
-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
ডেঙ্গু এখন বাংলাদেশের শহর গ্রাম নির্বিশেষে সব মানুষের নিকট চিরচেনা আতঙ্ক। এক সময় বর্ষানির্ভর এ রোগটি আজ সারাবছর সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। এর প্রাদুর্ভাব কখনও কম, কখনও বেশি কিন্তু কখনোই থামছে না। চারদিকে সবাই প্রশ্ন করছেন এবার কেন ডেঙ্গুর প্রতাপ দমছে না? উত্তর একটাই তা হলো, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমাদের পরিকল্পনা মৌসুমি কিন্তু ডেঙ্গু এখন বারোমাসী রোগ। তাই এর নিয়ন্ত্রণে সমাধানও হতে হবে সারাবছরের সমন্বিত উদ্যোগে।
বাংলাদেশে বছরের পর বছর এর সংক্রমণ বাড়ছে, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। আর আমরা বহুদিন ধরে এর চিকিৎসায় প্রায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। কীটনাশক স্প্রে, ফগিং, মাইকিং, জরুরি সভা করছি কিন্তু সামগ্রিকভাবে ডেঙ্গু দমছে না। তাই দ্রুত ডেঙ্গুকে একটি জাতীয় স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে স্বীকার করা উচিত। এটা কেবল মৌসুমি নগর সমস্যা নয়, গোটা দেশের সমস্যা। ডেঙ্গু এখন জলবায়ু-নির্ভর রোগ, সারাবছর ঝুঁকি তৈরি করে। তবু আমাদের অধিকাংশ উদ্যোগ শুরু হয় বর্ষা মৌসুমের পরে বা সংক্রমণ বাড়ার পর। কিন্তু প্রয়োজন আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া, বারোমাসি পরিকল্পনায় এনে এর জন্য সারাবছরের বাজেট এবং নতুনভাবে প্রশিক্ষিত স্থায়ী কর্মী নিয়োগ করা।
বেশ কবছর ধরে ডেঙ্গুকে মৌসুমি সমস্যা হিসেবে দেখার ভুলটি আমাদের বারবার ব্যর্থ করছে। সংক্রমণ বাড়লেই তৎপরতা, কমলেই কাজের মধ্যে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। এই চক্র বহু বছর ধরে চলছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন এডিস মশার প্রজননকে এমনভাবে বদলে দিয়েছে যে শীতকালেও সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। সুতরাং, যে রোগ সারা বছর সক্রিয়, তার সমাধান মৌসুমি পদ্ধতিতে সম্ভব নয়।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমাদের বারোমাসী পরিকল্পনার মূল ভিত্তি হওয়া উচিত এর উৎস ধ্বংসের কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা। ফগিং বা স্প্রেতে মশা সাময়িক কমে, কিন্তু জন্মস্থান অক্ষত থাকলে কয়েক দিনের মধ্যে আবার বাড়ে। তাই প্রতিটি ওয়ার্ডে স্থায়ীভাবে সাপ্তাহিক উৎস শনাক্ত অভিযানও মাসিক উৎস ধ্বংস টাস্কফোর্স চালু করতে হবে। নাগরিকদের বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশনের তদারকি আরও কঠোর হওয়া জরুরি।
এছাড়া কীটনাশকের মান নিয়ন্ত্রণ এবং বৈজ্ঞানিক তত্ত্বাবধান ছাড়া ডেঙ্গু দমন হবে না। অতীতে অকার্যকর ওষুধ ব্যবহারের অভিযোগ ছিল; আবার অনেক সময় পুরোনো ফর্মুলা দিয়েই অভিযান চলে। বারোমাসী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রয়োজন আন্তর্জাতিক মানসম্মত কীটনাশক কিনে ব্যবহার, গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা, এবং তদারকিতে বিশেষজ্ঞদের বাধ্যতামূলক উপস্থিতি।
আমরা জানি নগর অবকাঠামোর উন্নয়ন ছাড়া যেকোনো পরিকল্পনাই অর্ধেক বাকী থেকে যায়। জলাবদ্ধতা, বন্ধ ড্রেন, নির্মাণাধীন ভবনের খোলা পানি এগুলো এডিস মশার স্থায়ী আবাসস্থল। বারোমাসী পরিকল্পনার একটি বড় অংশ হওয়া উচিত ড্রেনেজ সংস্কার, নির্মাণকাজে নিয়মিত পরিদর্শন এবং দু’একটি প্রজেক্টভিত্তিক না করে সারাবছরের জন্য সকল অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ করার উদ্যেগ নেয়া।
আমাদের দেশে নগর পরিকল্পনার চিরায়ত বিশৃঙ্খলা বিরাজমান। প্রশাসনের তদারকির অভাব এবং নাগরিকদের উদাসীনতা মিলিয়ে এডিস মশা যেন রাজ্যের মালিকানা পেয়েছে। শহর ও পৌরসভা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, প্রতিটি সংস্থা আলাদাভাবে কিছু করছে। কিন্তু একীভূত কর্মপরিকল্পনা নেই। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে দায় ঠেলাঠেলি করা যেন প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বারোমাসি প্রস্তুতি না থাকলে রোগ বাড়লে হাসপাতালগুলো হিমশিম খেতেই থাকবে। যেমনটা গত কয়েক বছর ধরে হচ্ছে। প্রতিটি জেলা হাসপাতালে স্থায়ী ডেঙ্গু কর্নার, সারাবছর নার্স-চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ, পর্যাপ্ত স্যালাইন, প্লেটিলেট টেস্ট সুবিধা, এবং দ্রুত রেফারেল ব্যবস্থা থাকতে হবে।
