-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
অক্টোবরের ১৫ থেকে ১৮ তারিখের মধ্যে ঘটে যাওয়া পর পর তিনটি বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা দেখে জাতি খুবই বিস্মিত। বিভিন্ন রাসায়নিকের মধ্যে আগান লেগে প্রজ্জ্বলিত লেলিহান শিখা ২৪ ঘণ্টার পরও নেভেনি, নেভানো যায়নি। ফায়ার কর্মীদের আধুনিক যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষণ, রোবট, জনবল সবই ছিল। শুধু ছিল না পর্যাপ্ত পানি!হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে কার্গো ভিলেজে অগ্নিকান্ডের সময় ওয়াসার পানিবাহী গাড়ি আসার জন্য বার বার অপেক্ষা করতে হয়েছে।
বাংলাদেশে এখন অগ্নিকাণ্ড যেন এক স্থায়ী আতঙ্কের নাম। এসব অগ্নিকাণ্ডকে এখন শুধু একটি দুর্ঘটনা বললে ভুল হবে। এসব অগ্নিদুর্ঘটনার কোন নির্দিষ্ট সময় বা সিজন নেই। এ যেন আমাদের নগরজীবনের নিত্য অভিশাপ। কেউ কেউ ভাবছেন এগুলো নাশকতা। একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দেশের জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। তবে কি এ দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা চলছে? পুরান ঢাকার নিমতলী থেকে শুরু করে চকবাজার, কেরানীগঞ্জ, রূপনগর সব জায়গায় একই দৃশ্য দেখা গেল। যা হচ্ছে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অবৈধভাবে রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম, অগ্নিনিরাপত্তাহীন ভবন, আর প্রশাসনিক উদাসীনতা। সম্প্রতি পর পর তিনটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড আবারও প্রমাণ করেছে আমরা বার বার বিপদে পড়েও তা থেকে শিখি না কিংবা শিখতে চাই না। সেসব ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনায় রাসায়নিকের মধ্যে লেলিহান শিখা ২৪ ঘণ্টার পরও নেভেনি।
শিয়ালবাড়িতে ১৮ ঘন্টা ধরে আগুন জ্বলতে তাকার সময় একজন অসহায় ফায়ারকর্মী টিভিক্যামেরার সামনে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, নিজে নিজে না নিভলে নেভে না এসব আগুন। কারণ অজানা রাসায়নিকের বড় পরিমাণ মজুতে এই আগুন লেগেছে। কিন্তু আজকাল এটা কেবল রাসায়নিকের বিষয়ই নয় এটি আমাদের বিবেক, নীতি ও জবাবদিহিতারও প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা জানি রাসায়নিক আগুনের প্রকৃতি আলাদা। থিনার, টারপিন, প্লাস্টিক, রাবার, রঙ, ডিটারজেন্ট কিংবা পারফিউমের মতো দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে আগুন পড়লে পানি তা নেভাতে পারে না। বরং আরও গতি ছড়িয়ে দেয়। এমন পরিস্থিতিতে ফোম ও গ্যাসভিত্তিক প্রযুক্তি ছাড়া আগুন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। অথচ বাংলাদেশে এখনো ফায়ার সার্ভিসের হাতে পর্যাপ্ত বিশেষায়িত সরঞ্জাম নেই বললে ভুল হবে। তারা সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন আর নিজের আত্মাহুতি দেন বার বার। কিন্তু অব্যবস্থার আগুনের সামনে তাদের প্রচেষ্টা প্রায়ই ব্যর্থ হয়।
তবে প্রযুক্তির অভাবই মূল কারণ নয়। এর মূলে আছে দায়হীনতা। পুরান ঢাকায় ২০১০ সালের নিমতলী ট্র্যাজেডিতে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তখন ঘোষণা এসেছিল রাসায়নিক গুদাম সরানো হবে। ২০১৯ সালে চকবাজারের চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পরও একই প্রতিশ্রুতি। ২০২৫ সালেও আমরা একই আগুনে পুড়ছি, একই প্রতিশ্রুতির ধোঁয়ায় শ্বাস নিচ্ছি। অর্থাৎ, আগুন নিভলেও প্রশাসনিক অবহেলা নিভছে না। বরং আরও দাউ দাউ করে জ্বলছে। আজও জনবহুল এলাকায় রাসায়নিক মজুদ রাখার সংস্কৃতি চলছে, আর রাষ্ট্র তাকিয়ে আছে অন্যদিকে।
এই শহরে হাজারো ভবন আছে, যেগুলো আসলে মৃত্যুফাঁদ। আবাসিক ভবনের নিচতলায় রাসায়নিকের ড্রাম, পাশে স্কুল, উপরে পরিবার। এমন বিপজ্জনক মিশ্রণে একবার আগুন লাগলে তা আর ২৪ ঘণ্টায় নিভে না। কারণ প্রতিটি ঘরে মজুদ থাকে নতুন জ্বালানি। আর প্রতিটি কর্ণারে থাকে মানবিক ভুলের স্তুপ।
সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, শিল্প মন্ত্রণালয় সবাই দায় এড়াতে ব্যস্ত। অবৈধ কারখানার অনুমতি কে দিল, ফায়ার লাইসেন্স নবায়ন হলো কীভাবে এসব প্রশ্নের জবাব কেউ দেয় না। অগ্নিকাণ্ডের পর গঠিত তদন্ত কমিটি হয়তো কারণ খুঁজে পায়, কিন্তু কোনো রিপোর্টই কার্যকর হয় না। অথচ প্রতিবারই অগ্নিকাণ্ডের পর দেখা যায় উপদেষ্টা, মন্ত্রী, মেয়র ও প্রশাসনের প্রতিনিধি ঘটনাস্থলে গিয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে ছবি তোলেন। তারপর কিছুদিন পরেই সবকিছু ভুলে যাওয়া হয়।
ফলে আগুন নেভে, কিন্তু তার ছাই থেকে জন্ম নেয় নতুন আগুন। প্রতিবারই মানুষ পুড়ে যায়, পরিবার নিঃস্ব হয়, ব্যবসা ধ্বংস হয়, কিন্তু কেউ দায় নেয় না।
আজ আমাদের বুঝতে হবে রাসায়নিকের আগুন নিভাতে শুধু পানি বা ফোম নয়, প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও সামাজিক জবাবদিহিতা।অবিলম্বে যা কিছু করতে হবে তা হচ্ছে: দাহ্য পদার্থের গুদাম অবিলম্বে জনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে সরাতে হবে। যেগুলো জরুরী ভিত্তিতে দ্রুত সরানো যাবে না সেগুলো সিলগালা করে বিশেষ নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরী করে সাবধানতা নোটিশ দিয় রাখতে হবে। ফায়ার সার্ভিসে রাসায়নিক অগ্নিকাণ্ড মোকাবিলায় বিশেষ ইউনিট গঠন করতে হবে। ভবন নির্মাণ অনুমোদনের আগে অগ্নি-নিরাপত্তা ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক করতে হবে। আর সবচেয়ে জরুরি, দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যাতে প্রতিটি মৃত্যু কেবল পরিসংখ্যান না হয়।
এই দায় কেবল এক ব্যক্তির নয়, এটি একটি কাঠামোগত অবহেলার ফল। সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, শিল্প মন্ত্রণালয়—সব সংস্থার দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও কেউ নজরদারি করে না। অবৈধ কারখানা চলে রাজনৈতিক প্রভাবে, ভাড়াটিয়া মালিক জানেন না ভবনের ভেতরে কী মজুদ আছে, ফায়ার লাইসেন্স নবায়ন হয় ঘুষে। ফলে আগুনের সঙ্গে পুড়ে যায় মানুষের বিশ্বাসও।
রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শে আসা আগুন নিজে নিজে কখনও নিভে না।এ এক প্রাচীন সত্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি কখনও এই সত্যটা রাষ্ট্রীয় নীতিতে স্থান দিয়েছি? পুরান ঢাকার চকবাজার, নয়ারহাট, বংশাল থেকে শুরু করে রূপনগর পর্যন্ত, অসংখ্য বাসা-বাড়ি ছাড়াও সারা রাজধানীতে লুকানো গুদামে এখনো দাহ্য রাসায়নিক দ্রব্য মজুদ রাখা হয়। ফায়ার সার্ভিসের অনুমতি ছাড়াই এসব কারখানা চলে দিনের পর দিন। তাদের পাশে থাকে স্কুল, মসজিদ, আবাসিক ভবন—অর্থাৎ মৃত্যুর ফাঁদে ঘেরা জীবন্ত মানুষ।
রাসায়নিকের মধ্যে লেগে যাওয়া আগুন নিজে নিজে নিভে না, যদি তাকে নেভানোর মতো সঠিক পদ্ধতি ও সদিচ্ছা না থাকে। একইভাবে, অবহেলা, দুর্নীতি ও দায়িত্বহীনতার আগুনও নিভে না, যতদিন না আমরা নিজেরাই তা নেভানোর সংকল্প নিই। যদি আমরা এখনো না জাগি তবে এই আগুন একদিন আমাদেরই গ্রাস করবে। তা শুধু ভবন নয় ভবিষ্যৎও পুড়ে যাবে সেই লেলিহান শিখায়। উন্নত বিশ্বে রাসায়নিক অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে ‘ফোম বেইজড টেকনোলজি’ ও ‘ড্রোন সাপোর্টেড কুলিং সিস্টেম’ ব্যবহৃত হয়। আর আমাদের এখানে এখনো পানির বালতি আর হোস পাইপই একমাত্র ভরসা।
এই অগ্নিকাণ্ডগুলো কেবল ভবন নয়, ধ্বংস করছে মানুষের বিশ্বাসও। প্রত্যেকবার আমরা দেখি আগুনের পর লাশের সংখ্যা বাড়ে, প্রতিবাদ কমে, আর তদন্ত কমিটি কারণ অনুসন্ধান করে আবার হারিয়ে যায় প্রশাসনিক ধুলায়। কোনো মালিকের শাস্তি হয় না, কোনো মন্ত্রী দায় নেন না, কোনো ভবন বন্ধও থাকে না।
আজ পর পর এতগুলো ভয়ানক অগ্নিকান্ড, অগ্নিমৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি দেখে একটা কথাই মনে হচ্ছে আর কত মৃত্যু, কত অগ্নিকাণ্ড, কত অঙ্গার লাগবে আমাদের জাগতে? রাসায়নিক আগুনের শিখা যদি ২৪ ঘণ্টা পরও না নেভে, তবে বুঝতে হবে আমাদের নীতিনির্ধারক সমাজও এখন আগুনের মতোই অদম্য। তবে সেটা ন্যায়ের জন্য নয় তাদের অবহেলার জন্য। এই আগুন কেবল প্রযুক্তি বা পানি দিয়ে নেভানো যাবে না। নেভাতে হবে সবার দায়িত্বশীলতা, নীতি, ও সেগুলোর কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে।
× প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]