
নিয়ন মতিয়ুল:
চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনকে যদি মফস্বল সাংবাদিকতার দিকপাল বলা হয়, তবে নিঃসন্দেহে ঢাকার বাইরের সাংবাদিকরাই বাংলাদেশের প্রকৃত ‘স্টার’। রাজধানীর এসি-নির্ভর অভিজাত সংবাদকক্ষকে গণমাধ্যমে রূপ দেওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল মফস্বলের নিরলস সংবাদকর্মীদের। কয়েক দশক আগেও ঢাকার খ্যাতিমান সম্পাদকরা মফস্বল সাংবাদিকদের অবদান অকপটে স্বীকার করতেন। তাঁদের নাম মনে রাখতেন, সম্মান করতেন। মফস্বল থেকে কেউ ঢাকায় এলে গর্বের সঙ্গে হাউজের সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন। ঢাকার বাইরের একটি শক্তিশালী রিপোর্টই কোনো পত্রিকা বা সংবাদমাধ্যমের বাজারমূল্য এক লাফে বাড়িয়ে দিত।
কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেই দৃশ্যপট বদলে গেছে। রাজধানীকেন্দ্রিক সাংবাদিকতা ক্রমেই রাজনীতিনির্ভর হয়ে উঠেছে। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রবণতা এখানে প্রবল। ফলে এই সাংবাদিকতা প্রান্তিক মানুষের জীবন, বঞ্চনা কিংবা ন্যায়বিচারের প্রশ্নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। বিগত শতকের মাঝামাঝি থেকেই সংবাদমাধ্যম রাজনৈতিক মিশনে যুক্ত হতে শুরু করে, যা স্বাধীনতার পরও অব্যাহত থাকে। নব্বইয়ের দশকে টেলিভিশন মিডিয়ার উত্থানে যাঁরা ‘স্টার সাংবাদিক’ হিসেবে পরিচিতি পান, তাঁদের অনেকেই ক্যাম্পাসজীবনে সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই রাজনৈতিক আদর্শই পরবর্তীতে সংবাদমাধ্যমের ভেতর দিয়ে বাস্তবায়নের চেষ্টা হয়েছে।
এর বিপরীতে মফস্বল সাংবাদিকতার লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। এখানে রাজনৈতিক মতাদর্শের চেয়ে মানুষের বাস্তব সমস্যা, নিপীড়ন, বৈষম্য, বিচারহীনতা এবং স্থানীয় সরকার ও জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহির বিষয়টি প্রাধান্য পেত। এই ভূমিকার কারণেই সাধারণ মানুষের কাছে মফস্বল সাংবাদিকরা অনেকটা ‘দেবতুল্য’ সম্মান অর্জন করেছিলেন। কিন্তু এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। বিশুদ্ধ মফস্বল সাংবাদিকতাকে মোকাবিলায় তারা নানা প্রলোভনের মাধ্যমে প্রেসক্লাব, ইউনিয়ন কিংবা উপজেলাভিত্তিক রাজনৈতিক বলয় তৈরির চেষ্টা চালায়। এর ফলেই ঢাকার বাইরে আর কোনো মোনাজাতউদ্দিন যেন জন্ম নিতে না পারে—সে লক্ষ্য অনেকটাই বাস্তবায়িত হয়েছে।
তবু সব প্রতিকূলতার মধ্যেও মফস্বলে এখনও অনেক মেধাবী ও দায়িত্বশীল সাংবাদিক সততার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। বিজ্ঞাপননির্ভর প্রচেষ্টার মাধ্যমে রাজধানীর শত শত পত্রিকাকে টিকিয়ে রাখার পেছনেও তাঁদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দশকের পর দশক ধরে তাঁরা প্রভাবশালী গণমাধ্যমের ভিত শক্ত করে রেখেছেন। তবে একই সঙ্গে এটাও সত্য, কিছু অপেশাদার সম্পাদক ও বার্তাপ্রধানের কারণে মফস্বল সাংবাদিকতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি