শনিবার | ২০ ডিসেম্বর, ২০২৫ | ৫ পৌষ, ১৪৩২

আমি ওর সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে চাই—শুধু এক মিনিট

রাশিদুল ইসলাম রাশেদ :
“আমি ওর সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে চাই—শুধু এক মিনিট… রাত সাড়ে দশটার পরে ফোন দেবে বলেছিল কিন্তু দেয়নি। নেটে পাইছি, কিন্তু ফোন ধরেনি। বলেছিল আধা ঘণ্টা রেস্ট নিয়া ডিউটিতে যাবার আগে ফোন ব্যাক করবে। সেই আধা ঘণ্টা আর শেষ হচ্ছে না। ফোনে ওর রক্ত দেখছি। আমার মাসুদের হাত নাই। কেউ আমারে ফোন ধরায়ে দাও। আমি শুধু এক মিনিট কথা বলতে চাই। আমার মাসুদের হাত নাই…”
কাঁপা কণ্ঠে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন আর এভাবেই আহাজারি করছিলেন কর্পোরাল মাসুদ রানার স্ত্রী আসমা উল হুসনা আঁখি (২৭)। স্বামীর শেষ কণ্ঠ শোনার আকুতি নিয়ে শোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন তিনি।
বাড়ির আরেক পাশে বিলাপ করছিলেন মাসুদের মা মোছা. মর্জিনা খাতুন। বারবার “ব্যাটা ব্যাটা” বলে ছেলের স্মৃতিচারণ করে বলছিলেন, “আমার খোঁজ কে নিবে ব্যাটা? চুলে কে তেল দিয়া দিবে? কত কষ্ট কইরা মানুষ হইছো ব্যাটা। আমারে স্বপ্ন দেখাইয়া চইলা গেলা…” বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠছিলেন বৃদ্ধা মা।
শোকে পাথর হয়েছেন দুই ভাই জনি ও রনি। আর প্রিয় বাবার সঙ্গে কথা বলার জন্য ছটফট করছে একমাত্র মেয়ে মাগফিরাতুল মাওয়া। স্ত্রী, মা ও স্বজনদের এমন হৃদয়বিদারক আহাজারিতে স্তব্ধ হয়ে আছে পুরো বোয়ালিয়াপাড়া গ্রাম।
১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনকালে সুদানের আবেই এলাকায় ইউএন ঘাটিতে সন্ত্রাসীদের অতর্কিত হামলায় নিহত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য কর্পোরাল মো. মাসুদ রানা। তিনি নাটোরের লালপুর উপজেলার আড়বাব ইউনিয়নের বোয়ালিয়াপাড়া গ্রামের মৃত সাহার উদ্দিনের ছেলে।
পারিবারিক ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ভূমিহীন কৃষক সাহার উদ্দিন ও মর্জিনা খাতুন দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় ছিলেন মাসুদ রানা। চরম অভাব-অনটনের মধ্যে পড়াশোনা করে ২০০৬ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। বাবার কষ্ট লাঘবে হাল ধরেন সংসারের। ছোট দুই ভাই—মনিরুল ইসলাম জনি ও রনি আহমেদকে পড়াশোনা করান। বড় ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় পরবর্তীতে তারাও সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।
শিক্ষার প্রতি মাসুদের ছিল গভীর অনুরাগ। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া স্ত্রীকে বিয়ের পর পড়াশোনায় উৎসাহ দিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করান। বর্তমানে স্ত্রী স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। মাসুদের স্বপ্ন ছিল—স্ত্রীকে একজন শিক্ষিত মা হিসেবে গড়ে তোলা। একমাত্র মেয়ে মাগফিরাতুল মাওয়াকে বানাতে চেয়েছিলেন দেশ সেরা চিকিৎসক। গতবছর ভর্তি করিয়েছিলেন যশোর ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে।
দূর প্রবাসে থেকেও পরিবারকে ভোলেননি তিনি। গত ২৮ নভেম্বর মেয়ের জন্মদিনে ফেসবুকে আবেগঘন পোস্টে বাবার স্বপ্নের কথা লিখেছিলেন মাসুদ। মেয়েকে নিয়ে বাবার সেই স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা—এ প্রশ্নই এখন তাড়া করছে স্বজনদের।
এদিকে সৌজন্য সাক্ষাতে এসে নাটোর আর্মি স্টেডিয়াম ক্যাম্প কমান্ডার মেজর মো. নাজমুল আলম আবীর জানান, শহীদ মাসুদের পরিবারকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। একই আশ্বাস দিয়েছেন লালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জুলহাস হোসেন সৌরভ। এ সময় ইউএনও আরও জানান, সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী রবিবার (২১ ডিসেম্বর,২০২৫) সকালে শহীদ মাসুদের লাশ হেলিকপ্টার যোগে লালপুরে নিয়ে আসা হবে।

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.