
-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর মাসিক ব্যয়ের তালিকায় আজ নতুন এক আতঙ্কের নাম ওষুধের খরচ। বিদ্যুৎ, ভাড়া, বাজার ও স্কুলফি সামলে যখন পরিবারগুলো কষ্টেসৃষ্টে সংসার টিকিয়ে রাখছে তখন হঠাৎই চিকিৎসা ও ওষুধের খাত সেই টানটান ভারসাম্য ভেঙে দিচ্ছে। অনেক পরিবারে এখন ওষুধের জন্যই মাস শেষে ধারদেনা করতে হচ্ছে। কেউ কেউ প্রয়োজনীয় খাবার বা পোশাকে কাটছাঁট করছে, শুধু নিয়মিত প্রেসক্রিপশনের ওষুধ কেনার জন্য। এই হলো বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র। যেখানে কারো কঠিন অসুখ হলেই ওষুধ কেনার চিন্তা ও হাসপাতালের বিরাট খরচ মানুষকে হতাশ করে তুলছে। এমনকি অনেকের ক্ষেত্রেই পরিবারের চিকিৎসা খরচ এখন শিক্ষাখরচের চেয়েও বেশি।
আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর নিকট আগে যেখানে চিকিৎসা ব্যয় ছিল হঠাৎ রোগে পড়লে এককালীন চাপ, এখন সেটি পরিণত হয়েছে মাসিক বাজেটের স্থায়ী খাতে। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, থাইরয়েড, গ্যাস্ট্রিক বা অ্যালার্জির মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের ওষুধ কিনতে গিয়ে অনেক পরিবারই প্রতিমাসে কয়েক হাজার টাকা ব্যয় করছে। ফলত সংসারের খাদ্য, শিক্ষা বা সঞ্চয়ের খাত থেকে কেটে নিতে হচ্ছে ওষুধের জন্য বরাদ্দ। এই পরিস্থিতি যেন অসুখে নয়, ওষুধেই নিঃস্ব হওয়ার দুঃসহ বাস্তবতা তৈরি করছে।
আমাদের ওষুধ শিল্পে আত্মনির্ভরতার গল্প অনেক পুরনো। কিন্তু দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারি ভূমিকা প্রায় অদৃশ্য। একই উপাদান বা জেনেরিক নামের ওষুধের দাম বিভিন্ন কোম্পানিতে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ব্র্যান্ড সচেতনতা নামের এক অদৃশ্য মনস্তাত্ত্বিক বাণিজ্য চালাচ্ছে ওষুধ কোম্পানিগুলো, যেখানে ডাক্তার থেকে শুরু করে ফার্মেসি পর্যন্ত জড়িয়ে আছে প্রণোদনার অজস্র জাল। রোগীরা নিজের অজান্তেই এই অযৌক্তিক মূল্য ব্যবস্থার শিকার।
ওষুধের এই অগ্নিমূল্য পরিস্থিতির পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতা। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর কাগজে-কলমে দাম নির্ধারণ করলেও বাস্তবে ফার্মেসি পর্যায়ে তা মানা হয় না। একই জেনেরিক উপাদানের ওষুধের দাম কোম্পানিভেদে তিন থেকে চারগুণ পর্যন্ত পার্থক্য দেখা যায়। দ্বিতীয়ত, ডাক্তারদের ব্র্যান্ডনির্ভর প্রেসক্রিপশন সংস্কৃতি, যেখানে সাশ্রয়ী বিকল্প থাকলেও রোগীকে দেওয়া হয় দামি ওষুধের নাম। তৃতীয়ত, প্রণোদনা ও কমিশনের অঘোষিত চক্র, যা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর ব্যবসাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলেছে। এর ক্ষতি বহন করছে সাধারণ জনগণ।
আরেকটি বাস্তবতা হলো, সরকারি হাসপাতালের ওষুধ বিতরণ ব্যবস্থা কার্যকর নয়। প্রান্তিক পর্যায়ের ক্লিনিক ও উপজেলা হাসপাতালে ফ্রি মেডিসিন পাওয়া যায় এই ধারণা এখন প্রায় মিথে পরিণত হয়েছে। প্রয়োজনীয় ওষুধ নেই, আর যেগুলো আছে, মানের নিশ্চয়তা নেই। ফলে রোগীরা বাধ্য হয়ে বেসরকারি ফার্মেসির দ্বারস্থ হচ্ছেন, যেখানে দামও বেশি, নিয়ন্ত্রণও শিথিল।
একইসঙ্গে স্বাস্থ্যবীমা বা রাষ্ট্রীয় সহায়তার কোনো নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা না থাকায় জনগণ পুরো খরচ নিজে বহন করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয়ের প্রায় ৬৮ শতাংশই জনগণ দেয় নিজ পকেট থেকে। এই ‘আউট-অফ-পকেট’ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ। ফলে পরিবারগুলো একের পর এক আর্থিক বিপর্যয়ে পড়ে, কেউ কেউ চিকিৎসা মাঝপথে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।
