বুধবার | ২২ অক্টোবর, ২০২৫ | ৬ কার্তিক, ১৪৩২

অটোরিক্সার লিড ব্যাটারী কি আয়ু গ্রাস করবে?

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
বাংলাদেশের শহরগুলোতে একসময় হাতেগোনা কিছু প্যাডেল রিকশা ছিল। মানুষের সহজ চলাচলের বাহন হিসেবে ক’বছর পূর্বে সংযোজিত হয়েছে অটোরিক্সা।লিড এসিড ব্যাটারি বা সীসা ও এসিডসমৃদ্ধ ব্যাটারী চালিত নতুন অটোরিক্সা যানের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে আজ সেই চিত্র একেবারে পাল্টে গেছে। এখন রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরের প্রতিটি গলিপথ, প্রধান সড়ক সব জায়গায় অটোরিকশার আধিপত্য। এতটাই বেড়েছে এদের সংখ্যা যে বলা যায় অটোরিক্সা বড় শহরগুলোকেও দ্রুতগতিতে গ্রাস করছে এবং এর ব্যাটারীর সীসা মানবদেহে মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে চলেছে।
অটোরিক্সার জনপ্রিয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। যাত্রী তুলনামূলক সস্তায় ভ্রমণ করতে পারে, চালকের পক্ষে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ তৈরি হয়, আবার শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সহজে যাওয়া যায়। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে যখন এই যানবাহনগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। অধিকাংশ শহরে দেখা যায় অটোরিকশা চালানোর অনুমতি নেই বড় সড়কে, কিন্তু বাস্তবে তারা নির্দ্বিধায় চলাচল করছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ যানজট।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা সব বড় শহরের একই চিত্র। অফিস সময় বা স্কুল, কলেজ ছুটির মুহূর্তে অটোরিকশার সারি রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে যায়। বড় বাস বা জরুরি যানবাহনও এগোতে পারে না। প্রতিদিন হাজারো ঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে এই যানজটে। এতে শুধু সময় নয়, অর্থনীতিও মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, যানজটের কারণে দেশের জিডিপির একটি বড় অংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অথচ এর একটি বড় কারণ অবৈধভাবে চলা অটোরিক্সা।
আরও বড় সমস্যা হলো এদের নিরাপত্তাহীনতা। অধিকাংশ অটোরিক্সার কোনো রেজিস্ট্রেশন নেই, চালকের লাইসেন্স নেই, এমনকি অনেক সময় যানটির বৈধ কাগজপত্রও থাকে না। দুর্ঘটনা ঘটলে ভুক্তভোগীরা ক্ষতিপূরণ পায় না, দায়ীকে খুঁজে পাওয়া যায় না। একদিকে এই গাড়ি চালিয়ে হাজারো মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে, অন্যদিকে পুরো নগরব্যবস্থার ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
অটোরিক্সার এহেন বিস্তার কেবল অব্যবস্থাপনার কারণে নয়, বরং নীতিনির্ধারকদের দুর্বলতারও পরিচায়ক। মাঝে মাঝে প্রশাসন অভিযান চালায়, কয়েকশ’ অটোরিক্সা জব্দ করে, আবার কয়েকদিন পর সব আগের জায়গায় ফিরে যায়। কারণ এদের পেছনে রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট, রাজনৈতিক প্রভাব, আর প্রশাসনিক গাফিলতি।
তাহলে কি অটোরিক্সাকে শহর থেকে পুরোপুরি বিদায় জানাতে হবে? হয়তো না। বরং প্রয়োজন একটি সুনির্দিষ্ট নীতি। শহরের নির্দিষ্ট এলাকায়, নির্দিষ্ট রুটে অটোরিক্সা চলতে পারে—কিন্তু প্রধান সড়কগুলোতে গণপরিবহনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। চালকদের নিবন্ধন ও প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
শহরের ব্যস্ত সড়ক হোক কিংবা গ্রামের মেঠোপথ আজ সর্বত্রই ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সার দাপট। স্বল্প খরচে যাতায়াতের সুবিধা মানুষকে স্বস্তি দিলেও এর আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ সংকট। অটোরিক্সার লিড অ্যাসিড ব্যাটারি থেকে নিঃসৃত সীসা অদৃশ্য শত্রুর মতো মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে, ধীরে ধীরে গ্রাস করছে তাদের সুস্থতা, বুদ্ধি ও আয়ু।
সীসা এক বিষধাতু, যা মানুষের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শিশুদের মানসিক বিকাশ ব্যাহত করে, প্রাপ্তবয়স্কদের স্নায়ুতন্ত্র, কিডনি ও লিভারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ধীরে ধীরে এটি শরীরকে দুর্বল করে তোলে, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। সবচেয়ে বড় বিপদ হলো সীসার ক্ষতি সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ে না, বরং দীর্ঘ সময় ধরে নিঃশব্দে শরীরকে ভেতর থেকে খেয়ে ফেলে। ফলে মানুষ অজান্তেই আয়ু হারায়, স্বাস্থ্য হারায়, প্রাণশক্তি হারায়।
