শুক্রবার | ৩ অক্টোবর, ২০২৫ | ১৮ আশ্বিন, ১৪৩২

নোবেলের মোহে ট্রাম্প ও গাজায় টনির অন্তবর্তী প্রস্তাব

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে নাটকীয় চরিত্রের অভাব নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বহুমুখী রূপ পাল্টানোর রাজনীতিক বিরল। ট্রাম্পকে সাধারণত: আমরা চিনি একরোখা, জেদি, ক্ষমতালোভী ও আমেরিকা ফার্স্ট স্লোগানের মাধ্যমে বৈশ্বিক রাজনীতিতে ধাক্কা দেওয়া এক নেতারূপে। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে তিনি এমন এক শান্তির দূত সাজার চেষ্টা করছেন, যার আড়ালে সুস্পষ্টভাবে লুকিয়ে আছে নোবেল শান্তি পুরস্কারের লোভ।
ট্রাম্পের এই রূপান্তর কোন কাকতালীয় ব্যাপার নয়। তিনি একাধিকবার প্রকাশ্যে বলেছেন তাঁর মতো শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ আর কেউ করেনি, অথচ নোবেল কমিটি তাঁকে যথাযথ সম্মান দেয়নি। একসময় মধ্যপ্রাচ্যের তথাকথিত আব্রাহাম অ্যাকর্ডস কিংবা উত্তর কোরিয়ার কিম জং-উনের সঙ্গে বৈঠককে পুঁজি করে তিনি নোবেলের দাবি তুলেছিলেন। এখন গাজায় রক্তপাত চলমান অবস্থায় হঠাৎই তিনি পশ্চিম তীর দখল নিয়ে ইসরাইলেকে হুঁশিয়ার করে বিবৃতি দিয়েছেন।নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাদারণ পরিষদের বৈঠকের মধ্যে তিনি ইসরাইলকে নিয়ে সমালোচনা করছেন যা রহস্যজনক।
বিশ্লেষকগণ মনে করছেন এটা ট্রাম্পের আরেক ভাঁওতাবাজি। তিনি শান্তি, অস্ত্রবিরতি এবং অন্তবর্তী সমাধানের মতো শব্দ ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। যেন হঠাৎ এক রূপকথার নায়ক, যিনি বন্দুক নামিয়ে কলম হাতে নিতে চান। কিন্তু বিশ্ব জানে, তাঁর রাজনৈতিক অস্তিত্বের কেন্দ্রে রয়েছে স্বার্থ, চমক সৃষ্টি আর ব্যক্তিগত গৌরবলাভের তৃষ্ণা। এত তাঁর নোবেলের প্রতি াতি আশা ও লোভ দুটোই প্রকাশিত হয়ে পড়েছে গোটা বিশ্ববাসীর চোখে।
অন্যদিকে টনি ব্লেয়ার গাজায় এক অন্তবর্তী প্রশাসনের প্রস্তাব দিয়েছেন।এর উদ্দেশ্য অবরুদ্ধ গাজার ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে ন্যূনতম শৃঙ্খলা, মানবিক সহায়তা ও প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠন করা। দীর্ঘদিন ধরে হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের রক্তক্ষয়ী সংঘাত যে ধ্বংসযজ্ঞ বয়ে এনেছে, তা সামলাতে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এখন জরুরি। ইইউ মনে করে, অন্তবর্তী একটি নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলা গেলে মানবিক বিপর্যয় কিছুটা হলেও ঠেকানো যাবে, এবং শান্তি আলোচনার জন্য ভূমি প্রস্তুত হবে।
ইকোনমিস্ট এবং বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রস্তাবিত ‘গাজা আন্তর্জাতিক ট্রানজিশনাল অথরিটি’ নামে এই প্রশাসন জাতিসংঘ এবং উপসাগরীয় দেশগুলোর সমর্থনে থাকবে। ব্লেয়ার ফিলিস্তিনিদের কাছে নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত এই শাসনব্যবস্থা তত্ত্বাবধান করবেন।’
প্রতিবেদনে জানা গেছে ‘এই অন্তর্বর্তী প্রশাসন পাঁচ বছরের জন্য গাজার সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ও আইনি কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করার জন্য জাতিসংঘের আদেশ চাইবে। পরিকল্পনাটি পূর্ব তিমুর এবং কসোভোতে রাষ্ট্রীয় রূপান্তরের তত্ত্বাবধানকারী আন্তর্জাতিক প্রশাসনের আদলে তৈরি করা হবে। প্রথমে তারা গাজার দক্ষিণ সীমান্তের কাছে মিশর থেকে কাজ করবে এবং পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ার পরে একটি বহুজাতিক বাহিনীর সহায়তায় উপত্যকায় চলে যাবে।’
