বুধবার | ১৫ অক্টোবর, ২০২৫ | ৩০ আশ্বিন, ১৪৩২

আবার আমরা যাব হাজারটা জাহাজ যাবে

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
মানবতার পক্ষে বিবেকের অঙ্গীকার নিয়ে ‘আবার আমরা যাব এবং হাজারটা জাহাজ যাবে’ দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আলোকচিত্রী জনাব শহীদুল আলম গাজা উপত্যকার ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য থেকে বাংলাদেশে ফিরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই কথাগুলো উচ্চারণ করেছেন। তাঁর কথায় ফুটে উঠেছে এক প্রতিরোধের প্রতিশ্রুতি এবং এক মানবিক অঙ্গীকার। এই একটি বাক্যে যেন সংক্ষিপ্ত হয়ে যায় সমগ্র পৃথিবীর বিবেক। যেখানে অন্যায়, বর্বরতা, দখল ও হত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
গত ১১ অক্টোবর বিকেলে রাজধানী ঢাকার দৃক পাঠ ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমন অভিজ্ঞতার কথা জানান। মরুভূমির মধ্যে ইসরায়েলের সবচেয়ে গোপনীয় কারাগারে তাদেরকে রাখা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আটক করে জাহাজ থেকে নামানোর পর তাদের ওপর অনেক ধরনের নির্যাতন করা হয়েছে। তবে এর মধ্যে মানসিক নির্যাতন বেশি করা হয়েছে। তিনি বলেন, তাদের হাত পেছনে নিয়ে বেঁধে যেখানে হাঁটুমুড়ে বসানো হয়েছিল, সেখানে ইসরায়েলি বাহিনী আগে থেকে মূত্রত্যাগ করেছিল। এরপর তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট ইসরায়েলি বাহিনী ফেলে দেয়। তিনি যতবার সেটি তুলেছেন ততবার তার ওপর চড়াও হয়েছে। সেসময় নিজেদের মধ্যে কথা বলায় অন্য দুজন সহযাত্রীকে মেশিনগানের ব্যারেল দিয়ে আঘাত করা হয়েছে।’
এছাড়া তিনি বলেছেন, ‘কারাগারে তারা অনশন করেছিলেন। কোনো খাবার খাননি। তবে শারীরিক দুর্বলতার কারণে কয়েকজন খাবার খেয়েছেন। আড়াই দিনে তাদের মাত্র এক প্লেট খাবার দেওয়া হয়। তাদের যেখানে শুতে দেওয়া হয়েছিল, তা ছিল লোহার, শৌচাগারগুলোর অবস্থাও ছিল শোচনীয়। তিনি আরও বলেন, গভীর রাতে হঠাৎ করে ইসরায়েলি বাহিনী মেশিনগান নিয়ে সেলের মধ্যে ঢুকে যেত। তারা জোরে আওয়াজ করত, চিৎকার করে দাঁড়ানো বা অন্য আদেশ দিত এবং আতঙ্ক তৈরি করার চেষ্টা করত।’
গাজা উপত্যকা যেখানে আকাশে যুদ্ধবিমান, মাটিতে ধ্বংসস্তূপ, মানুষের চোখে আতঙ্ক ও ক্ষুধা। সেই মাটিতে পা রেখেছিলেন শহীদুল আলম। যিনি জীবনের পুরো সময়টা ব্যয় করেছেন সত্যের ছবি তুলতে, অন্যায়ের চিত্র প্রকাশ করতে। তাঁর উপস্থিতি ছিল কেবল একজন সাংবাদিক বা ফটোগ্রাফারের নয় বরং মানবতার এক প্রতিনিধি হিসেবে।