অন্যদিকে দীর্ঘস্থায়ী রোগের ওষুধের ওপর সরকারি বা এনজিও পর্যায়ের সহায়তা কার্যক্রম প্রায় নেই বললেই চলে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কমমূল্যের জরুরী ওষুধ বা ‘Essential Drug List’-এর অনেক ওষুধ বাজারে পাওয়া যায় না বা মান নিয়ে সন্দেহ থাকে। ফলে রোগীরা বাধ্য হয়ে উচ্চমূল্যের ব্র্যান্ডে ঝুঁকছেন। সরকারি হাসপাতালগুলোয় ফ্রি ওষুধ বিতরণের যে উদ্যোগ, তা নগরীর বাইরে প্রান্তিক পর্যায়ে প্রায় অকার্যকর হয়ে গেছে।
তাহলে্ এসব সমস্যার সমাধান কোথায়? এজন্য দ্রুত ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি। যেভাবে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ, গ্যাস, এমনকি দুধের দামও সরকার নির্ধারণ করে, সেভাবেই ওষুধ খাতে একটি ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ কমিশন গঠন করা যেতে পারে। জেনেরিকভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ করলে সাধারণ মানুষের নাগালে দাম অনেকটাই কমে আসবে। এ ছাড়া সারা দেশে সরকারি হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর ওষুধ সরবরাহ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা দরকার। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সঠিকভাবে সকল জরুরী ওষুধ পৌঁছে দিলে জনগণের ওপর বেসরকারি খাতের চাপ কমবে।
জরুরী ভিত্তিতে জনসচেতনতা ও ওষুধ শিক্ষা বাড়ানো দরকার। অনেক মানুষ অপ্রয়োজনে ওষুধ কিনে মজুত রাখে, আবার কেউ কেউ বিজ্ঞাপন দেখে বা প্রতিবেশীর পরামর্শে ওষুধ খায়। এতে শুধু অর্থ অপচয় নয়, বরং প্রতিরোধক্ষমতা হ্রাস ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি বাড়ে। ডাক্তারদেরও উচিত রোগীদের ব্যয়বহুল ওষুধের বিকল্পে সাশ্রয়ী ব্র্যান্ডের পরামর্শ দেওয়া।
উন্নত বিশ্বের ন্যায় আমাদেরও জেনেরিক ওষুধ ব্যবহারের সংস্কৃতি গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। উন্নত দেশগুলোয় ডাক্তাররা প্রেসক্রিপশনে ওষুধের ব্র্যান্ড নয়, জেনেরিক নাম লেখেন। যাতে রোগী সাশ্রয়ী বিকল্প বেছে নিতে পারে। বাংলাদেশেও এই পদ্ধতি আইনি বাধ্যবাধকতা দিয়ে চালু করা যেতে পারে।
আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার অসমতা ও অপূর্ণতার প্রতিফলন দীর্ঘদিনের। সরকার বহুদিন ধরে প্রাথমিক চিকিৎসা, মাতৃস্বাস্থ্য ও টিকাদান কর্মসূচিতে সফলতা দেখালেও সর্বজনীন স্বাস্থ্যসুরক্ষা এখনও কাগুজে অঙ্গীকারেই আটকে আছে। অথচ এই বাস্তবতায় একমাত্র টেকসই সমাধান হতে পারে সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা ব্যবস্থা। যা খুব সহজেই পরিবারকে ওষুধের বিগ বাজেটের দুঃসহ চাপ থেকে মুক্তি দিতে পারে।
বাংলাদেশে কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলেও সেখানে সরকারি কোনো নিরাপত্তা না পেয়ে সরাসরি বাজার থেকে ওষুধ কিনতে বলা হয়। যা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য প্রায় অসম্ভব এক বোঝা। অথচ থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম বা শ্রীলঙ্কার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সরকার নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্যবীমা ব্যবস্থা চালু আছে, যেখানে নাগরিকের মাসিক বা বার্ষিক একটি ক্ষুদ্র অংশগ্রহণেই রোগ, ওষুধ ও চিকিৎসা খরচ বহন করে রাষ্ট্র।
