বুধবার | ২২ অক্টোবর, ২০২৫ | ৬ কার্তিক, ১৪৩২

পাহাড়ে বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে শহীদ জিয়ার পলিসির প্রাসঙ্গিকতা

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যে অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল সেটি ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম। জাতিগত বৈচিত্র্য, ঐতিহাসিক অবহেলা ও সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা, এই তিনের সংমিশ্রণ পার্বত্যাঞ্চলকে পরিণত করেছিল এক জটিল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংকটে। বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে যখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলেন তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল এক রক্তাক্ত দ্বন্দ্বের ভূমি। সেখানকার অমীমাংসিত জাতিগত প্রশ্ন, শরণার্থী সমস্যা ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য ছিল গুরুতর হুমকি। এই প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট জিয়া যে পলিসি গ্রহণ করেছিলেন, তা ছিল মূলত শান্তি ও উন্নয়নের এক বাস্তববাদী প্রয়াস।
প্রথমেই তিনি বুঝতে পারেন পার্বত্য সংকট কেবল সামরিক শক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এটি মূলত: একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা। তাই তিনি দুই ধারায় পদক্ষেপ নেন। একদিকে ছিল প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা জোরদার, অন্যদিকে উন্নয়ন ও অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রশাসনিক পুনর্গঠন ও নিয়ন্ত্রণ নীতি ছির খুবই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। তাঁর সময়েই পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনা ও আধাসামরিক বাহিনীর উপস্থিতি বাড়ানো হয়। তবে এটি ছিল কেবল দমনমূলক ছিলনা। এটি প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কৌশলও ছিল। পার্বত্য এলাকায় তিনটি জেলা পরিষদের ধারণা পরবর্তীতে এখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়। স্থানীয় প্রশাসনকে কার্যকর করার পাশাপাশি জিয়া স্থানীয় নেতৃত্বের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যান। যা আগের শাসনের তুলনায় একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল।
শহীদ জিয়া উপলব্ধি করেন পার্বত্য সংকটের মূল শিকড় অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও অবহেলায় নিহিত। তাই তিনি জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে অন্তর্ভুক্ত করেন। পাহাড়ি অঞ্চলে সড়ক, যোগাযোগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ শুরু হয়। তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড (সিবিডি)–এর পুনর্গঠনও তার সময়েই হয়। যার চেয়ারম্যান ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা । যিনি উন্নয়ন ও নিরাপত্তা উভয়ের সমন্বয়ের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত ছিলেন।
জিয়ার এই উন্নয়নমুখী পলিসির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ‘ইন্টিগ্রেশন’বা একীভবন। তিনি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে মূলধারার প্রশাসন ও রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করার নীতি নেন। স্থানীয় নির্বাচন, ইউনিয়ন পরিষদ গঠন, এবং স্থানীয় জনগণের চাকরিতে নিয়োগ—এসব পদক্ষেপ ছিল তার বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ।
এছাড়া রাজনৈতিক বাস্তবতা ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তিনি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে সর্বাগ্রে রেখেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন পার্বত্য চট্টগ্রামকে কোনো বিশেষ মর্যাদা বা স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হলে তা বিচ্ছিন্নতাবাদকে উৎসাহিত করবে। তাই তার পলিসি ছিল ন্যায্য অংশগ্রহণ কিন্তু আলাদা রাষ্ট্র বা প্রশাসন না করে একটি ব্যালান্সড অবস্থান। এই নীতি পরবর্তীতে শান্তি ও সহবস্থানের চুক্তির আলোচনাগুলোর ভিত্তি রচনা করে।
একই সঙ্গে তিনি সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা ও উন্নয়ন কার্যক্রমকে একত্রিত করে এক নতুন ধরনের সিভিল–মিলিটারি প্রশাসনিক মডেল গড়ে তোলেন। এতে একদিকে যেমন নিরাপত্তা বজায় থাকে, অন্যদিকে উন্নয়ন কার্যক্রমও এগিয়ে চলে। এটি ছিল জিয়ার প্রশাসনিক বাস্তববোধের এক অনন্য উদাহরণ।
অবশ্য প্রেসিডেন্ট জিয়ার নীতির কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিল। পাহাড়ে বাঙালি পুনর্বাসন কর্মসূচি তার সময়েই শুরু হয় যা একদিকে জনসংখ্যার ভারসাম্য পরিবর্তন করে। অন্যদিকে পাহাড়িদের মধ্যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি করে। অনেকে মনে করেন এ নীতি শান্তির চেয়ে সন্দেহ ও প্রতিরোধ বাড়িয়েছে। তাছাড়া চরমপন্থী সংগঠন শান্তিবাহিনীর উত্থান ঠেকাতে সামরিক পন্থার ওপর নির্ভরতা শেষ পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি অবিশ্বাসের জন্ম দেয়।
