রাশিদুল ইসলাম রাশেদ (নিজস্ব প্রতিবেদক):
নাটোরের লালপুরে উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী ও দেশের অন্যতম বৃহৎ কালীপূজা ও মেলা শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) রাত ১২টার পর ধর্মীয় রীতি ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে উপজেলার বুধপাড়া শ্রী শ্রী কালীমাতা মন্দিরে শুরু হয় ৫৩৬তম কালীপূজা অর্চনা। এ সময় দেশ-বিদেশের হাজারো ভক্ত, অনুরাগী ও দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে মন্দির চত্বর ও আশপাশের এলাকা।
ভোর থেকে শুরু হয় পূজা অর্চনা, পাঠা বলিদান, ভোগ প্রদান, আরাধনা ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নানা আচার-অনুষ্ঠান। পূজাকে ঘিরে শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী কালীমেলা, যেখানে এক হাজারেরও বেশি অস্থায়ী দোকান বসেছে। মেলায় হরেক রকমের ঐতিহ্যবাহী খাবার, মিষ্টান্ন, খেলনা, কসমেটিকস, আসবাবপত্র ও বিভিন্ন গৃহস্থালি তৈজসপত্র বিক্রি হচ্ছে।
লালপুরের জোতদৈবকী গ্রামের প্রতিমা কারিগর সুকুমার চন্দ্র হালদার জানান, এ বছর তিনি ২৩ ফুট উচ্চতার প্রতিমা নির্মাণ করেছেন, যা উত্তরবঙ্গের অন্যতম বৃহৎ কালী প্রতিমা। তিনি ১৯৯৮ সাল থেকে নিয়মিত এই প্রতিমা তৈরি করে আসছেন।
মন্দির কমিটির সভাপতি শতদল কুমার পাল বলেন, “আনন্দঘন পরিবেশে অত্যন্ত সুন্দরভাবে পূজা চলছে। আশপাশের গ্রামজুড়ে এখন উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। প্রতি বছর কার্তিক মাসে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিদিন শতাধিক পাঠা বলিদান দেওয়া হয়। প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত নির্বিঘ্নে পূজা সম্পন্ন করতে সবার সহযোগিতা কামনা করছি।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মেহেদী হাসান বলেন, “পূজা উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মন্দিরে দুই টন চাল অনুদান দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নিরাপত্তা ও সার্বিক সহযোগিতা নিশ্চিত করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম জানান, “উৎসবমুখর পরিবেশে পূজা সম্পন্ন করতে পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
দেশ-বিদেশের ভক্ত ও দর্শনার্থীদের অংশগ্রহণে ৭ দিনব্যাপী এ ধর্মীয় মিলনমেলা প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে আগামী রবিবার (২৬ অক্টোবর) শেষ হবে।
প্রসঙ্গত মন্দির সূত্রে জানা গেছে, নবাবি আমলে বর্গীয় অত্যাচার থেকে বাঁচতে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের খাগড়া এলাকা থেকে প্রায় ৬০টি কাঁসাশিল্পী পরিবার লালপুরের বুধপাড়ায় এসে বসতি স্থাপন করেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের এসব শিল্পীরা ৮৯৭ বঙ্গাব্দে (১৪৯০ খ্রিস্টাব্দ) শীষচন্দ্র চক্রবর্তীর দানকৃত জমিতে খড়ের ঘরে প্রতিষ্ঠা করেন শ্রী শ্রী কালীমাতা মন্দির।
পরে ১৩৩২ বঙ্গাব্দে জনৈক লাল কেনেডিয়ার স্ত্রী জানকী বাঈয়ের আর্থিক সহযোগিতায় পাকা মন্দির নির্মিত হয়। জমিদার পূণ্যচন্দ্র দাস মন্দিরের নামে প্রায় দেড়শ বিঘা জমি দান করেন। বর্তমানে কালীমন্দির ও গোবিন্দমন্দিরের আট বিঘা জমি ছাড়া বাকিগুলো বেদখল রয়েছে।
মন্দির কমিটির সহসভাপতি প্রদীপ কুমার সরকার বলেন, “মন্দিরের দানকৃত সম্পদগুলো উদ্ধারে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।”
৫৩৬ বছরের ঐতিহ্য, ২৩ ফুট উচ্চতার প্রতিমা, হাজারো ভক্তের মিলনমেলা—সব মিলিয়ে বুধপাড়ার কালীপূজা আজও ধর্মীয় ঐতিহ্যের অনন্য প্রতীক।