আমাদের দেশে এই ধারণা একেবারেই নতুন নয়। ২০১৬ সালে টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে পাইলট প্রকল্প হিসেবে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট (HEU) বা ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি’চালু করা হয়েছিল। সেখানে দরিদ্র পরিবার মাসে মাত্র ৩০-৫০ টাকা প্রিমিয়াম দিয়ে বছরে ৫০ হাজার টাকার চিকিৎসা সুবিধা পেত। এই উদ্যোগ সফল হলেও সেটি আর বিস্তৃত হয়নি আমাদের প্রশাসনিক স্থবিরতা ও নীতিগত অনিচ্ছার কারণে। অথচ ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো এই স্বাস্থ্যবীমা ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণের স্বাস্থ্যব্যয় ৫০ শতাংশেরও বেশি কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।
তবে স্বাস্থ্যবীমা কার্যকর করতে হলে তিনটি শর্ত অত্যাবশ্যক। প্রথমত, রাষ্ট্রকে এই বীমা ব্যবস্থার অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি করতে হবে। প্রাথমিকভাবে সরকারি-বেসরকারি কর্মচারীদের বাধ্যতামূলক বীমার আওতায় আনা যেতে পারে। পরে ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণিকেও যুক্ত করা সম্ভব। সরকার চাইলে প্রতিটি পরিবারের জন্য একটি ন্যূনতম স্বাস্থ্য প্রিমিয়াম কার্ড চালু করতে পারে, যার মাধ্যমে পরিবারের সদস্যরা নির্দিষ্ট তালিকাভুক্ত হাসপাতালে চিকিৎসা ও ওষুধ সুবিধা পাবেন। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘস্থায়ী রোগের ওষুধের জন্য বিশেষ কাভারেজ রাখা উচিত। যেমন, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ বা কিডনি রোগের রোগীদের জন্য মাসিক নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওষুধ ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে। এতে পরিবারের মাসিক ওষুধ ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে। তৃতীয়ত, ডিজিটাল প্রেসক্রিপশন ও চিকিৎসা ডাটাবেজ চালু করতে হবে, যাতে রোগীর ইতিহাস, ওষুধের ব্যয় ও বীমা দাবির স্বচ্ছতা বজায় থাকে। এর ফলে দুর্নীতি ও অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যয় কমতে পারে।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো এ ব্যাপারে জনসচেতনতা না থাকা। আমাদের সমাজে স্বাস্থ্যবীমা নিয়ে এখনো মানুষের মনে সন্দেহ আছে। অনেকে মনে করেন এটি জটিল বা প্রতারণাপূর্ণ প্রক্রিয়া। অথচ এটি নাগরিকের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। রাষ্ট্রীয় প্রচারণা, গণমাধ্যমে সচেতনতা কর্মসূচি ও স্থানীয় প্রশাসনের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই ধারণা সহজভাবে প্রচার করতে হবে।
আমাদের দেশে ওষুধ শিল্পে সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা জরুরি। বড় বড় ওষুধ কোম্পানিগুলো কোটি কোটি টাকা মুনাফা করে, কিন্তু দরিদ্র জনগণের সহায়তায় তাদের ভূমিকা প্রায় নেই। সরকার চাইলে কর্পোরেট স্যোশাল রেসপন্সিবিলিটি বা CSR-এর একটি অংশ সাশ্রয়ী ওষুধ তহবিলে রাখার নিয়ম তৈরী করতে পারে। যদি রাষ্ট্র চায় তবে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অনুযায়ী সর্বজনীন স্বাস্থ্যসুরক্ষা অর্জন সম্ভব। তখন পরিবারগুলো আর ওষুধের দোকানে বাজেট গুণতে বসবে না। মানুষ তখন রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির কাভারে নিশ্চিন্ত থাকবে।
আমাদের নীতি নির্ধারকদের মনে রাখতে হবে ওষুধের বিগ বাজেট সংকুলানের এই যুদ্ধে একা কোনো পরিবার টিকতে পারবে না। প্রয়োজন একটি সম্মিলিত রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, যেখানে সুস্থ থাকা আর ধনী-গরীব থাকা দুটি আলাদা জিনিস হবে না। সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমাই হবে সেই সেতুবন্ধন। আর এই স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা নাগরিককে পারিবারিক ওষুধ কেনার পাহাড়সম বাজেটের দুশ্চিন্তামুক্ত ও রোগমুক্ত সুন্দর জীবন উপহার দিতে পারে।
× প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]