তবে, সেই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে বোঝা যায় একটি সদ্য স্বাধীন, অস্থিতিশীল রাষ্ট্রে জিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার ছিল অখণ্ডতা রক্ষা ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তার পার্বত্য নীতি অনেকাংশে কার্যকর ছিল এবং ভবিষ্যতের শান্তিচুক্তির জন্য ভিত্তি তৈরি করেছিল।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার নীতিগুলোই পরবর্তীতে এরশাদ ও খালেদা জিয়া সরকারের পার্বত্য নীতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার কাঠামো, সামরিক উপস্থিতি ও সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা, এসবই পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে বহাল থাকে। এমনকি ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তিতেও জিয়ার সময়কার প্রশাসনিক ধারণা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা একরকম প্রতিফলিত হয়েছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বাধীনতার পর থেকেই জাতীয় সংহতির এক জটিল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। উন্নয়ন বৈষম্য, সাংস্কৃতিক অবহেলা ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা পাহাড়কে পরিণত করেছিল অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দুতে। সেই কঠিন সময়েই রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দায়িত্ব নেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তার প্রজ্ঞামূলক দৃষ্টিভঙ্গিই প্রথমবারের মতো পার্বত্য সংকটকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নয়, বরং উন্নয়ন ও অংশগ্রহণের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে।
পাহাড়ি অঞ্চলে যোগাযোগ, শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য ও প্রশাসনিক সেবায় ব্যাপক বিনিয়োগ শুরু হয়। তিনি স্থানীয় জনগণকে উন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ দেন, যাতে রাষ্ট্র ও পাহাড়ি সমাজের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা গড়ে ওঠে। এই দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল জিয়ার প্রজ্ঞামূলক পলিসি যেখানে সামরিক নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে উন্নয়ন ও অংশগ্রহণের ভারসাম্য বজায় রাখা হয়েছিল।
বর্তমানে যখন পার্বত্য চট্টগ্রাম এখনো অস্থিরতার ছায়ায় জর্জরিত, তখন জিয়ার নীতির প্রাসঙ্গিকতা নতুন করে আলোচনায় আসছে। বর্তমান বাস্তবতায় জিয়ার নীতির প্রাসঙ্গিকতা খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। ২০২৫ সালের বাস্তবতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে। উন্নয়ন প্রকল্প বাড়লেও জনগণের অংশগ্রহণ কমছে, ভূমি-সংঘাত বাড়ছে, আর তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অবিশ্বাসের নতুন ঢেউ দেখা দিচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে শহীদ জিয়ার পলিসির তিনটি দিক এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ক. অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন: স্থানীয় জনগণকে প্রকল্প ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে সম্পৃক্ত করতে হবে। খ. সংলাপের সংস্কৃতি: পাহাড়ি-বাঙালি দ্বন্দ্ব নিরসনে সংলাপই হতে পারে স্থায়ী সমাধানের পথ। গ. রাষ্ট্রীয় আস্থার পুনর্গঠন: কেন্দ্রের প্রতি পাহাড়ি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে জিয়ার উন্নয়নকেন্দ্রিক রাষ্ট্রনীতি আবারও কার্যকর করতে হবে।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন এমন এক রাষ্ট্রনায়ক। যিনি বুঝেছিলেন, একটি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা কেবল বলপ্রয়োগে নয়, বরং আস্থার রাজনীতিতে নিহিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে তার প্রজ্ঞামূলক পলিসি ছিল জাতীয় সংহতির বাস্তব অনুশীলন, যেখানে উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও অংশগ্রহণ একই সূত্রে বাঁধা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়ার পলিসি ছিল সময়োপযোগী বাস্তববাদ ও জাতীয় অখণ্ডতার সমন্বয়। তিনি সমস্যাটিকে কেবল নিরাপত্তা ইস্যু হিসেবে না দেখে উন্নয়ন, প্রশাসন ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাধান খুঁজেছিলেন। যেখানে জাতিগত সংহতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সার্বভৌমত্ব এই তিনটিকেই এক সূত্রে বাঁধার চেষ্টা দেখা যায়।
আজও পার্বত্য শান্তির প্রশ্নে জিয়ার সেই বাস্তববাদী পন্থা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। কারণ, পাহাড়ের সমস্যা যতটা সামরিক নয় তার চেয়ে অনেক বেশি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। যার সমাধান সম্ভব কেবল ন্যায্য উন্নয়ন ও বিশ্বাসের রাজনীতির মাধ্যমে।
আজও যখন পাহাড়ে শান্তির চেয়ে সন্দেহ বেশি। সামান্য সমস্যাকে উস্কে দিয়ে মহীরুহ করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছে বিভিন্ন দেশী-বিদেশী শক্তিগুলো। গত সপ্তাহে খাগড়াছড়িতে স্কুলছাত্রী ধর্ষণের ঘটনাকে পুঁজি করে পাশ্ববর্তী দেশের ইন্ধনে তুলকালাম কান্ড ঘটতে দেখা গেছে। যেটা বিবেকবান মানুষের কাম্য হতে পারে না। সযোগসন্ধানীরা পাহাড়ে উন্নয়ন প্রকল্পের চেয়ে বিভাজন প্রকল্প নিয়ে নতুন খেলা শুরু করেছে। তাই পাহাড়ের অশান্তি আবারো নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।
এই ধরনের বিশৃংখলা আরো বেশী যখন স্পষ্ট হয়ে জনজীবনে ক্রমাগত দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে তখন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার নীতির প্রাসঙ্গিকতা নতুন করে অনুভূত হচ্ছে। তাঁর প্রজ্ঞামূলক নীতি সামনের দিনগুলোতে আমাদেরকে পাহাড়ের বিশৃংখলা নিরসেণে শান্তি ও সমতার পথ দেখাতে পারে। পার্বর্ত্য অঞ্চল নিয়ে তার তীক্ষন দৃষ্টিভঙ্গি একটি নীতিমডেল হিসেবে কেবল অতীতের বিষয় না হয়ে ভবিষ্যতেরও গুরুত্ত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা হতে পারে। যেখানে পাহাড়ি ও সমতলের মানুষ সমান সুযোগে, সমান মর্যাদায়, একীভূত বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে শান্তিতে বসবাস করার টেকসই সুযোগ পাবে।
× প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.