
প্রশান্ত রায়।।
সাস্ট। মেইন গেট থেকে খানিকটা ভিতরে। কাঁচা পাকা রাস্তা হেঁটে প্রায় এক কিলো। তারপর গোল চত্বর।
গোলচত্বরের ঠিক আগেই বাম দিকে একটা টিনসেড। চারটা কক্ষ। প্রথমটায় ছোট্ট একটা কক্ষে সোনালী ব্যাংক।
তারপর ক্যান্টিন। স্টুডেন্ট ও শিক্ষকদের জন্য একটা করে কক্ষ বরাদ্ধ। খাবারের অপ্রতুলতা সবসময়ই ছিল ক্যান্টিনে। মান ও খারাপ। কিন্তু কিছু করার ছিল না। খাওয়ার জন্য ওই একটাই। দ্বিতীয় কোন অপশন ছিল না। আড্ডা যা সব এখানেই …।
একবার ক’জন বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছি। শিশ দিয়ে গান তোলা আমার পুরানো অভ্যেস। স্কুল জীবনে একবার শিশ দিয়ে গান গাচ্ছিলাম। নিতীশ স্যার কখন যে ক্লাশে ঢুকেছেন টের পাইনি। তারপর তো ইতিহাস…। আমাকে টিচার্স রুমে নিয়ে জোড়াবেত দিয়ে বেদম পিটানো। ভুলবার নয়। তো ভার্সিটির ক্যান্টিনে তখন শিশ দিয়ে “গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ” গানটা বাজাচ্ছিলাম। হঠাৎ পাশের রুম থেকে স্যারের ডাক। স্যার কখন আসলেন তাও টের পাইনি। গেলাম। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শ্যামল (Shyamal Kumar Das) স্যার। “তুমি গাইছিলে?”, মাথা নিচু করে বললাম “জী, স্যার”। মনে মনে নিতীশ স্যারের কথা মনে পরলো। শ্যামল স্যার আমায় অবাক করে বললেন, “ভালোই তো সুর তুলতে পারো, কন্টিনিউ করিও”। এই ছিল সাস্টের স্যার-ছাত্রের আন্তরিকতার সম্পর্ক।
সবশেষের কক্ষে পোস্ট অফিস। বাবা মা ও দূর দূরান্তের বন্ধু বান্ধবদের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। ঠিক একমাত্র না। ফোনও আসতো কারো কারো। ফোন আসতো রেজিস্টার অফিসে। সেখান থেকে হলের এক্সটেনশনে। তারপর হল গার্ডের হাঁক দিয়ে ডাক। ২১৫ বি, শান্তদা…..।
নিজের নামটা শোনার পর পরি-মরি করে ভোঁ দৌড়। শাহপরান হলে আমার রুম থেকে বেশ দূরে ফোন ধরার রুম। তারপর দৌড়ে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ফোন ধরা। মা’য়ের ফোন। আহ্ কি শান্তি। দিনগুলো মোর সোনার খাঁচায়, এখনো…।
হলের ফোনের আরেকটা বড় আকর্ষন ছিল, ছেলেদের একমাত্র শাহপরান হল টু একমাত্র অর্ধনির্মিত ছাত্রীহলের এক্সটেনশন টু এক্সটেনশনে বিনা পয়সার ফোন কল। কত যে লাইন, কত অপেক্ষা! কেউ শুরু করলে ছাড়ে না। এটা ছিল মূলত কাপলদের জন্য বেশী আকর্ষনিয়।
বর্তমানরা এগুলোর মর্ম বুঝবে না। তখন ইন্টারনেট তো দূরের কথা মোবাইলই ছিল না। তাই এই একটি ফোনকলের প্রতিক্ষা যে কতটা অমূল্য, তা বুঝানো মুসকিল। আর এই প্রতিক্ষিত কলের জন্য কত যে ভালোবাসা, মমত্ব … সে যে হোক না কেন, যার ফোনই হোক না কেন… ছিল নিছিদ্র বন্ধনের সেতু।
ফোন করার আরেকটা সিস্টেম ছিল, B বিল্ডিংয়ের সামনে পাবলিক টেলিফোন বুথ। প্রিপেইড কার্ড কিনে ফোন করা। একবার খুব মজা হয়েছিল। সিস্টেমের কি যেন হ্যাক হয়েছিল, একটা কোড নাম্বার দিয়ে ফোন করলে কোন টাকা কাটে না। ব্যাস, হয়ে গেল। বুথের সামনে লাইন।
যা বলছিলাম, শুরুতে ফিরে আসি। পোস্ট অফিসের কথা। টিনশেডের এক কোনায় ছিল পোস্ট অফিস। এটাই ছিল তখনকার সবচেয়ে সস্তার যোগাযোগের মাধ্যম। মাত্র ২ টাকার খামে কয়েক পৃষ্টা মমতা, ভালোবাসা, সুখ, দু:খের অনুভূতি।
হঠাৎ কোন চিঠি আসলে “হৈমন্তি” গল্পের মত “আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম” বলিয়া মনের মধ্যে বাজনা বাজতে থাকতো।
বাবা সিলেটে চাকরী করায় প্রতি মাসেই খরচের চেয়েও বেশী দিতেন। তারপরও মা মাঝে মাঝে ঢাকা থেকে চিঠি লিখে খামের মধ্যে চিঠির ভাঁজে ৫০০/- টাকা পাঠাতেন। এই বাড়তি ৫০০ টাকা বর্তমানের এটিএম থেকে তোলা ৫ লক্ষ টাকার চেয়েও দামী ছিল।
ইন্টারনেট, মোবাইল, সোসিয়্যাল মিডিয়ার ভয়েচ কল, ভিডিও কল, মেসেন্জারের আনলিমিটেড মেসেজিং…. যতটা কাছেই টানুক আর রাখুক না কেন, মমত্ব ভালোবাসাগুলোও ঠিক ততটাই দূরে ঠেলে দিয়েছে।
অনেকদিন পর পাওয়া প্রতিক্ষিত বার্তা পাওয়ার যে মমত্ববোধ, তা কি আর সারাক্ষন সাথে থাকা মোবাইল-ইন্টারনেটে পাওয়া যায়? যায় না। কাছে পাওয়ার চেয়ে না পাওয়ার কস্ট অনেক সুখের।
প্রিয়জনের পাওয়া একটা চিঠি, তারপর উত্তর জানানো। এখানে দুজনের প্রতিক্ষার গ্যাপ মিনিমাম ৭/৮ দিন। এই ৭/৮ দিনের মনের যে আকুলতা, ব্যাকুলতার মমত্ব-ভালোবাসা কি ম্যাসেন্জারে সাথে সাথে পাওয়া উত্তরে মিলে! মিলে না….. সম্ভবও না।
শাহপরান হলে এখনো কি রেজিস্ট্রার অফিস ভায়া হয়ে এক্সটেনশনে ফোন আসে? আসার কথা না। টিনসেডের ক্যান্টিনের শুকনো খিচুরি আর পোস্ট অফিসটা? নেই কিছুই আর আগের মতো। সবই হারিয়ে গেছে, আগেকার সেই ভাঙাচোরা, অভাবের সংসারের অকৃত্রিম ভালোবাসার মতো।
——————————————–
১৯৯২ তে পাওয়া এক বন্ধুর…. আলোক (Shah Fakhrul Islam Alok) এর চিঠি।
…….. …….. …….. …….. …….. …….. …….. ……. …….
28 November, 2016 এর লেখা।