বুধবার | ৮ অক্টোবর, ২০২৫ | ২৩ আশ্বিন, ১৪৩২

নির্বাচন: বডি ক্যামেরা কি অনৈতিকতা ঘোচাবে?

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছেন আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে প্রায় চল্লিশ হাজার বডি ক্যামেরা ব্যবহার হবে। যুক্তি হলো্, এতে প্রিজাইডিং অফিসার থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ভোটগ্রহণকারীদের কার্যক্রম রেকর্ড থাকবে, অনিয়ম কমবে, স্বচ্ছতা বাড়বে। প্রযুক্তির এই অগ্রগতি কাগজে-কলমে প্রশংসনীয়, কিন্তু প্রশ্ন হলো বডি ক্যামেরা কি সত্যিই মন ক্যামেরা-র অভাব পূরণ করতে পারবে?
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার আসল শক্তি হলো মানুষের নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ ও সাহস। ক্যামেরা যতই উন্নত হোক, যদি মন সৎ না হয়, তবে ফুটেজ কেবল ঘটনার প্রমাণ হয়ে পরে দেখা যাবে, কিন্তু ঘটনার প্রতিরোধ হবে না। অতীতে দেখা গেছে, বিভিন্ন নির্বাচনে সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক বা সাধারণ মানুষের ক্যামেরায় অনিয়ম ধরা পড়লেও বিচার হয়নি, দায়ীদের শাস্তি হয়নি। বরং অনেক সময় ফুটেজই হারিয়ে গেছে বা অপ্রাসঙ্গিক বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাহলে শুধু প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে কি গণতন্ত্রের আস্থা পুনরুদ্ধার সম্ভব?
বডি ক্যামেরা মূলত একটি যান্ত্রিক চোখ। এটি যা দেখে তাই রেকর্ড করে। কিন্তু নির্বাচনকালে অসংখ্য ঘটনা ঘটে ক্যামেরার ফ্রেমের বাইরে চাপ, ভয়ভীতি, ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পথে হামলা, বা আগেই ব্যালট বাক্স ভরে ফেলা। এসব ধরা পড়ে না। মন ক্যামেরা—মানে অন্তরের সততা ও ন্যায়বোধ থাকলেই কেবল একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, একজন পুলিশ সদস্য, কিংবা একজন ভোটগ্রহণকারী সাহস করে অনিয়ম প্রতিরোধে দাঁড়াতে পারেন।
এখানে আরেকটি বাস্তবতা আছে তা হলো প্রযুক্তির অপব্যবহার। যদি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকে একই কর্তৃপক্ষের হাতে, তবে তা প্রমাণ গোপনের হাতিয়ারও হতে পারে। বডি ক্যামেরা চালু হলো বটে, কিন্তু যদি রেকর্ড বন্ধ করে দেওয়া যায় ইচ্ছেমতো, বা সংরক্ষিত ফুটেজ প্রকাশ না করা হয় তবে পুরো প্রকল্পের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে।
আসলে গণতান্ত্রিক শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন দ্বিমুখী উদ্যোগ, প্রযুক্তিগত স্বচ্ছতা ও মানবিক সততা। প্রথমটি কেনা যায়, দ্বিতীয়টি গড়ে তুলতে হয়। বডি ক্যামেরা কেনার জন্য বাজেট বরাদ্দ হয় একবারে, কিন্তু মন ক্যামেরা তৈরি করতে ধারাবাহিক শিক্ষা, জবাবদিহিতা, আইনের শাসন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি।
মানবসভ্যতার বিবর্তন শুধু প্রযুক্তি, স্থাপত্য কিংবা বিজ্ঞানেই ঘটেনি।এর গভীরে রয়েছে আস্থা ও অবিশ্বাসের লড়াই। ইতিহাসে যতই পেছনে যাওয়া যায়, দেখা যায়, নিরাপত্তার প্রয়োজনে মানুষ নতুন নতুন ব্যবস্থা নিয়েছে; কিন্তু এর উৎস প্রায় সব সময়ই একই ভয় এবং সন্দেহ।
