শনিবার | ২২ নভেম্বর, ২০২৫ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

নাটোর–১: কোন্দল ও এক্স–ফ্যাক্টরে জটিল হচ্ছে বিএনপির পথ

নাটোর প্রতিনিধি :

আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নাটোর–১ (লালপুর–বাগাতিপাড়া) আসনে বিএনপির প্রাথমিক প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে কোন্দলে তৃণমূলে তৈরি হয়েছে চরম অস্বস্তি। প্রয়াত যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা ফজলুর রহমান পটলের মেয়ে ব্যারিস্টার ফারজানা শারমিন পুতুলকে ধানের শীষের সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন তাঁর বড় ভাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ও নাটোর জেলা বিএনপির সদস্য  ডা. ইয়াসির আরশাদ রাজন। মনোনয়নপ্রত্যাশী রাজন বোনের পরিবর্তে নিজেকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন।
এদিকে রাজনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহদপ্তর সম্পাদক এড. তাইফুল ইসলাম টিপু। তিনি ইতোমধ্যে নির্বাচনী ইশতেহারও ঘোষণা করেছেন। ফলে রাজপথে পুতুল–বিরোধী কর্মসূচিতে এখন টিপু ও রাজনের অনুসারীরা একসঙ্গে সক্রিয়। প্রতিদিনই লালপুর ও বাগাতিপাড়ার বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ, বিক্ষোভ ও অগ্নিসংযোগ, লালকার্ড প্রদর্শন এবং মশাল মিছিলের মত ঘটনা ঘটছে। যা দলের সাধারণ কর্মী সমর্থকদের  ফেলেছে বিভ্রান্তিতে। এতে তৃণমূলে তৈরি হয়েছে বিভাজন ও অস্বস্তি।
জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা হিসেবে পুতুলের পক্ষে কাজ করতে নির্দেশনা দেওয়া হলেও স্থানীয় পর্যায়ে বহু নেতা-কর্মী সেটি মানছেন না। পাশাপাশি আগামী নির্বাচনের ফলাফলে তরুণ ভোটার ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মী সমর্থকরা অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। সেক্ষেত্রে তারা হয়ে উঠতে পারেন বড় এক্স ফ্যাক্টর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ফজলুর রহমান পটলের মৃত্যুর পর ২০১৮ সালের নির্বাচনে এই আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন পুতুল ও রাজনের মা পটল পত্নী অধ্যক্ষ কামরুন্নাহার শিরিন। নির্বাচনের পর শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি ভবিষ্যতে নির্বাচন না করার ঘোষণা দেন তখন। এরপর পরিবারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব হাতে নেন পটলের বড় ছেলে ডা. ইয়াসির আরশাদ রাজন ও মেয়ে পুতুল। স্থানীয় বিএনপির রাজনীতি তখন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একাংশ পটল পরিবারের নেতৃত্বে ও একাংশ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-দপ্তর সম্পাদক এড. তাইফুল ইসলাম টিপু নেতৃত্বে  আবর্তিত হতে থাকে। ২০২২ সালে বাগাতিপাড়া পৌরসভা নির্বাচনে টিপু ঘনিষ্ঠ শরিফুল ইসলাম লেলিন মেয়র নির্বাচিত হন। ২৩ অক্টোবর, ২০২৩ ডা. রাজনকে লালপুর উপজেলা বিএনপির আহবায়ক ঘোষণা করা হয়। জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজন ও টিপুকে ঘিরে দলীয় কর্মসূচি পালন করতে থাকেন স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা। বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য ও নাটোর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক ব্যারিস্টার ফারজানা শারমিন পুতুল বড় ভাই রাজনের সঙ্গে স্থানীয় বিএনপি’র কর্মসূচিতে বড় ভূমিকা রাখেন। এদিকে ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ লালপুর উপজেলা বিএনপি’র কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণার পর ২৪ মার্চ, ২০২৫ নাটোর জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটিতে ব্যারিস্টার ফারজানা শারমিন  পুতুলকে যুগ্ম আহ্বায়ক ও ডা. ইয়াসির আরশাদ রাজনকে সদস্য পদ দেয়া হয়। তবে অজানা কারণে এরপর থেকে ভাই বোনের দূরত্ব বাড়তে থাকে। অভ্যন্তরীণ এ দ্বন্দ্ব নিরসনে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন নির্দেশনা দিলে শেষ পর্যন্ত তার স্থায়ী সমাধান হয়নি। চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে  মা শিরিন মেয়ে পুতুলকে পটল পরিবারের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেন। কিন্তু রাজন এই সিদ্ধান্ত মেনে না নিয়ে নিজস্ব অনুসারী নিয়ে দলীয় মাঠে সক্রিয় থাকেন। অক্টোবর মাস জুড়ে ভাই–বোনের সঙ্গে আরেক প্রার্থী তাইফুল ইসলাম টিপু মনোনয়নের জন্য তৎপর ছিলেন। গত ৩ নভেম্বর, ২০২৫ বিএনপি নাটোর-১ আসনে পুতুলকে ধানের শীষের মনোনীত প্রার্থী ঘোষণা করলে অন্ত:কোন্দল প্রকট আকারে প্রকাশ্যে আসে। রাজনের অনুসারীরা প্রতিবাদে রাজপথে নামে। একই দাবিতে টিপু গ্রুপও আন্দোলনে যুক্ত হয়। উল্লেখ্য, টিপু ২০১৮ সালেও বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন।
বিএনপির ত্রিমুখী বিভাজন, সুযোগ নিচ্ছে জামায়াত
স্থানীয় বিএনপি নেতাদের ভাষ্য—দল এখন তিন ভাগে বিভক্ত। পুতুল–টিপু–রাজন সমর্থকদের পৃথক অবস্থান বিএনপির মাঠের কার্যক্রমে বিপর্যয় তৈরি করেছে। এ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে জামায়াতে ইসলামী ধীরে ধীরে মাঠে প্রভাব বৃদ্ধি করছে। ভোটারদের সঙ্গে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ, দলীয় ঐক্য ও স্থানীয়-কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয় তাদেরকে দিচ্ছে বাড়তি আত্মবিশ্বাস।
লালপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্যসচিব হারুনুর রশীদ পাপ্পু বলেন,“দল যাকে মনোনয়ন দিয়েছে, তার পক্ষে কাজ করাই কর্মীদের দায়িত্ব। যারা বিরোধিতা করছে, তারা দলীয় সিদ্ধান্ত মানছে না।”
বাগাতিপাড়া উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক পৌর মেয়র শরিফুল ইসলাম লেলিন বলেন, “টিপু দুঃসময়ে হামলা-মামলা সয়ে দলের জন্য কাজ করেছেন। তাঁর কাছে নেতাকর্মীদের আস্থা বেশি। আমরা চাই চূড়ান্ত মনোনয়নে এই ত্যাগী নেতাকে মূল্যায়ন করা হোক।”
লালপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহবায়ক অধ্যাপক আশরাফুল আলম লুলু বলেন, “পটলের মৃত্যুর পর লালপুর – বাগাতিপাড়ায় সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা রাজন। দলের দুর্দিনে তিনি স্থানীয় বিএনপিকে আগলে রেখেছিলেন। ধানের শীষের বিজয় নিশ্চিত করতে হলে ত্যাগী এই নেতাকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দিতে হবে।”