পুরো দেশ বা সিটি কর্পোরেশনগুলোতে প্রতিটি ওয়ার্ডের অলি-গলিতে সংক্রমণের ডেটাভিত্তিক সিদ্ধান্তই হতে পারে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের মূল অস্ত্র। কোন এলাকায় কত সংক্রমণ, কোন ঋতুতে কোন প্রজাতির মশা বাড়ছে, কোন ওষুধ বেশি কার্যকর এসব তথ্য নিয়মিত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ জরুরি। কিন্তু আমরা এখনো তথ্য-প্রতিবেদনের অভাবে নীতি গ্রহণ করি আন্দাজে যা বারোমাসী পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে।
তাই ডেঙ্গুর পরিবর্তনশীল চরিত্রের উপর নজর রেখে মাঠ পর্যায়ে এর গবেষণা বাড়াতে হবে। ডেঙ্গুর ভাইরাসের ধরন প্রতি বছর বদলায়, সংক্রমণের গতি বদলায়, রোগীর প্রতিক্রিয়াও পরিবর্তিত হয়। অথচ দেশে গবেষণা সীমিত, নীতি প্রণয়নে গবেষণা-ভিত্তিক সিদ্ধান্তের অভাব আরও সীমিত। প্রত্যেক বছর একই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু রোগের আচরণ সে অনুযায়ী ধরা পড়ছে না।
প্রতি বছর একই দৃশ্য দেখা গেলেও এবারের সংক্রমণ পরিস্থিতি সব কিছু ছাপিয়ে ভয়াবহতা জানান দিচ্ছে। এবছর শীতের আমেজ এসে পড়লেও এর সংক্রমণের উর্ধ্বগতি, হাসপাতালজুড়ে রোগীর চাপ, মৃত্যুর মর্মান্তিক খবর অনেক বেশী। নভেম্বর ১৭, ২০২৫ তারিখ পর্যন্ত সারা দেশে চুরাশি হাজার ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।তন্মধ্যে মারা গেছেন ৩৩১ জন। যা স্মরণকালে যে কোন বছরের মৃত্যুসংখ্যার চেয়ে বেশী। কিন্তু সমাধানের জায়গায় যেন একই স্থবিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ডেঙ্গুর টিকা বা ওষুধ যতই উন্নত হোক মূল প্রশ্নটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।তা হচ্ছে, আমরা কি ডেঙ্গুকে সত্যিকারভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি? যদি যথাযথ গুরুত্ব দিতাম তাহলে বছর বছর একই ভুল, একই মৃত্যু, একই আতঙ্ক দেখতাম না। রোগীর স্বজনরা আক্ষেপ করে বলছেন, ডেঙ্গু দমানো যাচ্ছে না কারণ আমরা চাইলে যেভাবে পারতাম সেভাবে এখনো চেষ্টা শুরুই করিনি।
যে কোন গণসর্ম্পকিত সমস্যা মোকাবেলায় নাগরিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ রাখা সবচেয়ে কঠিন কাজ। এডিস মশা মানুষের ঘরেই জন্মায়। ফুলদানি, টব, ছাদ, বারান্দার টব, অল্প পানি জমা কোনো পাত্র পেলেই এডিসরা খুশি হয়ে বংশ বিস্তার শুরু করে। তাই বারোমাসী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নাগরিকদের বাধ্যতামূলক সাপ্তাহিক ঘরপরিস্কার কার্যক্রমকে আইনি কাঠামো ও সামাজিক আন্দোলনের পর্যায়ে নিতে হবে।
যতদিন আমরা আগের বছরের মতো একই মৌসুমি প্রচারণায় আটকে থাকব ততদিন ডেঙ্গু দমবে না । ডেঙ্গু চরিত্র এখন বারোমাসী, তাই সমাধানও বারোমাসী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। এটি কেবল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা সিটি করপোরেশনের কাজ নয়। এটি সমগ্র রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজের যৌথ দায়িত্ব।
ডেঙ্গু দমছে না কারণ দিনে দিনে এই সমস্যা জটিল হয়ে পড়েছে। তাই বলে এর সমাধান অসম্ভব নয়। এজন্য সমন্বিত উদ্যোগ, বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা, কঠোর তদারকি এবং নাগরিক অংশগ্রহণ, এই চারটি স্তম্ভে সমস্বরে দাঁড়ালেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এখনই সময় সুসংগঠিত উপায়ে সারাবছরের জন্য গবেষণাভিত্তিক, কঠোর এবং জবাবদিহিমূলক বারোমাসী ডেঙ্গু পরিকল্পনা বাস্তবায়নের। এখন জরুরী ভিত্তিতে তা করা না হলে আগামী বছরও আমরা একই প্রশ্ন করব কোন অবস্থাতেই দমছে না কেন ডেঙ্গু? কিন্তু আপনার আশেপাশের কোন মানুষ এর সদুত্তর জানেন না। তাই এটা কোনভাবেই কারো কাছে কাম্য নয়।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]