তবে গভীর চিন্তা হচ্ছে এই অন্তবর্তী প্রশাসন কার অধীনে চলবে? কে এর বৈধতা দেবে এবং সর্বোপরি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র কি তা মেনে নেবে? টনি ব্লেয়ারের প্রস্তাব নিঃসন্দেহে মানবিকতা নির্ভর। কিন্তু বাস্তব রাজনীতির খেলায় এমন প্রস্তাব কতটা টেকসই হবে তা নিয়েই সংশয় রয়েছে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির আঙিনায় আজকাল দুই পরিচিত মুখ নতুন রূপে আবির্ভূত হচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও টনি ব্লেয়ার। একজন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট, যিনি নিজের রাজনৈতিক জীবনকে বেশী করে আলোয় আনতে নোবেল শান্তি পুরস্কারের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছেন। আরেকজন ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী যিনি ইরাক যুদ্ধের পর যুদ্ধবাজ পরিচয়ে সমালোচিত হলেও এখন গাজায় অন্তবর্তী প্রশাসনের প্রস্তাব দিয়ে শান্তির দূত সাজার চেষ্টা করছেন।
ট্রাম্পকে আমরা চিনি শক্তির রাজনীতির এক প্রতীক হিসেবে। তাঁর আমলেই ওয়াশিংটন একপেশেভাবে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছিল। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, দূতাবাস সরিয়ে নেওয়া, ফিলিস্তিনিদের সহায়তা কমিয়ে দেওয়া সবই ছিল তাঁর প্রেসিডেন্সির উপলব্ধি। অথচ আজ তিনি শান্তি, অস্ত্রবিরতি আর সমঝোতার ভাষা বলছেন। কারণ, তাঁর রাজনৈতিক পুনরুত্থান ও ব্যক্তিগত গৌরবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নোবেল শান্তি পুরস্কারের অদম্য আকাঙ্ক্ষা। তিনি মনে করেন, উত্তর কোরিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে তাঁর প্রচেষ্টা তাঁকে পুরস্কার এনে দেওয়ার কথা ছিল। তাই আবারও নতুন রূপে হাজির হয়ে বিশ্বকে বোঝাতে চাইছেন তিনি শান্তির দূত।
কিন্তু গাজার মাঠে এই কূটনৈতিক খেলা আজ একটি মুখোশ মাত্র। গাজা আজ ধ্বংসস্তূপ। ভাঙা ঘরবাড়ি, মরদেহে ভরা রাস্তা, খাদ্য ও ওষুধের তীব্র সংকট। জাতিসংঘ বলছে, গাজার অর্ধেক মানুষ বাস্তুচ্যুত। শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে, হাসপাতাল ভেঙে পড়ছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে শুধু ট্রাম্পের নোবেলপিয়াসী লোভ নয়, পশ্চিমা বিশ্বের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ।
এমন সময় টনি ব্লেয়ার সামনে এসেছেন গাজায় এক অন্তবর্তী প্রশাসনের প্রস্তাব নিয়ে। তাঁর মতে, ফিলিস্তিনে একটি নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলা গেলে মানবিক সাহায্য সহজ হবে, শৃঙ্খলা ফিরবে, আর ভবিষ্যতে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথ খুলবে। শুনতে নিঃসন্দেহে যুক্তিসঙ্গত ও মানবিক। কিন্তু এই প্রস্তাবের আড়ালে ইতিহাসের তিক্ত স্মৃতি চাপা পড়ে না।
টনি ব্লেয়ার সেই নেতা, যিনি ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গী হয়ে লক্ষ প্রাণহানির দায় নিজের কাঁধে তুলেছিলেন। তখনো তিনি বলেছিলেন, তাঁর অবস্থান মানবিকতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। অথচ ফল হয়েছিল উল্টো। মধ্যপ্রাচ্যে বিশৃঙ্খলা, আইএস-এর উত্থান ও কোটি শরণার্থীর দুর্দশা। আজ সেই ব্লেয়ার আবার শান্তির প্রস্তাব দিচ্ছেন। মানুষ তাই প্রশ্ন তোলে এটা কি সত্যিই মানবিকতা, নাকি রাজনৈতিক পুনর্বাসনের আরেক খেলা?