নির্বাচনের এক্স-ফ্যাক্টর :
এবারের নির্বাচনের একটা বড় অংশ তরুণ, যারা প্রথমবার ভোটাধিকার  প্রয়োগ করবে। তাদের মতে এবারের নির্বাচনে ব্যক্তি ইমেজ একটি বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। পাশাপাশি স্থানীয় সাধারণ আওয়ামী কর্মী সমর্থকদের ভোট ব্যাংক নির্বাচনে বড় প্রভাব রাখবে। উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, উপজেলার অধিকাংশ নেতারা এই মুহূর্তে জেলে রয়েছেন। তারা সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। একইসাথে ধারণা করছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারবে না। সেক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনে বিএনপি কিংবা জামায়াতের যে প্রার্থীর কাছে তারা নিরাপদ থাকবেন, তাকেই তারা ভোট দিবেন এমনটাই সিদ্ধান্ত আসতে পারে  বলে জানিয়েছেন তারা।

প্রার্থীদের অবস্থান:
ডা. ইয়াসির আরশাদ রাজনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তবে সম্প্রতি তিনি একাধিক বার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলেছেন। তিনি কোথাও যাচ্ছেন  না জানিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য সবাইকে ধৈর্য ধরতে বলেছেন।
তাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, দলীয় মনোনয়নের জন্য শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করব। লালপুর – বাগাতিপাড়ার মানুষের জন আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করার সাধ্য আমার নাই। প্রয়োজনে স্বতন্ত্র নির্বাচন করব।
ব্যারিস্টার ফারজানা শারমিন পুতুল বলেন, এই আসনে মনোনয়ন নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। ভাই মনোনয়ন পেলে আমি তাঁর জন্য কাজ করতাম। তেমনি আমি পেয়েছি বলে তিনিও আমার পক্ষে কাজ করবেন বলে বিশ্বাস করি।
জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, দলবিরোধী আচরণ বরদাস্ত করা হবে না। শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে।

সম্পাদনায় : রাশিদুল ইসলাম রাশেদ

সাব এডিটর, প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.