প্রথম যুগে মানুষের বাসস্থান ছিল গুহা, খোলা মাঠ বা জঙ্গল। নিরাপত্তা তখন আসত সমাজ বা গোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ শক্তি থেকে। বাইরে থেকে কেউ আক্রমণ করলে দল মিলে প্রতিরোধ করা যেত। কিন্তু সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি ও পরিবারের আলাদা মালিকানা শুরু হলো নিজস্ব ঘর, নিজের সম্পদ, নিজের গোপনতা। এই গোপনতার সীমানা টানতেই জন্ম নিল দরজা। এটি ছিল প্রথম প্রতিরক্ষার দেয়াল, বাইরের জনকে থামিয়ে দেওয়ার প্রতীক।
কিন্তু দরজা একাই যথেষ্ট হলো না। মানুষ বুঝল, দরজা ভাঙা যায়, খোলা যায়। তাই এল তালা ও চাবি যা কার্যত শারীরিক বাধা এবং নির্বাচিত প্রবেশাধিকার। তালা যুক্ত করল আরেকটি সামাজিক বার্তা, ‘আমি তোমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করি না।’ অবিশ্বাস এখানে ব্যক্তি পর্যায়ের হলেও এর ভিত্তি ছিল সামাজিক যত বেশি সম্পদ ও বৈষম্য, তত বেশি তালাচাবির চাহিদা।
সময়ের সঙ্গে নিরাপত্তার এই ধাপ দৃশ্যমান সুরক্ষা থেকে প্রমাণ-ভিত্তিক সুরক্ষায় রূপ নেয়। এলো ক্যামেরা। শুরুতে ক্যামেরা ছিল আনন্দ, স্মৃতি আর শিল্পের জন্য; কিন্তু অপরাধ ও প্রতারণা বাড়তে থাকলে এটি হয়ে উঠল নজরদারির যন্ত্র। মানুষ ভাবল—যদি চোখে দেখা যায়, তবে অপরাধ কমবে। কিন্তু ক্যামেরা কেবল ঘটনাটি রেকর্ড করে, এটি অপরাধ থামায় না।
এই সীমাবদ্ধতা দূর করার চেষ্টা হিসেবে এলো সিসিটিভি। যেটাস্থায়ীভাবে স্থাপন করা, নীরব প্রহরী। এর সুবিধা হলো এটি নিরবচ্ছিন্নভাবে নজর রাখে। সরকার, প্রতিষ্ঠান, এমনকি ব্যক্তিও মনে করল নজরদারির আওতা যত বিস্তৃত হবে, অপরাধ তত কমবে। কিন্তু বাস্তবতা দেখিয়েছে অপরাধ সিসিটিভির সামনেও ঘটে, আর ফুটেজ প্রমাণ হলেও তা বিচার নিশ্চিত করে না। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধী শক্তিশালী হলে ফুটেজ হারিয়ে যায় বা প্রকাশই হয় না।
সবশেষে এলো মোবাইল বডি ক্যামেরা একটি চলমান, নিকটবর্তী এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক নজরদারির ব্যবস্থা। পুলিশের গায়ে, ট্রাফিক কনস্টেবলের কাঁধে, নির্বাচনকর্মীর জামায় ঝুলে থাকা এই ক্যামেরা বাস্তব সময়েই রেকর্ড করে, প্রমাণ রাখে। যুক্তি হচ্ছে এতে জবাবদিহি বাড়বে। কিন্তু এখানে একই পুরনো প্রশ্ন ফিরে আসে যে প্রতিষ্ঠান ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ করে, তার সদিচ্ছা না থাকলে এই প্রযুক্তি কি কেবল আরেকটি আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়াবে না?
এই পাঁচ ধাপের বিবর্তন দরজা, তালা, ক্যামেরা, সিসিটিভি, বডি ক্যামেরা একটি গভীর সামাজিক রূপান্তরের ইঙ্গিত দেয়। আমরা বিশ্বাসের সমাজ থেকে ধীরে ধীরে নজরদারির সমাজে পৌঁছেছি। আগে মানুষের সততা ছিল সুরক্ষার মূল ভিত্তি; এখন প্রযুক্তি তার স্থান নিয়েছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, অতিরিক্ত নজরদারি সামাজিক সম্পর্কের স্বতঃস্ফূর্ত আস্থা ধ্বংস করে দেয়, কারণ এতে মানুষ মনে করে, আমাকে বিশ্বাস করা হচ্ছে না।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এই বিবর্তনের প্রভাব স্পষ্ট। নির্বাচনের সময় বডি ক্যামেরা বা সিসিটিভি স্থাপন করে স্বচ্ছতা বাড়ানোর দাবি তোলা হয়, কিন্তু তা অনেক সময় ভোটারের আস্থা ফেরাতে ব্যর্থ হয়। কারণ ভোটের ন্যায়পরায়ণতা প্রযুক্তি নয়, মূলত মানুষের নৈতিকতা ও জবাবদিহির উপর নির্ভরশীল। প্রযুক্তি প্রমাণ রাখতে পারে, কিন্তু সৎ মনই পারে অনিয়ম ঠেকাতে।
