড়িয়ে ছিল। ২০১৯ সালে নির্বাচনের আয়োজন করা হলেও অনিয়ম, কারচুপি, ভীতি প্রদর্শন, প্রশাসনিক পক্ষপাত ও ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘাতের কারণে সেই নির্বাচন প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। অনেকেই বলেছিলেন, এটি ছিল একটি হারানো সুযোগ। তাই ২০২৫ সালের নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের নতুন প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে।
আজকের শিক্ষার্থীদের সমস্যা কেবল আবাসন সংকট, সেশনজট বা লাইব্রেরির বইয়ের অভাবেই সীমাবদ্ধ নয়। তাঁদের জীবনের বড় সংকট হলো বেকারত্ব, মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণার ঘাটতি, বিদেশে পড়াশোনার সুযোগের সীমাবদ্ধতা, টিউশন ফি বৃদ্ধির চাপ, এবং সর্বোপরি ক্যাম্পাসে নিরাপত্তাহীনতা। নারী শিক্ষার্থীদের হয়রানি, মাদক ও সহিংসতা, ক্যাম্পাসে দখলদারিত্ব—এসব সমস্যা শিক্ষার্থীদের জন্য দুঃসহ বাস্তবতা তৈরি করছে। এই অবস্থায় শিক্ষার্থীরা একটি কার্যকর প্রতিনিধি সংসদ চান, যেখানে তাদের কণ্ঠস্বর শোনা হবে এবং সমস্যার সমাধান হবে।
২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন ও রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন সংগঠন তাদের দলীয় অবস্থান বজায় রেখেও শিক্ষার্থীদের মৌলিক সমস্যায় একমত হয়ে একসঙ্গে আওয়াজ তুলেছে। গত ২ সেপ্টেম্বর একটি রিটের রায়ের বিরুদ্ধে সবাই একসংগে গর্জে উঠা তার প্রমাণ ছিল।তারা সবাই একবাক্যে নির্বাচন হোক সেটাই চায়।
তাহলে এর মাধ্যমে প্রাধান্য পাবে শিক্ষার মান উন্নয়ন ও গবেষণা বাজেট বৃদ্ধি করা, লাইব্রেরি, ল্যাব ও আইটি সুবিধা আধুনিকীকরণ, নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও হয়রানিবিরোধী কঠোর ব্যবস্থাকরণ, আবাসন সংকট নিরসন ও হল ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনয়ন, টিউশন ফি নিয়ন্ত্রণ ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি, মাদক ও সহিংসতামুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা এবং প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা সহায়ক ব্যবস্থাকরা, ইত্যাদি।
আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে ডাকসু সব সময়ই গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাই ২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচনও কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে অন্য সব ক্যাম্পাসে, এমনকি জাতীয় পর্যায়ে। যদি শিক্ষার্থীরা দেখাতে পারেন যে তাঁরা একাত্ম হয়ে নিজেদের দাবি তুলে ধরতে পারেন, তবে সেটি দেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে।
শিক্ষার্থীরা আজ নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি। শিক্ষা খাতে গবেষণা ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধার অভাব, সেশনজট, আবাসন সংকট, মাদক ও সহিংসতার দাপট, নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাহীনতা, উচ্চশিক্ষার ব্যয়বৃদ্ধি, বেকারত্ব—এসব সমস্যা তাদের ভবিষ্যতকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলছে। অথচ শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বের নামে যে ছাত্রসংগঠনগুলো সক্রিয়, তারা প্রায়শই জাতীয় রাজনৈতিক দলের শাখা সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের আসল স্বার্থ চাপা পড়ে গিয়েছে।
এবারের ডাকসু নির্বাচনের পর সবদলের একাত্ম থাকাটা নির্ভর করবে তাদের কর্মপদ্ধতি ও লক্ষ্য স্পষ্ট করার ওপর। যদি তারা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি লিখিত সনদ বা চার্টার তৈরি করে, নিয়মিত মতবিনিময় সভা, কর্মশালা, নীতি-আলোচনা চালু রাখে, স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব নির্বাচন করে ওশিক্ষার্থীদের বাস্তব সমস্যায় নিরলসভাবে কাজ করে। তাহলে সবাই একাত্ম থেকে একটি শক্তিশালী শিক্ষার্থী আন্দোলনের ভিত্তি হতে পারে। এমনকি এটি ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতিতে নতুন ধরনের সৎ ও গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের উৎসও হতে পারে।
শিক্ষার্থীরা চায় না যে তাদের ভবিষ্যত দলীয় রাজনীতির খেলায় বন্দি হয়ে থাকুক। তারা চায় শিক্ষা, নিরাপত্তা, গবেষণা ও চাকরির নিশ্চয়তা। যদি এই ঐক্য প্রকৃত অর্থে সেই চাহিদার প্রতিনিধিত্ব করে, তবে এর ভবিষ্যত উজ্জ্বল। তবে দলীয় প্রভাব, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব এবং প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা যদি কাটিয়ে উঠতে না পারে, তবে এটিও হয়তো কেবল একটি ক্ষণস্থায়ী আন্দোলন হিসেবেই স্মৃতিতে থেকে যাবে।
শিক্ষার্থীদের সবার একাত্ম থাকার ভবিষ্যত তাই নির্ভর করছে অন্তরের দৃঢ়তা, নেতৃত্বের সততা এবং সর্বোপরি গণতান্ত্রিক চর্চার ওপর। যদি তারা তা প্রমাণ করতে পারে তবে শিক্ষার্থীদের জন্য এই ঐক্য হতে পারে একটি ঐতিহাসিক বাঁকবদল।এবারের ডাকসুতে শিক্ষার্থীদের জন্য সবদলের একাত্ম হয়ে সমস্বরে আওয়াজ তোলা সফল হোক।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]