তিনি দেখেছেন, কিভাবে একটি জাতি প্রতিদিন মৃত্যুর মুখে বেঁচে থাকে। তিনি ক্যামেরার লেন্সে ধারণ করেছেন ধ্বংসস্তূপে শুয়ে থাকা শিশুর দেহ, হাসপাতালের ধ্বংসাবশেষ এবং সেইসব মুখ, যেগুলো এখনো বিশ্বাস করে পৃথিবী একদিন ন্যায়ের হবে। এজন্য সামনে যদি এক জাহাজ থেমে যায়, যদি এক উদ্যোগ ব্যর্থ হয়, তবুও মানবতার এই যাত্রা থামবে না।
আসলে গত দুই বছরের ইসরাইলের বর্বর আক্রমণে ৬৮ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে এবং গাজার ধ্বংসস্তূপে নৈতিক পৃথিবীর মৃত্যু ঘটেছে। ইসরায়েলের ক্রমাগত বোমা হামলায় গাজা এখনও পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগার। শিশু, নারী, চিকিৎসক, সাংবাদিক কেউই নিরাপদ নয়। জাতিসংঘের প্রতিবেদন বলছে, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গাজায় নারী-শিশুসহ নিহতের সংখ্যা লক্ষ ছাড়িয়েছে। খাদ্য, পানি, ওষুধ কিছুই যথাযথভাবে পৌঁছাতে পারছে না। এক সপ্তাহ আগে ট্রাম্প ঘোষিত সন্দেহজনক যুদ্ধবিরতির পর ফিলিস্তিনীরা খালি হতে ভিটায় ফিরে ঘরবাড়ি কিছুই খুঁজে পাচ্ছেন না।
এই মানবিক বিপর্যয়ের মুখে বিশ্বের তথাকথিত সভ্য রাষ্ট্রগুলো নীরব। বড় বড় শক্তি মানবাধিকারের বক্তৃতা দিলেও ফিলিস্তিনের শিশুদের মৃত্যু নিয়ে তারা যেন নির্বিকার। ঠিক এই জায়গাতেই শহীদুল আলমের কণ্ঠ বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। কারণ তিনি নীরব থাকতে পারেননি।
শহীদুল আলম শুধু একজন আলোকচিত্রী নন। তিনি সুমুদ ফ্লোটিলা সমুদ্র বহরে যোগদানকারী একমাত্র বাংলাদেশী এবং আমাদের বিবেকের কণ্ঠ। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় সত্য বলার ঝুঁকি নিয়েই লেখা। ২০১৮ সালে সরকারের সমালোচনার কারণে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, কিন্তু তবুও তিনি থামেননি।
গাজায় গিয়ে আবারও তিনি দেখালেন সত্যকে ধারণ করাই তাঁর নৈতিক দায়িত্ব। তাঁর এই অবস্থান আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সাংবাদিকতা কেবল তথ্য প্রচার নয়, এটি মানবতার নথি রক্ষার এক প্রকার পবিত্র কাজ।
পরবর্তী পরিকল্পনা জানতে চাইলে শহিদুল আলম বলেন, ‘অসাধারণ কিছু ব্যক্তি একসঙ্গে হওয়ার কারণে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমরা এখন আন্তর্জাতিকভাবে একটা নেটওয়ার্ক দাঁড় করাব। যেহেতু গ্লোবাল লিডাররা করবে না, আমরা অ্যাকটিভিস্টরা কীভাবে করতে পারি সেই লড়াইয়ের প্রস্তুতি আমরা নিয়েছি।… একটা ব্লুপ্রিন্ট আমরা করে রেখেছি এবং আমরা ফেরার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আবার আমরা যাব এবং হাজারটা জাহাজ যাবে।’ ‘আমাদের দেশে যেটা করেছি জুলাই অভ্যুত্থানের সময় রাস্তায় নেমেছি, আন্দোলন করে এ রকম একজন স্বৈরাচারকেও আমরা হঠাতে পেরেছি। এখানেও সেই জিনিস, আন্তর্জাতিকভাবে সেরকম একটা জিনিস করা দরকার।’