বাংলাদেশে ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সার সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। প্রতিটি গাড়িতে থাকে কয়েকটি বড় লিড-অ্যাসিড ব্যাটারি, যেগুলো মাত্র কয়েক মাস পরপর বদলাতে হয়। নষ্ট ব্যাটারি জমে ওঠে শহরের এক কোণে, আবার অবৈধ ছোট ছোট কারখানায় তা ভেঙে সীসা আলাদা করা হয়। কোনো সুরক্ষা নেই শ্রমিকদের, নেই পরিবেশের জন্য নিরাপদ ব্যবস্থা। ব্যাটারির তরল মিশে যায় মাটিতে ও পানিতে, সীসার ধুলো ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। মানুষ নিঃশ্বাসের সঙ্গে তা গ্রহণ করে, খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ে সেই বিষ।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতি শুধু পরিবেশ নয়, জনস্বাস্থ্যের ওপরও বিপর্যয় ডেকে আনছে। অটোরিক্সার লিড ব্যাটারির এই ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ এখনো দৃশ্যমান নয়। মাঝে মধ্যে অবৈধ কারখানা ভেঙে দেওয়া হয়, কিন্তু কিছুদিন পর আবার গজিয়ে ওঠে। আর এই ফাঁকে অগণিত মানুষ ধীরে ধীরে মৃত্যু ডেকে আনে নিজের শরীরে।
বিশেষ করে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।এক গবেষণায় দেখা গেছে ঢাকা শহরে ৯৮% শিশুর রক্তে .২৫ মাইক্রোগ্রাম সীসার উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। ‘ঢাকার ৯৮ শতাংশ শিশুর রক্তে সীসার উপস্থিতি থাকা ভয়ংকর। সীসার পরিমাণ ৬৭ মাইক্রো গ্রাম বা তার বেশি, যা উদ্বেগজনক বলছেন গবেষকরা। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) করা এক গবেষণায় এ তথ্য মিলেছে।আইসিডিডিআর,বির ২০২২ ‘২৪ সালের মধ্যে ঢাকায় পরিচালিত একটি সামগ্রিক গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল তুলে ধরেন। গবেষণায় ২ থেকে ৪ বছর বয়সী ৫০০ জন শিশুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।’
শিশুদের রক্তে সীসার উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ায় তাদের পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ কমছে, স্মৃতিশক্তি দুর্বল হচ্ছে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি শিশুদের দিয়ে জাতির ভবিষ্যত গড়া খুব কঠিন হবে। একদিকে আমরা শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ার স্বপ্ন দেখি, অন্যদিকে অজান্তেই সেই প্রজন্মকে বিষ খাইয়ে দিচ্ছি।
এক সময় আমরা রিক্সার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। আজকাল অটোরিক্সা এত বেশী যে তারা আমাদেরকে নেবার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। এর ভাড়া বেশ সস্তা। প্রশ্ন হলো, আমরা কি কেবল সস্তা ভাড়ার যাতায়াতের জন্য আমাদের আয়ু বন্ধক রাখব? সমাধান অবশ্যই আছে। সরকারকে অবিলম্বে পরিবেশবান্ধব ব্যাটারি ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে হবে, অবৈধ রিসাইক্লিং কারখানা বন্ধ করতে হবে, আর সচেতনতা বাড়াতে হবে সাধারণ মানুষের মধ্যে। একই সঙ্গে দরকার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। যাতে পরিবহন খাতে বিকল্প প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করা যায়।
অটোরিকশা একদিকে জীবিকার উৎস, অন্যদিকে নগরব্যবস্থার দুঃস্বপ্ন। যদি এখনই নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তবে কয়েক বছরের মধ্যেই শহরগুলোতে হাঁটা, চলাচল, এমনকি শ্বাস নেওয়াও কষ্টকর হয়ে উঠবে। তাই সময় এসেছে ভাববার শহর কি মানুষের হবে, নাকি অটোরিকশার দখলে যাবে?
শহরগুলোতে ভয়ংকর যজিটের প্রধান কারণ নিয়ন্ত্রণহীন অগণিত অবৈধ অটোরিক্সা। এরা অলিগলি ছেড়ে, ফুটপাথ, হাইওয়ে, রাজপথ সবকিছুই গ্রাস করে ফেলছে।অনেকে বলেন এরা বেকারত্ম কমাচ্ছে। কিন্তু সবাই অটোরিক্সা চালানোর পেশায় নামলে মানসম্মত আয় অর্জন হবে কিভাবে? এছাড়া যানজট কমানোর জন্য অসহনীয় ও সংখ্যাতিরিক্ত অটোরিক্সা চালানো নিষিদ্ধ করে বেকার যুবকদের বিকল্প চাকুরীর ব্যবস্থা করা খুব জরুরী।
আজ আমরা যদি সতর্ক না হই তবে আগামী প্রজন্মকে একটি বিষাক্ত ভবিষ্যৎ উপহার দেব। অটোরিক্সার লিড ব্যাটারির সীসা নিঃশব্দে সমাজের সকল মানুষকে দ্রুতগতিতে গ্রাস করছে। সেজন্য পরিবেশবান্ধব লিথিয়াম ব্যাটারি ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণ করে এখনই গোটা দেশে এই অদৃশ্য মৃত্যুকে থামানো জরুরি।
× প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.