প্রখ্যাত দু-একজন সম্পাদকের অনৈতিক প্রস্তাবের কাছে হার মেনেছেন মফস্বলের কিছু সাংবাদিক। তার ওপর ডিজিটালাইজেশনের স্রোতে কে প্রকৃত সাংবাদিক আর কে নন—সে বিভ্রান্তি আরও ঘনীভূত হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে মফস্বল সাংবাদিকতা নিয়ে চলতি ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত দুটি সংবাদ নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। ৭ ডিসেম্বর দৈনিক আমার দেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল—“এক উপজেলায় ৮ প্রেসক্লাব, ‘সাংবাদিক’ ৩০০-র অধিক”; সাবহেডে বলা হয়, “চাঁদাবাজির হাতিয়ার প্রেস কার্ড”। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অনেকেই সাংবাদিক পরিচয়কে ব্যক্তিগত প্রভাব, চাঁদাবাজি ও হুমকির ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। একজন বর্ষীয়ান সাংবাদিক আক্ষেপ করে বলেন, ২০-৩০ বছর সম্মান নিয়ে কাজ করার পর এখন লজ্জায় মুখ দেখাতে পারেন না।
এর দুই দিন পর, ৯ ডিসেম্বর বিডিনিউজে প্রকাশিত হয় আরেকটি প্রতিবেদন—‘বরগুনার ৯০ ভাগ সাংবাদিক ‘চাঁদাবাজ’, বললেন খাদ্য কর্মকর্তা’। বরগুনা সদরের খাদ্য নিয়ন্ত্রক শহিদুল হক ক্যামেরার সামনে প্রকাশ্যে দাবি করেন, তাঁর কাছে আসা সাংবাদিকদের ৯০ শতাংশই চাঁদাবাজ। এমনকি তিনি একজন সাংবাদিককে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখার কথাও বলেন।
দুটি প্রতিবেদনের মূল শব্দ একটাই—‘চাঁদাবাজি’। একদিকে সাংবাদিকের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভাজন ও সিন্ডিকেটের বিস্তার, অন্যদিকে প্রায় পুরো সাংবাদিক সমাজকে চাঁদাবাজ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা—দুটিই ভয়াবহ সংকেত বহন করে। খবরে বলা হয়েছে, আবদার পূরণ না হলে সিরিজ নিউজ, সরাসরি টাকা দাবি, এমনকি ফেসবুক ও ইউটিউবে ভুয়া প্রচারণার অভিযোগ রয়েছে। আরও উদ্বেগজনক হলো—হকার, মুদি দোকানদার, রাজমিস্ত্রি, ড্রাইভার, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, এমনকি মাদক ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক দালালদের টাকার বিনিময়ে ‘প্রেস কার্ড’ দেওয়া হচ্ছে, যা চাঁদাবাজির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এই চিত্র শুধু শ্যামনগর বা বরগুনা সদরের নয়—বরং গোটা দেশের বাস্তবতা। প্রশ্ন হলো, ঢাকার বাইরের মোনাজাতউদ্দিনের উত্তরসূরিরা কেন এবং কীভাবে পথভ্রষ্ট হচ্ছে? সারা দেশে লক্ষাধিক সংবাদকর্মী রয়েছেন, যাঁদের হাত ধরেই গণতন্ত্র ও সুশাসনের দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে। সেই বাস্তবতা রাজনৈতিক দল, সরকার এবং গণমাধ্যমের মালিকদের অনুধাবন করা জরুরি। দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে সংবাদমাধ্যমকে দল ও গোষ্ঠীর প্রভাবমুক্ত করার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
মতামত লেখকের নিজস্ব
[তথ্যসূত্র : সমাজকাল ( মতামত কলাম), প্রকাশ: ১২ডিসেম্বর, ২০২৫]