এই বাক্যটি এখন কেবল একটি প্রতীক হরেও এটি এক আন্দোলনের আহ্বান। আবার আমরা যাব মানে, ভয় বা দমন যতই আসুক, মানুষ আবারও যাবে, সাহায্যের হাত বাড়াবে, সত্য বলবে। হাজারটা জাহাজ যাবে মানে, এক ব্যক্তিকে আটকানো গেলেও, হাজার মানুষ এগিয়ে আসবে। এক আলোকচিত্রীকে রুখলেও, শত চোখ আলো ছড়াবে।
এই দর্শনই মানবতার চিরন্তন গতি। ইতিহাস সাক্ষী, প্রতিবার অন্যায় বেড়েছে, তার চেয়েও বেশি বেড়েছে প্রতিবাদী কণ্ঠ। মনে হচ্ছে শহীদুল আলমের এই বাক্য সেই ইতিহাসেরই ধারাবাহিকতা।
তাছাড়া তাঁর কণ্ঠ আমাদের দেশের নৈতিক অবস্থানকেও প্রতিনিধিত্ব করেছে। যখন তিনি গাজায় দাঁড়িয়ে মানবতার পক্ষে কথা বলেছেন তখন সেই কথা বাংলাদেশেরও মানমর্যাদা বৃদ্ধি করেছে।
তবে তাঁর ফিরে আসা এবং সংবাদ সম্মেলণের পর যদি রাষ্ট্র, সমাজ বা কিছু গোষ্ঠী সন্দেহের চোখে তাঁকে দেখে, তবে সেটি কেবল একজন মানুষকে নয় বরং পুরো জাতির বিবেককে অবমাননা করা হবে। কারণ মানবতার পক্ষে কথা বলা কখনোই অপরাধ বা দোষের কিছু হতে পারে না।
ইসরায়েল বারবার সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে, কারণ তারা জানে সত্যের ছবি পৃথিবীর বিবেককে জাগিয়ে তুলতে পারে। শহীদুল আলমের মতো মানুষদের ভয় দেখানো হয়, হেনস্তা করা হয়, কিন্তু সত্যের আলোকে বন্ধ করা যায় না। এই আলো কখনো বন্দী হয় না বরং আরও তীব্র হয়ে ওঠে এবং উঠতেই থাকে। তাঁর বলা আবার আমরা যাব আসলে সেই অপরাজেয় আলোরই ঘোষণা।
পৃথিবীতে মানবতার ইতিহাসে যতবার অন্ধকার নেমে এসেছে, ততবারই কেউ না কেউ আলো জ্বালিয়েছে। গ্রেটা থুনবার্গ, শহীদুল আলমরা সেই আলোকবাহকের কাতারে আছেন। তাঁদের চোখে ধরা পড়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর দৃশ্য তবুও তারা আশার ভাষায় বলেছেন।অকপটে ব্যক্ত করেছেন পুরোপুরি স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আবার আমরা গাজায় যাব।তার প্রবীণ বয়সে এই দৃঢ় উচ্চরণ শুনে মনে হয়েছে বাংলাদেশে জন্ম নেয়া শহীদুল ক্রিকেট খেলার কোন শক্ত ব্যাটার নয় একজন অকুতোভয় যোদ্ধা। অত্যাচারী ইসরাইলীদের বিরুদ্ধে বুকের পাটা উচিয়ে রুখে দাঁড়ানো একজন ব্যাটা শহীদুল!
এটি কেবল শুধু ফিলিস্তিনের গাজার জন্য না হয়ে সমগ্র পৃথিবীর মানবতার ভবিষ্যৎ নিয়ে উচ্চারিত এক প্রার্থনা মনে হয়। যতদিন পৃথিবীতে অন্যায় থাকবে যতদিন মানুষ বাঁচার অধিকার হারাবে ততদিন এই বাক্য প্রতিধ্বনিত হবে সাহসের সুরে। কারণ মানবতা কোনো সীমান্ত মানে না। আর আলোকের যাত্রা কখনো থামে না।
× প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.