শনিবার | ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ | ১২ পৌষ, ১৪৩২

এক প্রেমের বহু অধ্যায়, লালপুরে সাবেক স্ত্রী হত্যার লোমহর্ষক কাহিনী

রাশিদুল ইসলাম রাশেদ :
প্রেমের পর বিয়ে। মনোমালিন্য ও পারিবারিক কলহ  থেকে ডিভোর্স। এরপর দুজনেই অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তবে থেমে থাকেনি পরস্পরের যোগাযোগ। সেই যোগাযোগের সূত্র ধরেই আবারও প্রেম জন্মে। গড়ে ওঠে নতুন সম্পর্ক। কিন্তু সে সম্পর্কেও থাকে নানা  টানাপোড়ন। এরই মধ্যে চলতে থাকে ধর্ষণ মামলা। অবশেষে সাবেক স্ত্রীকে গলা কেটে নৃশংসভাবে হত্যা করেন সেনা সদস্য মো. রবিন হোসেন (২৩)। পরিশেষে আটক হয়ে পুলিশের কাছে সাবেক স্ত্রীকে হত্যায় জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন তিনি।
আটক রবিন উপজেলার চংধুপইল ইউনিয়নের চন্ডিগাছা গ্রামের কসিমউদ্দিনের (তছিম) ছেলে। বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর, ২০২৫) বিকেলে সাবেক স্ত্রী মোছা. তাম্মি খাতুনকে (২১) গলা কেটে হত্যার পর পালিয়ে যাবার সময় শোভ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকায় স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়েন তিনি। নিহত তাম্মি খাতুন একই উপজেলার নাবিরপাড়া গ্রামের মোঃ জিল্লুর রহমানের মেয়ে ও আব্দুলপুর সরকারি কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী।
স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, লালপুর ও বাগাতিপাড়া উপজেলার সীমান্তবর্তী ইউএনও পার্ক এলাকায় তাম্মিকে ছুরি দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে অভিযুক্ত রবিন। পরে লাশ কাঁধে করে শোভদিদার পাড়া এলাকায় রেললাইনের ২০৩ নং পিলারের পাশে রেখে রক্তমাখা দেহে পালিয়ে যাচ্ছিল সে। তবে শোভ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে তার রক্তমাখা শরীর ও কাপড় চোপড় দেখে সন্দেহ হয় মাঠে কাজ করা স্থানীয় কৃষকদের। এ সময় তাকে জিজ্ঞাসাবাদে এক পর্যায়ে বিষয়টি জানাজানি হলে স্থানীয়রা তাকে গণপিটুনি দেয়। খবর পেয়ে লালপুর থানা পুলিশ দ্রুত ঘটনস্থলে পৌঁছে রবিনকে থানা হেফাজতে নেয়।
এ ব্যাপারে লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মজিবর রহমান জানান, ঘটনার পর অভিযুক্তকে পুলিশের জিম্মায় নেওয়া হয়। তবে যেহেতু ঘটনাটি রেললাইন এলাকায় সংঘটিত, তাই আইনগত প্রক্রিয়া অনুযায়ী রেলওয়ে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।
পরে ঈশ্বরদী রেলওয়ে থানা পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাম্মির লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাবনা সদর হাসপাতালে প্রেরণ করে। এ বিষয়ে ঈশ্বরদী রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউর রহমান বলেন, তাম্মির পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে সেনা সদস্য রবিন সাবেক স্ত্রী তাম্মিকে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তার কাছ থেকে হত্যায় ব্যবহৃত একটি ধারালো ছুরি জব্দ করা হয়েছে। অধিকতর তদন্ত শেষে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে।
