রবিবার | ২ নভেম্বর, ২০২৫ | ১৭ কার্তিক, ১৪৩২

মৃত্দেহকে জীবনের পাঠে দানের নানা দৃষ্টিভঙ্গি

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
গত ২ অক্টোবর ২০২৫ চলে গেলেন ভাষা সৈনিক, প্রাবন্ধিক, চিন্তাশীল ব্যাক্তিত্ত্ব মরহুম আহমদ রফিক। জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী, মুক্তচিন্তার অগ্রদূত, মানবতার সাধক। মৃত্যুর পরেও তিনি আলোড়ন তুললেন এক সিদ্ধান্তে নিজের দেহ দান করলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য। তাঁর জানাজা হয়নি, কবরও হয়নি। এই খবর সমাজে কিছু মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে এক দ্বিধার সঞ্চার করেছে।এ কি এক মহৎ মানবিক দান, নাকি এটি কেবল ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসনের বাইরে এক দার্শনিক অবস্থান?
এই প্রশ্নগুলোকে একপাক্ষিকভাবে দেখা যাবে না। মরহুম আহমদ রফিক ছিলেন এমন এক মানুষ, যিনি সারাজীবন যুক্তি ও বিবেকের চর্চা করেছেন। তাঁর দেহদানের সিদ্ধান্ত সেই ধারাবাহিকতারই ফল। তিনি বিশ্বাস করতেন, মৃত্যুর পরও মানুষ অন্যের কল্যাণে আসতে পারে। তাঁর শরীর এখন মেডিকেল শিক্ষার্থীদের গবেষণায় কাজে লাগবে। ভবিষ্যৎ চিকিৎসকরা শিখবে মানবদেহের গঠন, রচনা ও রহস্য। এই শিক্ষার মধ্যেই নতুন জীবন রক্ষার সম্ভাবনা। তাই এক অর্থে আহমদ রফিক তাঁর মৃত্যুকেও জীবনের পাঠে পরিণত করেছেন।
কিন্তু অনেকের জানতে ইচ্ছে করছে, ইসলাম কি এই কর্মকে সমর্থন করে? ইসলামী শরীয়তের মূল উদ্দেশ্য (মাকাসিদ আল-শারিয়া) হলো জীবন, জ্ঞান, সম্পদ, বংশ ও ধর্মের সুরক্ষা। ইসলামী চিন্তাবিদদের অনেকেই বলেছেন, যদি কোনো কাজ মানবজীবন রক্ষায় সহায়তা করে, তবে সেটি শরীয়তের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। দেহদানও সেই উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, যদি তা হয় স্বেচ্ছায় এবং মানবকল্যাণে।
কবরের আজাবের প্রসঙ্গে সামাজিক কৌতূহল আরও বেশি। কেউ কেউ বলছেন, যেহেতু কবর হয়নি, রফিক সাহেব আজাব থেকে মুক্ত। কিন্তু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ভ্রান্ত ধারণা। কবরের আজাব কোনো স্থানের শারীরিক প্রক্রিয়া নয়।এটি আত্মার অভিজ্ঞতা, যা নির্ভর করে জীবনের কর্মফল ও নিয়তের ওপর। আত্মা আল্লাহর ইচ্ছায় বিচারপ্রাপ্ত হয়; মাটি, কাঠ বা ল্যাবরেটরি সেই বিচারকে প্রভাবিত করতে পারে না।
তাহলে কি মরহুম আহমদ রফিক ইসলামী বিধান অমান্য করেছেন? না, বরং তিনি মানবতার এক বিকল্প ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। তাঁর সিদ্ধান্ত আমাদেরকে ভাবায়, ধর্মের মর্মার্থ কি কেবল আচারবিধির অনুকরণ, নাকি মানবকল্যাণে তা প্রয়োগ? ইসলাম যেমন জানাজা ও দাফনের শিক্ষা দেয়, তেমনি শেখায় জ্ঞান অর্জন ও জীবন রক্ষা ইবাদতের সমান। তাই একে কেবল সুন্নত অমাননা হিসেবে দেখা ঠিক নয়। বরং এটি হতে পারে এক যুক্তিনির্ভর মানবিক ব্যাখ্যা।
অবশ্য এও সত্য এই সিদ্ধান্ত অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে আঘাত দিয়েছে। কারণ সমাজে মৃত্যুকে ঘিরে যে আবেগ তা শুধু ধর্মীয় নয়। তা পারিবারিক, সামাজিক ও ঐতিহ্যগত। প্রিয়জনের জানাজা না হওয়া, কবর না থাকা, এ যেন আবেগের এক অচেনা শূন্যতা। আহমদ রফিক সেই শূন্যতাকেই যুক্তির আলোয় প্রশ্ন করেছেন।