ব্লেয়ারের প্রস্তাবকে ঘিরে রয়েছে নানা প্রশ্ন। যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত গাজায় কে এই অন্তবর্তী প্রশাসন চালাবে? সেটি চালাবে কি নতুন ফিলিস্তিনি অথরিটি, জাতিসংঘ, নাকি পশ্চিমা কোনো মডেল? এই অন্তবর্তী প্রশাসনকে ইসরায়েল কিভাবে মেনে নেবে, নাকি এটিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইবে? ফিলিস্তিনি জনগণ কি টনি ব্লেয়ারের মতো বিতর্কিত মুখের প্রস্তাবে আস্থা রাখবে?
এখানে দেখা যায়, ট্রাম্প যেমন নোবেলের লোভে শান্তির কথা বলেন, ব্লেয়ারও নিজের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি মেরামতের জন্য প্রস্তাব দেন। অথচ গাজার মানুষের আসল প্রয়োজন আবাসন, খাদ্য, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা।
গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠা কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষের উপর নির্ভর করে না। নোবেলের লোভে ট্রাম্পের ভোল পাল্টানো কিংবা টনি ব্লেয়ারের অন্তবর্তী প্রশাসনের প্রস্তাব, এসব আন্তর্জাতিক রাজনীতির দ্বিচারিতা ছাড়া আর কিছু নয়। ফিলিস্তিনিদের শান্তি কেবল বাহ্যিক পুরস্কার বা প্রস্তাব থেকে আসবে না। সেটি আসবে ন্যায়ভিত্তিক সমাধান, দখলমুক্ত ভূমি ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থেকে।
অতএব রহস্য থেকে যায় এই শান্তির আসল রূপ কে দেখাবে? ট্রাম্পের নোবেললোভী কৌশল, ব্লেয়ারের প্রস্তাব, নাকি ফিলিস্তিনি জনগণের দীর্ঘ সংগ্রাম? কারণ ইতিহাস বলে দেয় কোন নোবেল বা বড় পুরস্কারের ঝলক নয়, রক্ত ও ত্যাগের মাধ্যমেই শান্তি টিকে থাকে।
এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের আচরণ আরও হাস্যকর। নোবেলের মঞ্চে জায়গা পেতে তাঁর নীতি, আদর্শ হঠাৎ বদলে গেছে। অথচ তাঁর আমলেই যুক্তরাষ্ট্র ছিল ফিলিস্তিন-ইসরায়েল প্রশ্নে সবচেয়ে একপেশে, ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়ানো এক শক্তিধর সমর্থক। ওয়াশিংটনে মার্কিন দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তর করা তাঁর সরকারেরই কাজ। সেই সিদ্ধান্তে ফিলিস্তিনিরা ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল, অথচ এখন তিনি শান্তি ও অন্তবর্তী প্রশাসনের ভাষা বলছেন।
রাজনীতির এই কপটতা কেবল ব্যক্তির লোভ নয় বরং বিশ্বশক্তির দ্বিচারিতার প্রতীক। নোবেল শান্তি পুরস্কারও অনেকসময় রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। ট্রাম্প তা জানেন, এবং তাই সুযোগ পেলেই তিনি শান্তির মুখোশ পরে পুরস্কারের মঞ্চে উঠতে চান।
অন্যদিকে টনি ব্লেয়ারের প্রস্তাব যদিও মানবিক দিক থেকে প্রশংসনীয় তবে বাস্তবে তা কতটা কার্যকর হবে তা নির্ভর করছে বহুপাক্ষিক সমঝোতার ওপর। ফিলিস্তিনি জনগণের নিজস্ব মতামত, আরব বিশ্বের অবস্থান, ইসরায়েলের কৌশল এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাই ঠিক করবে গাজার অন্তবর্তী প্রশাসনের ভাগ্য।
একদিকে ট্রাম্পের নোবেল লোভী কপটতা, অন্যদিকে টনি-র মানবিক প্রস্তাব দুটোই গাজা সংকটের ভিন্ন দিক উন্মোচন করে। কিন্তু মূল সত্য হলো, ফিলিস্তিনের মানুষ এখনো বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করছে, তাঁদের ঘরে আলো নেই, শিশুরা খাদ্য ও চিকিৎসাহীন। তাঁদের জন্য কোনো নোবেল নয়, প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ ও দীর্ঘস্থায়ী ন্যায়ভিত্তিক সমাধান।
শেষ পর্যন্ত রহস্য থেকে যায় শান্তির আসল রূপ কে দেবে তা নিয়ে। ট্রাম্পের ভোল পাল্টানো নাকি টনি ব্লেয়ারের অন্তবর্তী প্রশাসনের প্রস্তাব নাকি ফিলিস্তিনিদের আত্মত্যাগই আবারও প্রমাণ করবে শান্তি কখনো দান বা পুরস্কারের বিষয় নয়। শান্তি এটি অকুতোভয় মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ফসল।
× প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.