শুক্রবার | ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫ | ২৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার সফল অপারেশন

ঈশ্বরদী (পাবনা) সংবাদদাতাঃ

আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সব পর্যায়ের পরিদর্শনে সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দ্রুতই জ্বালানি লোডিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ধাপে অগ্রসর হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের পূর্ণ বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা সফলভাবে এনপিসিবিএল অপারেশন টিমের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেছেন নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (NPCBL)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. জায়েদুল হাসান। হস্তান্তরের পর থেকে অপারেটররা সিস্টেমটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করছেন এবং এ পর্যন্ত কোনো ধরনের সমস্যা দেখা দেয়নি বলেও তিনি জানান। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে—রূপপুরের বৈদ্যুতিক কাঠামো ভবিষ্যতে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহের পূর্ণ প্রস্তুতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

প্রকল্প সূত্র জানায়, বর্তমানে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা জাতীয় গ্রিড থেকে রূপপুর সাইটে বিদ্যুৎ গ্রহণের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা কমিশনিংয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। প্রতিদিন জাতীয় গ্রিড থেকে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ এনে সাইটের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিস্টেমের স্থিতিশীল অপারেশন প্রমাণ করছে যে ভবিষ্যতে রূপপুর কেন্দ্র নিজস্ব উৎপাদিত বিদ্যুৎ ও একই নেটওয়ার্ক ব্যবস্থার মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করবে। অর্থাৎ যে নেটওয়ার্ক আজ গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ নিচ্ছে, ভবিষ্যতে সেই নেটওয়ার্ক দিয়েই দেশকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ দেবে কেন্দ্রটি। এই দ্বৈত সক্ষমতা পুরো প্রকল্পকে আরও শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য করে তুলেছে।

উপ পরিচালক ড. খালেকুজ্জামান জানান, রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের কমিশনিং কার্যক্রমের অংশ হিসেবে Power Evacuation সংশ্লিষ্ট তিনটি ফ্যাসিলিটি – 00UAB: ৪০০ কেভি জিআইএস Building, 00UAB: ২৩০ কেভি জিআইএস Building এবং 00UAG: অটোট্রান্সফরমার ষ্ট্রাকচার টেম্পোরারি অপারেশনের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে। টেম্পোরারি অপারেশনে অন্তর্ভুক্ত করার পূর্বে ফ্যাসিলিটিগুলোর সকল সিস্টেমের Individual Testing I পরিদর্শন যথাযথ কমিশনিং প্রক্রিয়া অনুযায়ী সম্পন্ন করা হয়।

তিনি আরো জানান, টেম্পোরারি অপারেশন গ্রহণের পূর্বে টেষ্ট প্রোগ্রাম অনুযায়ী যেসব কার্যক্রম কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছেঃ ৪০০ কেভি ও ২৩০ কেভি জিআইএস-এর সকল ইন্ডিভিজুয়াল টেস্টিং, ইন্টারলক, প্রোটেকশন ও কন্ট্রোল সিস্টেম টেস্টিং; দুটি অটোট্রান্সফরমারের ইন্সটলেশন রেজিটেন্স, রেশিও টেস্ট, উইন্ডিং রেজিটেন্স, OLTC ফাংশোনালিটি, Relay প্রটেকশন, ইন্টারলক জিইএস কন্ট্রোল সিস্টেম পরীক্ষা; পাওয়ার সাপ্লাই, ভেন্টিলেশন, Instrumentation & Control, ফায়ার ডিটেনশন জিইএস, ওয়াটার-ফায়ার Extinguishing System-এর কার্যকারিতা পরীক্ষা; অবশিষ্ট কাজ শনাক্তকরণ করে Punch List প্রস্তুতকরণ এবং Elimination Deadline নির্ধারণ। সমস্ত পরীক্ষার ফলাফল সন্তোষজনক হওয়ায় ফ্যাসিলিটিগুলো টেম্পোরারি অপারেশনের জন্য গ্রহণযোগ্য ঘোষণা করা হয় বলে জানান তিনি।

অপারেশনাল ব্যবস্থাপনায় ৫টি শিফটে মোট ২০ জন জনবল নিয়োজিত রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিটি শিফটে রিয়েল-টাইম সিস্টেম মনিটরিং, ওয়াকডাউন, সুইচিং অপারেশন, গ্যাস প্রেসার ও ট্রান্সফরমার প্যারামিটার যাচাই, অ্যালার্ম স্ট্যাটাস পর্যবেক্ষণ এবং জাতীয় গ্রিডের NLDC-এর নির্দেশনা অনুযায়ী পাওয়ার সরবরাহ ও গ্রহণ নিশ্চিত করা হচ্ছে।

ড. খালেকুজ্জামান জানান, টেম্পোরারি অপারেশন চলাকালে সব সিস্টেম ও সরঞ্জাম স্থিতিশীলভাবে চলছে এবং কোনো উল্লেখযোগ্য অপারেশনাল সমস্যা পরিলক্ষিত হয়নি। সকল প্রোটেকশন, কন্ট্রোল ও সুইচিং সিস্টেম প্রত্যাশিত মান বজায় রেখেছে। শিফট লগ, ইভেন্ট রেকর্ড ও দৈনিক রিপোর্ট যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

এনপিসিবিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. জায়েদুল হাসান জানান, এ বছর রূপপুর প্রকল্পে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA)-এর Pre-OSART Mission সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পরিদর্শন সম্পন্ন হয়েছে। এসব মূল্যায়নে কেন্দ্রের নিরাপত্তা, প্রস্তুতি ও অপারেশনাল সক্ষমতা আন্তর্জাতিক মানে উত্তীর্ণ হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। রাশিয়ার Concern RosenergoAtom এবং বিভিন্ন জাতীয়-আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রক সংস্থার Self-Inspection কার্যক্রমেও রূপপুর প্রকল্প উচ্চমানের প্রস্তুতি প্রদর্শন করেছে।

তিনি আরও বলেন, সব মূল্যায়নে ইতিবাচক সাফল্যের ফলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র জ্বালানি লোডিংয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ধাপে অগ্রসর হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের জন্য এক নতুন ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সূচনা করবে। জ্বালানি লোডিং সম্পন্ন হওয়ার পর কেন্দ্রটি এনপিসিবিএল অপারেশন টিমের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে। অপারেশনের প্রাথমিক পর্যায়ে রাশিয়ার পারমাণবিক অপারেটিং সংস্থা Concern RosenergoAtom প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে।

তিনি বলেন, রূপপুর প্রকল্পের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার সফল অপারেশন, একের পর এক ইতিবাচক আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিদর্শন এবং জ্বালানি লোডিংয়ের প্রস্তুতি—সব মিলিয়ে কেন্দ্রটি এখন বাংলাদেশের শক্তি নিরাপত্তার এক নতুন আশার প্রতীক। অপারেটরদের বাস্তব অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে জাতীয় গ্রিডে রূপপুরের বিদ্যুৎ সরবরাহকে আরও নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য ও স্থিতিশীল করে তুলবে। রূপপুর এখন কেবল একটি প্রকল্প নয়—এটি দেশের উন্নয়ন, আত্মবিশ্বাস ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার প্রতীক।

 

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.