বাংলাদেশে দেহদান এখনো বিরল। ধর্মীয় ভয়, কুসংস্কার ও সামাজিক দ্বিধা মানুষকে এ পথে আসতে নিরুৎসাহিত করে। অথচ উন্নত দেশে এটি মানবসেবার এক বড় প্রতীক। আহমদ রফিকের এই সিদ্ধান্ত হয়তো অনেকের চোখে বিতর্কিত, কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এটি হবে চিন্তার নতুন দরজা।
মরহুম আহমদ রফিক তাঁর জীবনে যেমন মুক্ত চিন্তার প্রচার করেছেন, মৃত্যুর পরও সেই আদর্শে অটল থেকেছেন। তাঁর দেহ হবে জ্ঞানের উপকরণ, তাঁর চিন্তা মানবতার সম্পদ। তিনি কবরের আজাব থেকে মুক্ত হবেন কি না, তা আল্লাহই জানেন। কিন্তু ইতিহাসের বিচারে তিনি চিরজাগ্রত, আলোকিত এক উদাহরণ হয়ে থাকবেন। মরহুম আহমদ রফিক কবর পাননি, কিন্তু তাঁর নাম খোদিত হয়েছে জাতির চেতনায় যেখানে ধর্ম, বিজ্ঞান ও মানবতার আলো একসূত্রে গাঁথা।
মরনোত্তর দেহদান (posthumous body donation) বা মৃত্যুর পর নিজের দেহ বৈজ্ঞানিক গবেষণা, চিকিৎসাশিক্ষা বা অন্যের জীবনরক্ষায় দান করা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও মানবিক প্রয়াস। কিন্তু মুসলমানদের জন্য ইসলামে মৃতদেহের প্রতি আচরণের নির্দিষ্ট নীতি ও ধর্মীয় বিধান রয়েছে। বিষয়টি ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে কিছুটা বিশ্লেষণ করা যাক্।
১. ইসলাম মৃতদেহের মর্যাদাকে অত্যন্ত উচ্চে স্থান দিয়েছে। হাদিসে বলা হয়েছে, “মৃত মুসলমানের হাড় ভেঙে ফেলা জীবিত অবস্থায় তার হাড় ভাঙার মতোই অপরাধ।”(সূত্র: আবু দাউদ, হাদিস ৩২০৭)। এ থেকে বোঝা যায়, মৃত্যুর পরও মানুষের দেহ ইসলামে সম্মানিত ও অক্ষত রাখার নির্দেশ রয়েছে। সুতরাং ইসলামের দৃষ্টিতে মৃতদেহ কাটা-ছেঁড়া, বিকৃত করা বা অসম্মানজনক আচরণ করা নিষিদ্ধ।
২. মানবকল্যাণে ব্যতিক্রমের সুযোগ আছে। তবে ইসলাম ‘মাসলাহা’বা জনকল্যাণের নীতিকে স্বীকৃতি দেয়। কুরআনে বলা হয়েছে, “যে কেউ একজন মানুষকে বাঁচায়, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে বাঁচালো।”(সূরা মায়িদা ৫:৩২)।
এই আয়াতকে ভিত্তি করে আধুনিক ইসলামি ফকিহদের অনেকে বলেছেন, যদি দেহ বা অঙ্গদান সরাসরি জীবনরক্ষায় সহায়তা করে, এবং দেহের প্রতি সম্মান বজায় রেখে তা করা হয়, তাহলে তা ‘মানবসেবামূলক ইবাদত’হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
৩. শরীয়তের আলোচনায় অঙ্গদান (organ donation) ও দেহদান (whole body donation)-এর মধ্যে পার্থক্য আছে। অঙ্গদান মানে কারো জীবন রক্ষার জন্য অঙ্গ প্রতিস্থাপন; আর দেহদান মানে মৃতদেহকে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগবেষণার কাজে ব্যবহার করা। অনেক ইসলামি চিন্তাবিদ, যেমন আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় (মিশর), ইসলামিক ফিকহ একাডেমি (জেদ্দা), এবং ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফতোয়া অ্যান্ড রিসার্চ তারা অঙ্গদানকে শর্তসাপেক্ষে বৈধ বলেছেন।
তবে দেহদান বিষয়ে অনেক বেশি সংরক্ষণশীল মত দেখা যায়। কারণ, এতে দেহ কাটাছেঁড়া হয়, যা ইসলামে নিষিদ্ধ। জানাজা ও কবর বিলম্বিত বা অনির্দিষ্ট হয়, দেহ ব্যবহারের পর অবশিষ্টাংশের যথাযথ দাফন নাও হতে পারে।
৪. ইসলামি বিশ্বে দেহদানের অনুমোদন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।অনেক মুসলিম রাষ্ট্র যেমন মালয়েশিয়া, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া ও মিসরে ফতোয়া বোর্ড দেহদানের বিষয়ে আলাদা ব্যাখ্যা দিয়েছে। কিছু মতামত বলছে, “যদি দেহদানের উদ্দেশ্য হয় চিকিৎসা শিক্ষা ও মানবকল্যাণ এবং পরবর্তীতে দেহ যথাযথ দাফন করা হয় তাহলে এটি বৈধ।”অন্যদিকে রক্ষণশীল আলেমরা বলেন, “এটি কবর ও জানাজার সুন্নত বিলোপ ঘটায় এবং মৃতদেহের মর্যাদাহানি ঘটায়, তাই হারাম।”