অতএব, দরজা থেকে শুরু করে বডি ক্যামেরা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ একদিকে আমাদের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির নিদর্শন, অন্যদিকে সামাজিক অবিশ্বাসের ইতিহাস। আমরা যতই উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলি না কেন, যদি ভেতরের সততা, আইনপ্রয়োগের আন্তরিকতা ও পারস্পরিক আস্থা হারিয়ে যায়, তবে এই সব ব্যবস্থা কেবল শীতল লোহার প্রাচীর হয়ে থাকবে, যার ভেতরে মানুষ থাকবে নিরাপদ নয়, বরং অবিশ্বাসে বন্দি।
মানবসভ্যতার ইতিহাস মূলত আস্থা ও অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলে চলা এক দীর্ঘ কাহিনি। একসময় মানুষ ঘরে ঢুকতে বাঁশের বেড়া সরিয়ে দিত, খোলা আঙিনায় অতিথি-অতিথি সবাই বসে যেত। কিন্তু ধীরে ধীরে বাস্তবতা বদলেছে, আস্থা ক্ষয়ে গেছে, অবিশ্বাস বেড়েছে। এর ফলেই দরজার জন্ম। ২১শ শতকে এই বিবর্তন ত্বরান্বিত করল সিসিটিভি। এটি এমন এক নীরব প্রহরী, যে সারাক্ষণ চোখ মেলে থাকে। রাস্তা, বাজার, ব্যাংক, অফিস সবখানে তার উপস্থিতি। মানুষ এখন জানে, সে দেখা হচ্ছে, রেকর্ড হচ্ছে। কিন্তু এখানে আবারও সেই একই প্রশ্ন দেখা হচ্ছে মানেই কি নিরাপত্তা নিশ্চিত? অনেক অপরাধ তো সিসিটিভির সামনেই হয়, এবং ফুটেজ থেকেও বিচার হয় না।
মোবাইল বডি ক্যামেরা যেন চলমান চোখ। দরজা, তালচাবি, ক্যামেরা, সিসিটিভি, বডি ক্যামেরা সবই একই বিবর্তনের ধাপ, যার কেন্দ্রে আছে, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না, তাই নজর রাখতে চাই মানসিকতা। এগুলো আমাদের নিরাপত্তা দেয়, কিন্তু একই সঙ্গে প্রমাণ করে আমরা বিশ্বাসের সমাজ থেকে নজরদারির সমাজে প্রবেশ করেছি। উন্নতবিশ্ব অনেক যুগ আগে এসব আবিষ্কার ও ব্যবহার শুরু করলেও নির্বাচনে নজরদারির কাজে ব্যবহার করেনি।তারা নিজেদের অন্তরের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাসের বিষয়টি সামাজিক শিক্ষার মাধ্যমে উৎরে যেতে পেরেছে। আমরা সেটা এখনও পারিনি।
চল্লিশ বছর আগেকার কথা। আমার বিদেশের শিক্ষাজীবনের একটি বাস্তব ঘটনা থেকে বলছি।
জাপানের এক গবেষণাগারে কাটানো কিছুদিনের স্মৃতি আজও আমার মনে আছে । সেখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় একদিন সহপাঠীর সামনে অভ্যাসবশত ড্রয়ারে তালা লাগালাম। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি চাবি দিচ্ছো কেন?’ আমি বললাম, নিরাপত্তার জন্য। সে হেসে উত্তর দিল, ‘আমরা ড্রয়ারে চাবি দিই না। চাবি দিলে পাশেরজনকে সন্দেহ করা হয় মাত্র’। আমার সেদিন একটি গভীর সামাজিক শিক্ষা হলো। সেই মুহূর্তে বুঝলাম, নিরাপত্তার চাবি অনেক সময় আস্থার দরজাই বন্ধ করে দেয়।
জাপানের ল্যাবে ড্রয়ার খোলা রাখা ছিল আস্থার প্রতীক। কেউ ভাবতো না, আমার খাতা, কলম চুরি হবে। অথচ আমাদের নির্বাচনে ক্যামেরা চালু রাখতেই হয়। কারণ ভয়, আমারটা ভোট চুরি হবে। পার্থক্যটা প্রযুক্তির নয়, সংস্কৃতির।
প্রশ্ন হলো, আমরা কি ক্যামেরা দিয়ে আস্থা তৈরি করতে পারি? উত্তর স্পষ্ট—না। আস্থা আসে আচরণ থেকে, ন্যায়বোধ থেকে, জবাবদিহি থেকে। যত দিন না আমরা ভোটের পরিবেশ এমন করতে পারি যেখানে ক্যামেরা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে, তত দিন এই প্রযুক্তি কেবল দেখাবে আমাদের গণতন্ত্রে চাবি নেই, আছে শুধু সন্দেহের তালা।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.