উল্লেখ্য, স্থানীয় ও  তাম্মির পরিবার সূত্রে জানা যায়, নিহত তাম্মি ও রবিন দুজনেই উপজেলার করিমপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় পড়াশোনা করতেন। সপ্তম শ্রেণী থেকে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে তারা আব্দুলপুর সরকারি কলেজে পড়াশোনা করা অবস্থায় রবিন সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। চাকরিতে যোগদানের পর থেকে তাদের প্রেমের সম্পর্কে অবনতি ঘটে। এক পর্যায়ে বিয়ের দাবিতে রবিনের বাড়িতে গিয়ে বিষ পান করে তাম্মি। পরে সুস্থ হলে ২০২৩ সালের ২৩ শে মার্চ তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু বিয়ের পর রবিনের বাবা ও ভগ্নিপতি তাম্মিকে পুরোপুরি মেনে না নিলে বিভিন্ন বিষয়ে পারিবারিক কলহ শুরু হয়। ফলে বিয়ের ৮ মাস পরে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে তাম্মির ভাবি মোছা. রোকেয়া খাতুন (২৩) আরও বলেন, বিবাহ বিচ্ছেদের পরেও তাম্মির সঙ্গে রবিনের যোগাযোগ ছিল। এর মাঝে ২০২৪ সালে তাম্মিকে পাবনায় দ্বিতীয় বিয়ে দেয়া হয়। তবে রবিনের প্ররোচনায় বিয়ের এক মাস পর তাম্মি তার দ্বিতীয় স্বামীর বাড়িতে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। বিয়ের ৫ মাস পরে তার দ্বিতীয় বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এ সময় তাম্মির সঙ্গে রবিন তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে। তারা প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেত কিন্তু বরাবরই বিয়ের বিষয়টি এড়িয়ে যেত রবিন। এক পর্যায়ে গত ৩০ অক্টোবর, ২০২৫ রবিনের বিরুদ্ধে নাটোর কোর্টে ধর্ষণের মামলা দায়ের করা হয়। এ সময় মামলা তুলে নিতে তাম্মিকে মিথ্যা প্রলোভন দেখায় রবিন। এক মাস আগে রবিন তার ননদের সঙ্গে বাড়িতে দেখা করতে আসলে তাকে আটক করা হয়েছিল। সে সময় তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে কৌশলে পালিয়ে যায় রবিন।
রোকেয়া আরও জানান, গত বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) দিবাগত রাতে দীর্ঘক্ষণ তাম্মির সঙ্গে মুঠোফোনে রবিনের কথা হয়। বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) সকাল ৭টার দিকে তাম্মি তার ভাবি রোকেয়াকে জানায়, রবিনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে সে। আজ রবিন তাকে বিয়ে করবে। সেজন্য সে জামা কাপড়সহ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এ সময় তাকে রবিনের মিথ্যা প্রলোভনে পড়তে নিষেধ করলেও ভাবির কথা শোনেননি তাম্মি। তাম্মি বলেছিল, “আজ রবিন সত্যিই আমাকে বিয়ে করবে। ”
রোকেয়া খাতুন আফসোস করে বলেন, “বিয়ে করার কথা বলে ডেকে ননদকে যে হত্যা করবে তা ভাবতেই পারিনি। ও বলেছিল – যেখানেই থাকি তোমার সাথে যোগাযোগ করবো, ভাবি। কিন্তু দুপুরের পর আমি অনেক বার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারিনি। ওর ফোন বন্ধ ছিল।” কি থেকে কি হয়ে গেল বলে কান্না করতে থাকেন তিনি।
এদিকে রবিনের পরিবারের সদস্যরা পলাতক থাকায় এবং মুঠোফোন নম্বর বন্ধ রাখায় তাদের কারো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে তাম্মির সঙ্গে সম্পর্কের জেরে রবিনের দ্বিতীয় স্ত্রী তৃষা (২২) দীর্ঘদিন ধরে তার বাবা তৈয়বের বাড়িতে অবস্থান করছে। সেও আর রবিনের সঙ্গে সংসার করতে চাই না বলে জানা গেছে। প্রসঙ্গত, তাম্মির সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের কিছুদিন পর ২০২৩ সালেই রবিন তার দ্বিতীয় স্ত্রী তৃষার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
একটি সরল সম্পর্ক জটিল হয়ে ওঠেছে পারস্পারিক ভুল বোঝাবুঝি ও অবৈধ সম্পর্কের টানাপড়নের মধ্য দিয়ে। যার শেষ পরিণতি একজনের মৃত্যু। আরেকজন সেই হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে বিচারের কাঠগড়ায়। এটি কোন গল্প নয়। এই ভয়াবহ ঘটনা উপজেলার সচেতন মহলকে করেছে হতভম্ব।

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.