তবে এব্যাপারে বাংলাদেশেও ইসলামিক ফাউন্ডেশন বা দারুল ইফতা প্রতিষ্ঠানগুলোর আনুষ্ঠানিক ফতোয়া এখনো নেই। তবে স্থানীয় আলেমদের অধিকাংশই ‘অঙ্গদান শর্তসাপেক্ষে জায়েজ’বললেও সম্পূর্ণ দেহদানকে নিরুৎসাহিত করেন।
৫. ইসলামি বিধান অনুযায়ী প্রতিটি মুসলমানের জন্য জানাজা ফরজে-কিফায়া। দাফন করাও ফরজে-কিফায়া। মৃতদেহ যত দ্রুত সম্ভব দাফন করার নির্দেশ আছে। যদি কোনো মুসলমানের জানাজা ও দাফন না হয়, তাহলে সেটি ধর্মীয় কর্তব্যের লঙ্ঘন বলে গণ্য হয় যদিও দেহদানটি মানবকল্যাণমূলক উদ্দেশ্যে করা হয়।
ইসলাম মানবকল্যাণের যে কোনো উদ্যোগকে উৎসাহিত করে কিন্তু তা অবশ্যই ধর্মীয় সীমার মধ্যে হতে হবে। মরনোত্তর দেহদান নিঃসন্দেহে এক মহান বৈজ্ঞানিক প্রয়াস, কিন্তু মুসলমানের ক্ষেত্রে এর সঙ্গে জড়িত ধর্মীয় বিধান উপেক্ষা করা যায় না।
যদি কেউ দেহদান করতে চান, তাহলে জীবদ্দশায় স্পষ্টভাবে তার ইচ্ছা প্রকাশ করতে হবে। নতুবা মৃত্যুর পর জানাজা ও দাফনের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে, মরদেহ ব্যবহারের পর দেহ বা অবশিষ্টাংশ যথাযথভাবে দাফন করতে হবে। এভাবে মানবসেবা ও ধর্মীয় কর্তব্য দুই-ই রক্ষা করা সম্ভব। সুতরাং ইসলামী নীতিতে বলা যায়, দেহদান মানবকল্যাণে বৈধ হতে পারে, তবে জানাজা ও দাফনের বিধান বাদ দিয়ে নয়।
ভাষা আন্দোলনের অগ্নিযুগে তিনি যেমন কলমে ও চিন্তায় লড়েছেন, তেমনি জীবনভর থেকেছেন সামাজিক ন্যায় ও মানবিক মূল্যবোধের পক্ষে। কিন্তু মৃত্যুর পরেও তিনি আমাদের সামনে রেখে গেলেন এক গভীর ভাবনার প্রশ্ন, নিজের দেহ দান করে তিনি নতুন জীবনের পাঠ খুলে দিলেন চিকিৎসা শিক্ষার্থীদের জন্য।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেহ দান নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ বলেন, মানবদেহ চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে যদি তা মানবকল্যাণে হয় এবং মর্যাদা রক্ষা করা হয়। কারণ ইসলাম জীবনরক্ষাকে সর্বোচ্চ মূল্য দেয়। পবিত্র আল-কুরআনের ভাষায়, “যে একজন মানুষকে বাঁচায়, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে বাঁচায়।”(সূরা মায়িদা ৫:৩২)। এদিক থেকে মরহুম আহমদ রফিক তাঁর মৃত্যুর পরেও সেই মানবরক্ষা চেতনার অংশ হয়েছেন।
কিন্তু অনেকে বলছেন, ভাষা সৈনিকের জানাজা হলো না, কবর হলো না, কতটা বেদনাদায়ক! অবশ্যই এই অনুভূতি শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণযোগ্য। কারণ জানাজা আমাদের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক পরিচয়েরও অংশ।এটি মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা ও দোয়ার প্রকাশ। কিন্তু যদি একজন ভাষা সৈনিক মরহুম আহমদ রফিকের জন্য দোয়া করি, তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি তাহলে সেটিই অবশ্যই কল্যাণকর হতেও পারে। তিনি মাটিতে শোননি, কিন্তু কোটি মানুষের হৃদয়ে আজও স্থির হয়ে আছেন। তাঁর মৃত্যু আমাদের শেখায়, যে জীবন মৃত্যুর পরেও মানুষকে উপকার দেয় তার জন্য অনেকের মনে কৃতজ্ঞতার দরজা খুলে যায়।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.